সুখস্মৃতির মাঠে বিপিএল অভিষেকে ব্যাটে-বলে রঙিন মেয়ার্স

কাইল মেয়ার্সের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স ও মুশফিকের ঝড়ো ফিফটিতে বরিশালের জয়, বিপর্যয়ের মধ্যে বেনি হাওয়েল ও আরিফুল হকের রেকর্ড গড়া জুটির পরও সিলেটের হার।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Feb 2024, 11:14 AM
Updated : 17 Feb 2024, 11:14 AM

এই শহর, এই মাঠ, এই আঙিনাকে হয়তো কখনোই ভুলবেন না কাইল মেয়ার্স। তার জীবনের বাঁক বদলের শুরু এখানেই। টেস্ট অভিষেকে ইতিহাস গড়া ডাবল সেঞ্চুরিতে অবিস্মরণীয় এক জয় তিনি এনে দিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। তিন বছর পর আরেকটি ফেব্রুয়ারিতে ক্যারিবিয়ান অলরাউন্ডার সেই একই প্রাঙ্গনে রাঙালেন বিপিএল অভিষেক। তার ঝড়ো ব্যাটিং আর সুইং বোলিংয়ের যুগলবন্দিতে প্লে অফের আশা আরেকটু উজ্জ্বল করল বরিশাল।

বিপিএলে শনিবার সিলেট স্ট্রাইকার্সকে ১৮ রানে হারায় ফরচুন বরিশাল। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে বরিশালর ১৮৩ রানের জবাবে সিলেট যেতে পারে ১৬৫ পর্যন্ত।

ব্যাট হাতে তিনটি করে চার ও ছক্কায় ৩১ বলে ৪৮ রানের ইনিংস খেলার পর বল হাতে ৪ ওভারে ১২ রানে ৩ উইকেট নেন মেয়ার্স। তার প্রথম ওভারটি ছিল ডাবল উইকেট মেডেন।

মেয়ার্সের দাপট এতটাই ছিল যে ধারাভাষ্যকক্ষে রমিজ রাজা বলছিলেন, ‘ওয়ান ম্যান ডেমোলিশন আর্মি।’ যদিও তিনি একাই নন, ঝড়ো ফিফটিতে বরিশালকে বড় স্কোরে নিতে অবদান রাখেন মুশফিকুর রহিমও। তিনটি করে চার ও ছক্কায় অভিজ্ঞ কিপার-ব্যাটসম্যান করেন ৩২ বলে ৫২ রান।

আসরের প্রথম তিন ম্যাচে দুই ফিফটির পর টানা ছয় ম্যাচে বড় স্কোর গড়তে পারেননি তিনি। সবশেষ তিন ম্যাচে আউট হন দু অঙ্ক ছোঁয়ার আগেই। তবে এই স্বরূপে ফেরেন তিনি। মেয়ার্সের চেয়ে তার ব্যাটই ছিল বেশি উত্তাল।

রান তাড়ায় ৪০ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে একদম ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় সিলেটের ইনিংস। সেখান থেকেই অসাধারণ পাল্টা আক্রমণে ৫২ বলে ১০৮ রানের রেকর্ড জুটি গড়ে তোলেন আরিফুল হক ও বেনি হাওয়েল। তবে ম্যাচ জয়ের আশা সেভাবে জাগাতে পারেননি তারা।

টস জতে ব্যাটিংয়ে নামা বরিশাল শুরু করে ম্যাচের প্রথম বলেই তামিম ইকবালের দারুণ অফ ড্রাইভের বাউন্ডারিতে। পরের দুই ওভারে তিনটি বাউন্ডারি আসে আহমেদ শেহজাদের ব্যাটে। এই পরিক্রমায় ৭ হাজার টি-টোয়েন্টি রানও পূর্ণ করেন পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান। তবে ১১ বলে ১৭ করে থেমে যান তিনি তৃতীয় ওভারেই।

