নিজেকে বদলে ফেলা ইরফানের গল্প

প্রেসিডেন্ট’স কাপের ফাইনাল শেষে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে দুবার ডাক পেলেন ইরফান শুক্কুর। ফাইনালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে একবার, টুর্নামেন্টের সেরা ব্যাটসম্যান হয়ে আরেকবার। ট্রফি আর প্রতীকি চেক হাতে ড্রেসিং রুমে ফিরতে ফিরতে ইরফান ভাবেন, “যাক, বড় মঞ্চে তাহলে বড় কিছু করতে পেরেছি অবশেষে!”

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Oct 2020, 10:37 AM
Updated : 26 Oct 2020, 10:37 AM

‘অবশেষে’ শব্দটি এখন ২৭ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যানের সঙ্গে নানাভাবেই বসতে পারে। অবশেষে তিনি বড় পর্যায়ে দারুণ কিছু করতে পেরেছেন। অবশেষে তিনি গড়পড়তা ক্রিকেটারের তকমা ঝেড়ে পরের ধাপের পানে হাঁটতে শুরু করেছেন।

বড় মঞ্চ বলতে সাধারণত যা বোঝায়, তা অবশ্য ছিল না এই প্রেসিডেন্ট’স কাপ। আরও বড় উপলক্ষ ছিল গত বিপিএলের ফাইনাল, সেখানে ৩৫ বলে ৫২ রানের দারুণ ইনিংস ইরফান খেলেছিলেন। কিন্তু আন্দ্রে রাসেল, মোহাম্মদ নওয়াজদের ঝড়ো ব্যাটিং ও অলরাউন্ড পারফরম্যান্স আর দলের শিরোপা জয়ের আবহে অনেকটাই আড়ালে পড়ে সেই পারফরম্যান্স। এই প্রেসিডেন্ট’স কাপকেই তাই নিজের জন্য আরেকটি বড় সুযোগ হিসেবে নিয়েছিলেন তিনি।

ঘরোয়া ক্রিকেটের বড় প্রতিযোগিতা এটি নয়। তবে দেশের শীর্ষ সব ক্রিকেটারকে নিয়ে আয়োজিত টুর্নামেন্ট, লাইভ স্ট্রিমিং, বিসিবি কর্তাদের মনোযোগ আর করোনাভাইরাস বিরতির পর প্রথম আসর বলে সবার তুমুল আগ্রহ, সবকিছু মিলিয়েই এই টুর্নামেন্টে ভালো কিছু করতে চেয়েছিলেন ইরফান।

টুর্নামেন্ট শেষে বলা যায়, শুধু ভালো নয়, ইরফান করেছেন দুর্দান্ত! টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান স্কোরারের তালিকায় তার চেয়ে ৫ রান এগিয়ে মুশফিকুর রহিম (২১৯)। টুর্নামেন্টের সেরা ব্যাটসম্যান তবু ইরফানই।

মুশফিকের ব্যাটিং গড় যেখানে ৪৩.৮০, ইরফানের সেখানে ৭১.৩৩। স্ট্রাইক রেট মুশফিকের ৬৮.০১, ইরফানের ৮৮.০৬। তিনি আরও এগিয়ে গেছেন মূলত নিয়মিত ৭ নম্বরে নেমে দলের ও পরিস্থিতির দাবি দারুণভাবে মিটিয়ে। দল বিপর্যয়ে পড়েছে, ইরফান উদ্ধার করেছেন। দলের দ্রুত রান প্রয়োজন, ইরফান ঝড় তুলেছেন।

ফাইনালে দলের চরম বিপর্যয়ের মধ্যে ৭৭ বলে ৭৫ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে ড্রেসিং রুমে ফেরার পর তার দল শান্ত একাদশের কোচ ও বিসিবি এইচপি স্কোয়াডের কোচ টবি র‍্যাডফোর্ড পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেন, “চমৎকার খেলেছো, তোমাকে কেউ সঙ্গ দিতে পারলে দলের রান আরও বাড়ত।”

