লক্ষ্য পূরণে ফিটনেস ধরে রাখার ওপরে জোর দিচ্ছেন বাংলাদেশের তরুণ এই পেসার।
Published : 19 Mar 2024, 10:08 PM
বছর দেড়েক আগেও দেশের ক্রিকেটে অপরিচিত এক নাম ছিলেন নাহিদ রানা। বিস্ময়কর গতিতে এগিয়ে আজ তিনিই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মঞ্চে। তার এই অবিশ্বাস্য পথচলায় সবচেয়ে বড় হাতিয়ারও ‘গতি।’ দ্রুতগতির বোলিংয়ে নজর কাড়ার পর, সামনে এবার জাতীয় দলের হয়ে নিজেকে মেলে ধরার অগ্নিপরীক্ষা। সেখানেও গতি দিয়েই জয় করতে চান বাংলাদেশের এই পেসার।
সবশেষ বিপিএলেই যেমন, প্রথমবার বল হাতে নিয়ে শুরুতেই প্রতিপক্ষ পান ব্যাটসম্যান সাকিব আল হাসানকে। স্নায়ুচাপ সামলে নিজের সেরা অস্ত্রই তাক করেন নাহিদ, ছোড়েন ১৪৯.৭ কিলোমিটার গতির এক গোলা। ওই ওভারে তিনি আরও দুটি ডেলিভারি করেন ১৪৭ কিলোমিটার গতিতে।
ফ্র্যাঞ্চাইজি এই টুর্নামেন্টে যে তিনি অসাধারণ কিছু করে ফেলেছেন, তা নয়। তবে জাতীয় দলের দুয়ারে কড়া নাড়ার কাজটা করে ফেলেন।
ক্যারিয়ারের শুরুতে তার চমক দেখানোর শুরুও এই গতি দিয়ে। ২০২২ সালের জাতীয় ক্রিকেট লিগ দিয়ে মূলত উত্থান চাপাইনবাবগঞ্জের এই তরুণের। সেবার রাজশাহী বিভাগের হয়ে ৬ ম্যাচে ৩ বার ইনিংসে ৫ উইকেটসহ আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩২ উইকেট নেন তিনি।
ওই আসর শেষে নিজের ভবিষ্যত ভাবনা সম্পর্কে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে নাহিদ বলেছিলেন, “আমি বেশি দূর চিন্তা করতে চাই না। এখন যদি বলি দুই বছরের মধ্যে জাতীয় দলে খেলব, বলে দিলেই তো হবে না। প্রতিনিয়ত নিজের উন্নতি করে যেতে হবে, পারফর্ম করতে হবে।”
দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই আলো ছড়িয়ে নাহিদ সুযোগ পেয়েছেন জাতীয় দলে। ডাক পেয়েছেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই টেস্টের সিরিজে।
প্রায় ১৫ মাস আগের ওই কথা মনে করিয়ে দিতেই লাজুক হাসিতে নাহিদ বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ্। অনেক ভালো লাগছে। সবই আসলে আল্লাহ্র রহমত। সবসময়ই চেষ্টা থাকবে যেন ভালো কিছু করতে পারি।’
জাতীয় লিগের ওই আসরেই প্রথম গতি ও বাউন্সের মিশেলে নিজেকে আলাদা করে চেনান নাহিদ। পরে গত বছরের বিপিএলে তাকে দলে ভেড়ায় খুলনা টাইগার্স। তিন ম্যাচের বেশি অবশ্য খেলার সুযোগ পাননি সেবার। ওই তিন ম্যাচের একটিতে ১৪৮ কিলোমিটার গতিতে বল করেন নাহিদ। নিয়মিতই অবশ্য ১৪৫ কিলোমিটার গতিতে বোলিং করতে দেখা যায় তাকে।
পরে তিনি ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন গত বছরের জাতীয় লিগ ও বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগেও। সব মিলিয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১৫ ম্যাচে স্রেফ ২১.৯২ গড়ে ৬৩ উইকেট নিয়ে এখন টেস্ট খেলার দুয়ারে দাঁড়িয়ে নাহিদ।
গতি দিয়েই যে তরতরিয়ে উঠে আসতে পেরেছেন নাহিদ, তার প্রমাণ মিলেছে বাংলাদেশ জাতীয় দলের নির্বাচক আব্দুর রাজ্জাকের কথায়। তিনি তো বলেই দিয়েছেন, “এই মুহূর্তে নাহিদই সম্ভবত দেশের সবচেয়ে গতিময় বোলার।”
নাহিদও নিজের সেরা অস্ত্রকেই আরও ধারাল করতে চান। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের দলে যোগ দিয়ে তিনি বলছেন, ২২ গজে গতি ধরে রাখতে তার মূল মন্ত্র, নিজের যথাযথ যত্ন নেওয়া ও যতটা সম্ভব চোটমুক্ত থাকার চেষ্টা করা।
চলতি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের প্রথম তিন রাউন্ডে আবাহনী লিমিটেডের জার্সিতে মাঠে নামার সুযোগ হয়নি নাহিদের। এর মাঝেই রোববার সন্ধ্যায় তাকে জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার খবর জানান বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার শাহরিয়ার নাফীস।