পঞ্চম ওভারে ড্রেসিংরুমে ফেরার পথে অনেকটা দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন তামিমও। হ্যারি টেক্টরের বলে আম্পায়ার তাকে এলবিডব্লিউ দিলে রিভিউ নেন বরিশাল অধিনায়ক। তবে স্টেডিয়ামের বড় পর্দায় যখন আল্ট্রা-এজ-এ দেখতে পান যে বল লাগেনি ব্যাটে, তখনই আউট ধরে নিয়ে হাঁটা দেন তিনি। কিন্তু হক আই-তে বিস্ময়করভাবে দেখা যায়, খুব কাছে পিচ করেও এই অফ স্পিনারের বল চলে যাচ্ছিল স্টাম্পের ওপর দিয়ে। দুই দলের ক্রিকেটারদের চেহারা আর অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠছিল, কেউই যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না প্রযুক্তিকে।

তামিম অবশ্য আবার একই পথ ধরেন দ্রুতই। রিভিউয়ে টিকে যাওয়ার পরের ওভারেই তেড়েফুঁড়ে মারতে গিয়ে তানজিম হাসানের ফুল লেংথ বলে উপড়ে যায় তার অফ স্টাম্প (১৮ বলে ১৯)।

এরপর সৌম্য সরকারকেও দ্রুত হারিয়ে খানিকটা নড়বড়ে হয়ে পড়ে বরিশাল। তবে সেই অস্বস্তি দূর হয়ে যান মেয়ার্স ও মুশফিকের ব্যাটে। বিশেষ করে, মুশফিক ক্রিজে গিয়েই দারুণ কিছু শট খেলে সরিয়ে দেন চাপ। বেনি হাওয়েলকে স্লগ সুইপে ছক্কা মারেন তিনি। নিয়ন্ত্রিত বোলিং করতে থাকা টেক্টরকেও এক ওভারে এলোমেলো করে দেন ছক্কা ও চার মেরে।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে বিপিএলে ছক্কার সেঞ্চুরিও হয়ে যায় তার এ দিন।

হাওয়েলকে একটি ছক্কার পর সানজামুল ইসলামকে গ্যালারিতে আছড়ে ফেলেন মেয়ার্স। ৪.৩ ওভারেই দুজনের জুটির ফিফটি হয়ে যায়।

এরপরও চালিয়ে যান দুজন। শেষ পর্যন্ত ৪৮ বলে ৮৪ রানের জুটি থামান এবারের বিপিএলে প্রথম খেলতে নামা বাঁহাতি পেসার শফিকুল ইসলাম। তার স্লোয়ারে শর্ট ফাইন লেগে ধরা পড়েন মেয়ার্স। পরের ওভারে রান আউট হয়ে যান মুশফিক।

রানের গতিও তখন একটু কমে যায়। ওই দুই ওভারে রান আসে ছয়। তবে শেষটা আবার ভালো করে তারা। শফিকুল ও তানজিমকে ছক্কা মারেন মেহেদী হাসান মিরাজ। শুরুতে ৮ বলে কেবল ৩ রান করলেও পরে দুটি বাউন্ডারি আসে মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে। তাতে রান ছাড়িয়ে যায় ১৮০।

সিলেটের ব্যাটিং শক্তি আর ফর্ম অনুযায়ী লক্ষ্যটা এমনিতেই ছিল খুব কঠিন। তা আরও ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় রান তাড়ার শুরুতেই। প্রথম ওভারেই মেয়ার্স ধরেন জোড়া শিকার।

ইনিংসের দ্বিতীয় বলে দারুণ এক ইনসুইঙ্গারে বোল্ড হয়ে যান টেক্টর। মেয়ার্সের সুইংকে অকার্যকর করতেই হয়তো তিনে নামা শান্ত ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে শট খেলার চেষ্টা করেন। ব্যাটের কানায় লেগে স্লিপে যাওয়া বল বাঁদিকে ঝাঁপিয়ে দুর্দান্ত রিফ্লেক্সে এক হাতে ধরে ফেলেন সৌম্য।

সেই ধাক্কা সামাল দেওয়ার আগেই রান আউট হয়ে যান জাকির হাসান।

মোহাম্মদ মিঠুন ক্রিজে গিয়ে ওবেড ম্যাককয়কে ছক্কা-চার মেরে আগ্রাসনের ইঙ্গিত দেন বটে। তবে সিলেট অধিনায়ককেও বিদায় করে দেন মেয়ার্স।