টিম হোটেল থেকে সোমবার সকালেই নিজের শহর চট্টগ্রামে ফিরে গেছেন ইরফান। দুই সপ্তাহের বেশি জৈব সুরক্ষা বলয়ে ছিলেন। তবে বদ্ধ জীবনে দমবন্ধ হয়নি তার একটুও। ২২ গজে যে উড়ছিলেন! বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথোপকথনে তার কণ্ঠে ফুটে উঠল সেই তৃপ্তি।

“অনেক ভালো লাগছে। বড় স্টেজে পারফর্ম করেছি। খুব করে চাইছিলাম এখানে ভালো কিছু করতে। অনেকদিন আমি ট্র্যাকের বাইরে ছিলাম, ইনজুরিও খুব ভুগিয়েছে। সবকিছুর পর এখানে ভালো কিছু করা খুব দরকার ছিল।”

চোট ও হতাশার অধ্যায়

২০০৯ সালে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যুব টেস্ট ও ওয়ানডে খেলেছেন ইরফান। এরপর ক্যারিয়ারে হোঁচট খেয়েছেন বারবার। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলে জায়গা হয়নি। ২০১০ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় চট্টগ্রাম বিভাগের হয়ে। এখানেও পারফরম্যান্স ছিল অধারাবাহিক।

ঘরোয়া ক্রিকেটে এটিই ছিল ইরফানের নিয়মিত চিত্র। ভালো ইনিংস কিছু মাঝেমধ্যে খেলেছেন বটে, কিন্তু কোনো সংস্করণেই খুব ধারাবাহিক হতে পারেননি কখনও। অসাধারণ কোনো মৌসুম তাই কাটেনি।

মাঝারি মানের পারফরম্যান্স অবশ্য করেছেন নিয়মিত। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২০১৪-১৫ মৌসুমে করেছিলেন ৪৮০ রান। পরের মৌসুমে ৩৮৬ রান, ক্যারিয়ারে ওই একবারই মৌসুমে ব্যাটিং গড় ছিল চল্লিশের ওপরে (৪২.৮৮)। পরের দুই মৌসুমে করেন ৪০৭ ও ৩৫৪ রান।

ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও মোটামুটি ভালো দুটি মৌসুম কাটে ওই সময়। ২০১৭ সালের লিগে পারটেক্সের হয়ে করেছিলেন ৪২৮ রান। পরের বছর মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে ৪৬৩।

বিসিবি হাই পারফরম্যান্স স্কোয়াডেও জায়গা হয়েছিল ওই সময়। টানা তিনবার ক্যাম্পে ছিলেন তিনি। নিজের খেলায় উন্নতি করতে অনেক খেটেছেন তখন। চোটের থাবাও ওই সময়টাতেই, জানালেন ইরফান।

“এইচপিতে অনেক বেশি কষ্ট করেছিলাম। অনেক চাপ ছিল। এতেই গ্রোয়েন ইনজুরিতে পড়ি। কিন্তু তখন ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট অতটা ভালো বুঝতাম না। ইনজুরি নিয়েই আরও খেটে গেছি। নিজের ওপর চাপ দিয়েছি। এতে ঝামেলা হয়েছে , ইনজুরি আরও বেড়ে গেছে। অনেকটা সময় মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে।”

ইনজুরির হতাশা ছিল, সঙ্গে ছিল নিজেকে নিয়ে আক্ষেপ। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে যাদের সঙ্গে খেলেছেন তাদের এগিয়ে যাওয়া দেখে মুষড়ে পড়তেন নিজের অবস্থানে।

“সৌম্য, বিজয় (এনামুল হক), সোহান (নুরুল হাসান), তাইজুলদের সঙ্গে খেলেছিলাম যুব দলে। ওরা যখন জাতীয় দলে ঢুকল, খারাপ লেগেছে তখন। ওদের জন্য খুশি হয়েছি, কিন্তু নিজেকে নিয়ে ভেতরে ভেতরে হতাশা পেয়ে বসেছিল। সব মিলিয়েই যেন আউট অব দা ট্র্যাক হয়ে গিয়েছিলাম।”