ক্যারিয়ারের নতুন অধ্যায় শুরুর খবরটি জানার পর প্রথমেই পরিবারের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন নাহিদ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে ওই মুহূর্তে তার ও পরিবারের অনুভূতি তুলে ধরলেন ২১ বছর বয়সী পেসার।
“সবারই স্বপ্ন থাকে জাতীয় দলে খেলার। বাসার সবাই যখন শুনল, আমি সুযোগ পেয়েছি, তারা অনেক খুশি। পরিশ্রম করেছি, এখন ফল পেয়েছি। সবাই এতে অনেক খুশি হয়েছে। বাবা-মাসহ সবারই অনেক বড় আশা আমাকে নিয়ে। চেষ্টা করব সেরাটা দিয়ে খেলতে। আমার লক্ষ্য মূলত একটাই, সুযোগ পেলে দলকে নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করব।”
অন্যদের তুলনায় কিছুটা দেরিতে শুরু হয়েছে নাহিদের ক্রিকেট ক্যারিয়ার। পরিবারের শর্ত ছিল, মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগে ভর্তি হওয়া যাবে না ক্রিকেট অনুশীলনে। নিজের ইচ্ছে থাকার পরও তাই স্কুলে থাকতে ক্রিকেট বলের কোনো পাঠ নিতে পারেননি নাহিদ। ফলে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটেরও কোনো অভিজ্ঞতা নেই তার।
২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর রাজশাহীর ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হন তিনি। ওই একাডেমির কোচ আলমগীর কবিরের হাত ধরে ক্রিকেট বলে হাতেখড়ি হয় নাহিদের। দারুণ সম্ভাবনার আলো ছড়িয়ে পরের বছরই জাতীয় লিগে তার অভিষেক হয় রাজশাহী বিভাগের জার্সিতে।
অভিষেক মৌসুমে ২ ম্যাচে নাহিদ নেন ৫ উইকেট। ২০২২ সালের আসরে ৩২ উইকেট নিয়ে করেন বাজিমাত। এরপর শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়া। ঘরোয়া ক্রিকেটে সাফল্যময় যাত্রার সৌজন্যে তিনি সুযোগ পান বিসিবির হাই পারফরম্যান্স ইউনিটে। গত বছর এশিয়ান গেমসের দলেও ছিলেন তিনি।
পথচলায় যাদের পাশে পেয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন নাহিদ।
“ক্রিকেট শুরুর পর থেকেই অনেক ভালো সময় গেছে আসলে। এই যাত্রায় সবাই অনেক সমর্থন করেছে আমাকে। আমি মনে করি, সবার অনেক দোয়া আছে আমার সাথে। এখন একটা সুযোগ পেয়ে অনেক ভালো লাগছে। সবার প্রতি আমি অনেক কৃতজ্ঞ।”
ঘরোয়া ক্রিকেটে নাহিদের সাফল্যের বড় কারণ অবশ্যই তার গতি। সঙ্গে উচ্চতার কারণে বাড়তি বাউন্সও পান দীর্ঘদেহী এই পেসার। আর গতিময় পেসারদের সবসময়ই থাকে চোটের শঙ্কা। সহজাত গতিময় বোলার হওয়ায় নাহিদের ক্ষেত্রে এই শঙ্কা হয়তো একটু বেশিই। সেটি ভালোভাবেই জানেন তিনি।
“গতিটা মূলত নিজের ফিটনেস ঠিক রাখার বিষয়। কতটা ভালোভাবে নিজের যত্ন নিতে পারছি, খাওয়া-দাওয়া, ঘুমের রুটিন ঠিক রাখতে পারছি কিনা, এসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে ফিটনেসের কাজগুলো যেমন জিম, রানিং আরও অন্যান্য ড্রিলগুলো সব নিয়মমতো করা। আমি চেষ্টা করি যেন ইনজুরিমুক্ত থাকা যায়।”
বছর দেড়েক আগে জাতীয় লিগে চমক দেখানোর পর ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাননি নাহিদ। এবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নামার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েও ভাবনায় তেমন বদল আসেনি তার। তবে সুযোগ পেলে দলের চাহিদা পূরণের জন্য নিজেকে তৈরি রাখার প্রত্যয় তার কণ্ঠে।
“ক্যারিয়ারের লক্ষ্য বা স্বপ্ন নিয়ে এখনই অনেক কিছু বলতে চাই না। আমি যতটা সম্ভব ফিট থাকতে চাই এবং যখন সুযোগ পাব, দলের চাহিদাটা যেন পূরণ করতে পারি। দল আমার কাছে যেটা আশা করে, সেটা যেন পুরোপুরি দিতে পারি। এমন যেন না হয়, আমার থেকে কিছু একটা চাওয়ার পর সেটা আমি করতে পারিনি। আমার কাছে দলের চাহিদা পূরণের চেষ্টা থাকবে সবসময়।”