আরেকপ্রান্তে টিকে ছিলেন বিপিএলে প্রথম খেলতে নামা অ্যাঞ্জেলো পেরেরা। তবে অষ্টম ওভারে কেশাভ মহারাজকে উড়িয়ে মারার চেষ্টায় তার ইনিংস থামে ১৯ বলে ১৭ রানে। কাভার সীমানা থেকে অনেকটা ছুটে সামনের দিকে ফুল লেংথ ডাইভে যেভাবে বল মুঠোয় জমান সৈয়দ খালেদ আহমেদ, এবারের বিপিএলের সেরা ক্যাচগুলির একটি তা।

এরপর মেহেদী হাসান মিরাজের বলে যখন বোল্ড হয়ে যান রায়ান বার্ল, দশম ওভারে সিলেটে রান তখন ৬ উইকেটে ৪০।

ম্যাচের কিছু কী আর বাকি থাকে!

আরিফুল ও হাওয়েল দেখালেন, শেষের আগে শেষ নয় কিছুই। দুর্দান্ত সব খেলতে থাকেন দুজন। দুই প্রান্ত থেকে চার-ছক্কা আসতে থাকে প্রতি ওভারে। বড় পরাজয়ের চোখরাঙানি থেকে দলকে শুধু ভদ্রস্থ পর্যায়েই নিয়ে যাননি, বরিশালের মাথা ব্যথার কারণও হয়ে ওঠেন দুজন।

শেষ দুই ওভারে প্রয়োজন পড়ে ৪৪ রানের। ১৯তম ওভারে ম্যাককয়ের প্রথম বলটিতে ওয়াইডসহ আসে দুই রান, পরেরটিতে ছক্কা মারেন আরিফুল। ১১ বলে ৩৬ রান লাগে তখন। একটু উত্তেজনা ফেরে ম্যাচে। তবে পরের বলেই বিদায় নেন আরিফুল।

৫ চার ও ৪ ছক্কায় ৩১ বলে ৫৭ করে ফেরেন তিনি। বিপিএলে ৭৯ ম্যাচে তার প্রথম ফিফটি এটি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তার আগের একমাত্র ফিফটি প্রাইম ব্যাংকের হয়ে।

বিপিএলে দ্বিতীয় ফিফটিতে ৫ চার ও ৪ ছক্কায় ৩২ বলে ৫৩ করে শেষ ওভারে আউট হন হাওয়েল।

দুজনের ১০৮ রানের জুটি সপ্তম উইকেটে বিপিএলের প্রথম শতরানের জুটি। আগের সেরা ৮৭ রানের জুটি ছিল ২০১৬ সালে রংপুরের হয়ে জিয়াউর রহমান ও সোহাগ গাজীর।

এই জুটি থামিয়ে শেষ পর্যন্ত বরিশালের জয় পরিষ্কার ব্যবধানেই। ১০ ম্যাচে তাদের ষষ্ঠ জয় এটি। গতবারের রানার্স আপ সিলেট এবার সপ্তম ম্যাচে হারল ১০ ম্যাচ খেলেই।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

ফরচুন বরিশাল:  ২০ ওভারে ১৮৩/৬ (তামিম ১৯, শেহজাদ ১৭, মেয়ার্স ৪৮, সৌম্য ৮, মুশফিক ৫২, মাহমুদউল্লাহ ১২*, মিরাজ ১৫, সাইফ ০*; আরিফুল ২-০-১৭-০, শফিকুল ৪-০-৩৪-১, তানজিম ৪-০-৪৮-৩, টেক্টর ৪-০-২৯-১, হাওয়েল ৪-০-৪০-০, সানজামুল ২-০-১২-০)।

সিলেট স্ট্রাইকার্স:  ২০ ওভারে ১৬৫/৮ (টেক্টর ০, জাকির ৫, শান্ত ০, পেরেরা ১৭, মিঠুন ১০, হাওয়েল ৫৩, বার্ল ৩, আরিফুল ৫৭, তানজিম ; মেয়ার্স ৪-১-১২-৩, সাইফ ৪-০-২৯-১, ম্যাককয় ৪-০-৪৫-১, মহারাজ ৪-০-৩১-০, মিরাজ ২-০-১৮-১, খালেদ ২-০-৩১-০)।

ফল: ফরচুন বরিশাল ১৮ রানে জয়ী।

ম্যান অব দা ম্যাচ: কাইল মেয়ার্স।