ট্র্যাকে ফেরা এবং উন্নতির লড়াই

সেই হতাশার অধ্যায় পেছনে ফেলার শুরু জাতীয় লিগের একটি ম্যাচের আগে। চট্টগ্রাম বিভাগের দুই জাতীয় তারকা তামিম ইকবাল ও মুমিনুল হক বিভাগীয় দলের সবাইকে বোঝালেন ফিটনেসের গুরুত্ব, প্রতিনিয়ত উন্নতি করা আর লড়াই করার তাড়না থাকা কতটা জরুরি। ইরফানের ভাবনার জগৎ বদলে গেল তখন থেকেই।

“তামিম ভাই আর সৌরভ ভাইয়ের (মুমিনুল হক) কথা ভেতরে গেঁথে গিয়েছিল। আমাদের চট্টগ্রামের ছেলেরা ফিটনেস সচেতন নয় বলে দুর্নাম আছে অনেক। আমি ভাবলাম, এটা দূর করতে হবে। উঠে পড়ে লাগলাম।”

“আরেকটা বড় ব্যাপার ছিল, মানসিকভাবে স্থির হওয়া। খুব বেশি ব্যাপার নিয়ে না ভাবা। নিজেকে বোঝালাম, আমার হাতে যা আছে, আমার যা কিছু করার আছে, এসব করে যাব। আর কিছু ভাবব না।”

এতে কাজ হতে থাকল। ফিটনেসে উন্নতি হলো। শটের পরিধি বাড়তে থাকল। এবারের প্রেসিডেন্ট’স কাপে তার ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল এটিই। উইকেটের চারপাশে দারুণ সব শট খেলেছেন। প্রথাগত শটের পাশাপাশি উদ্ভাবনী সব শট খেলেছেন। বোলারদের থিতুই হতে দেননি। সব ধরনের বলের জবাব তার ছিল।

ইরফান জানালেন, শটের পরিধি বাড়ানো নিয়ে কাজ করার ফসল মিলতে শুরু করেছে।

“শটের রেঞ্জ বাড়ানো নিয়ে অনেক কাজ করেছি গত এক-দেড় বছর ধরে। তবে শটগুলি খেলতে শুরু করেছি গত কয়েক মাসে। গত বছর এলিট প্লেয়ার্স স্কিল ক্যাম্প হয়েছিল, সেখানে আমাকে রাখা হয়েছিল। তখন বাবুল স্যার (বিসিবির কোচ মিজানুর রহমান) কিছু ড্রিল দেখিয়েছিলেন। ক্যাম্পে ১৫-১৬ দিন ড্রিলগুলি করেছি, পরেও নিজের মতো করে অনুশীলন চালিয়ে গেছি।”

“আমার মনে হয়েছে, ড্রিলগুলি করার পর আমার শেইপ বদলে গেছে, আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। বিশেষ করে হেড পজিশন অনেক ভালো হয়েছে শট খেলার সময়। আস্তে আস্তে এসব রপ্ত করেছি।”

শটের পরিধি কতটা বাড়ল, এটা দেখার জন্য এই প্রেসিডেন্ট’স কাপকেই উপযুক্ত মনে হয়েছিল তার। পরিকল্পনামতোই মেলে ধরেছেন নিজেকে।

“নতুন শট শেখার পর তো শুরুতেই ম্যাচে দেখানো যায় না। আর আত্মবিশ্বাসও থাকে না। আমি আস্তে আস্তে এগোতে চেয়েছি। এই টুর্নামেন্ট একটা ভালো সুযোগ ছিল, চাপ খুব বেশি ছিল না। আমি চেষ্টা করেছি সব কাজে লাগাতে।”

এই টুর্নামেন্টে শটের পরিধির পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ছিল তার হাতের জোর। আগের চেয়ে অনেক বেশি ‘পাওয়ারফুল’ শট খেলতে দেখা গেছে তাকে। সেটি তার বিনিয়োগের ফসল, বললেন ইরফান।

“স্ট্রেংথ বাড়ানোর কাজ করেছি অনেক। লকডাউন বেশ কাজে লাগিয়েছি আমি। যখন দেখলাম লকডাউন বেশ লম্বা হতে যাচ্ছে, তখন বাড়িতেই ছোটখাটো জিম করে ফেলেছি। ওয়েট লিফটিং, সাইক্লিং, এসব কিছু জিনিস…বলতে পারেন আমার বিনিয়োগ ছিল এসব। এখন তা কাজে দিচ্ছে। স্ট্রেংথ অনেক বেড়েছে আগের চেয়ে।”

তার ব্যাটিংয়ের ‘ইন্টেন্ট’ ও ইতিবাচক মানসিকতা এই টুর্নামেন্টে ছিল চোখে পড়ার মতো। ইরফারের ধারণা, মানসিক স্থিরতার ছাপও পড়েছে তার ব্যাটিংয়ে।

“আগেই বলেছি, মানসিকভাবে আমি এখন অনেক স্থির। স্রেফ ছোট ছোট লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি। এজন্যই হয়তো সবকিছু ভালো হচ্ছে।”

“এই টুর্নামেন্টে আমাকে খেলতে হয়েছে ৭ নম্বরে, কাজটা খুব কঠিন। এই পজিশনে ব্যাট করলে নিজেকে নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই। আমি ঠিক করেছিলাম, শতভাগ দলের জন্য খেলব। যে পরিস্থিতিতে দলের যা দরকার, সেটিই করব। উইকেটে স্রেফ ওই টার্গেট নিয়েই গেছি। নিজেরটা একদমই ভাবিনি। দলের কথা ভেবে খেলেই নিজের কাজ হয়ে গেছে।”

ভবিষ্যতের ছবি

এই টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্সে ইরফানের প্রশংসা করেছেন জাতীয় ক্রিকেটারদের অনেকেই। জাতীয় দলের কোচ রাসেল ডমিঙ্গো ও বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের কণ্ঠেও আলাদা করে শোনা গেছে তার কথা। সামনে তাই আরও বড় সুযোগের আশা ইরফান করতেই পারেন।

তবে তিনি সেই প্রসঙ্গে যেতেই নারাজ! ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই তার ঝটপট উত্তর, “জাতীয় দলের কথা বলবেন? ভাবছিই না আসলে। আগে অনেক ভাবতাম এসব। এখন একটুও ভাবি না। ছোট ছোট পদক্ষেপে এগোতে চাই। কয়েকটা দিন বিশ্রাম নিয়ে আবার ট্রেনিং শুরু করব। সামনে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট হবে, ভালো কিছু করার চেষ্টা করব। ভবিষ্যৎ ভাবনা আপাতত এটুকুই।”

স্বপ্নের সীমানায় যে জাতীয় দল নেই, তা নয় অবশ্যই। তবে অতটা দূরে আপাতত তাকাতেই চান না ইরফান।

“জাতীয় দলের স্বপ্ন সবার ভেতরেই থাকে। আমারও আছে। তবে যেটা বললাম, ভাবনায় বদল এনেছি। কারণ বেশি ভাবলে চাপ হয়ে যায়। আগে আক্ষেপ লাগত, এখন লাগে না। আমি শুধু জানি, পরিশ্রম করতে হবে এবং প্রক্রিয়া ঠিক রাখতে হবে।”

“এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে এটা অন্তত শিখেছি, পরিশ্রম করে গেলে ও প্রক্রিয়া ঠিক থাকলে এগিয়ে যাব। এটুকুই ঠিক রাখতে চাই। বড় কিছুর ভাবনায় পথ হারাতে চাই না।”