যে পথ ধরে সাফল্যের শিখরে বাংলাদেশের যুবারা

বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের মূল শক্তি ব্যাটিং, বোলিং নাকি ফিল্ডিং? উত্তরটা চমকে দেওয়ার মতোই। এর কোনোটিই নয়। সতীর্থদের ওপর আস্থা, নিজের আগে দলকে রাখার সংস্কৃতি, ব্যক্তিগত লক্ষ্য স্থির না করে দলীয় লক্ষ্যে অবিচল থাকা-এগুলোই বাংলাদেশকে জিতিয়েছে যুব বিশ্বকাপ।

অনীক মিশকাতঅনীক মিশকাতবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Feb 2020, 06:18 PM
Updated : 10 Feb 2020, 06:19 PM

যুবাদের কথাগুলো স্রেফ কথার কথা নয়। কাজেই মিলেছে প্রমাণ। ফাইনালে সর্বোচ্চ রান যাশাসবি জয়সাওয়ালের, সর্বোচ্চ উইকেট রবি বিষ্ণুইয়ের। বল-ব্যাটে সেরা দুই পারফরমার ভারতের। কিন্তু শিরোপা জিতে নিল বাংলাদেশ। যেভাবে ফাইনাল জিতেছে, টুর্নামেন্ট জুড়ে সেভাবেই জেতার কথা ভেবেছে তারা। সম্মিলিত চেষ্টায়।

তিলে তিলে চার বছরে গড়ে উঠেছে এই মানসিকতা। বাংলাদেশের হৃদয় ভাঙার এক গল্পের পর এর শুরু। দেশের মাটিতে ২০১৬ বিশ্বকাপের যুব দলটি নিয়ে অনেক আশা ছিল। তরতর করে সেমি-ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিল মেহেদী হাসান মিরাজ-নাজমুল হাসান শান্তদের দল। এরপরই স্বপ্ন ভঙ্গ। ঘরের মাঠে আগে যাদের বলে-কয়ে হারাতো, সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেমি-ফাইনালে হেরে যায় বাংলাদেশ।

ওই হারের পর থেকে অনূর্ধ্ব-১৯ দল নিয়ে পাল্টায় বিসিবির ভাবনা। গত আসরের দলটির ব্যর্থতার পর আরও দৃঢ় হয় নতুন ভাবে এগোনোর সংকল্প। ২০১৮ সালের অনূর্ধ্ব-১৭ দলটিতে খুব একটা পরিবর্তন না এনে তৈরি করা হয় ২০ সদস্যের অনূর্ধ্ব-১৯ দল। মাঝে মধ্যে কিছু যোগ-বিয়োগ হলেও মূল দলটা প্রায় একই রয়ে যায়। সময়ে সময়ে বিকল্প খেলোয়াড়দের দেওয়া হতো নিজেকে প্রস্তুত রাখার সুযোগ।

ছবি: আইসিসি

অস্ট্রেলিয়ায় থিতু শ্রীলঙ্কান কোচ নাভিদ নওয়াজকে আনা হয় যুব দলের কোচ করে। পেসাররা কঠোর পরিশ্রম করেন আরেক লঙ্কান কোচ চাম্পাকা রামানায়েকের অধীনে। যার অধীনে আরও শাণিত হয়ে উঠেছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা, রুবেল হোসেনরা। ইংলিশ ট্রেনার রিচার্ড স্টয়নারের অধীনে ক্রিকেটাররা হয়ে ওঠেন আরও ফিট। পাল্লা দিতে পারেন যে কোনো অ্যাথলেটের সঙ্গে। ফুটবলার কিংবা অ্যাথলেটরা যে মানের ফিটনেস অনুশীলন করেন, আকবর-হৃদয়রা করতেন সেই ধরনের অনুশীলন।

বিশ্বকাপের আগে বগুড়ায় তিন সপ্তাহের একটি নিবিড় প্রস্তুতি ক্যাম্প করে বাংলাদেশ। প্রস্তুতি পর্বের একটা অংশে সিরিজ খেলে হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের বিপক্ষে। যে দলে ছিলেন জাতীয় দলের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়। 

বিশ্বকাপে নজর কেড়েছে বাংলাদেশের দুর্দান্ত ফিল্ডিং। আড়াল দিতে হবে এমন কোনো ফিল্ডার নেই দলে। বাংলাদেশের পেসারদের ফিল্ডিং সাধারণত ভালো হয় না। কিন্তু এখানে চিত্রটা ভিন্ন। শরিফুল ইসলাম, তানজিদ হাসানরাও ফিল্ডিংয়ে দারুণ। ফাইনালে দুটি দারুণ ক্যাচ নেন শরিফুল, করেন একটি রান আউট।   

ফাইনালে হৃদয় জেতে বাংলাদেশ, শিরোপা জেতে প্রতিপক্ষ-ক্লিশে শোনালেও এটাই যেন ছিল বাস্তবতা। শেষ বলে গিয়ে বেশ কয়েকটি ফাইনালে হারের তেতো স্মৃতি আছে বাংলাদেশের। সিনিয়রদের দল তো বটেই, ভারতের বিপক্ষে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে জেতার মতো অবস্থানে থেকে হারের স্মৃতি আছে যুবাদেরও।

অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের সেই ফাইনাল থেকে শিক্ষা নিয়েছে বাংলাদেশ। নিজেদের পরিণত করেছে সব পরিস্থিতির জন্য, সব কন্ডিশনের জন্য। দুই বিশ্বকাপের মাঝে ৩৩ ম্যাচ খেলে অভিজ্ঞতায় পূর্ণ করেছে নিজেদের। ওপেনার প্রান্তিক নওরোজ জানান, এতো ম্যাচ খেলার কারণেই যে কোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা আত্মবিশ্বাসী।

“অভিজ্ঞতার জন্য এটা হয়েছে। আমরা অনেক ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি। প্রতিটা ম্যাচ ছিল আমাদের জন্য শিক্ষার একটা জায়গা। যেন আমরা পরীক্ষায় বসেছিলাম, প্রতিটা ম্যাচ ছিল একটা নতুন প্রশ্ন। কোনো দিন দ্রুত উইকেট হারিয়েছি, কোনো দিন ভালো শুরু পেয়েছি।”

ছবি: আইসিসি

“আমরা সবাই জানি, দলের সবারই একটা ভূমিকা আছে। কেউ তারকা হওয়ার চেষ্টা করেনি। সবচেয়ে বড় শক্তি, সতীর্থদের ওপর আস্থা। কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় না। যে খারাপ করে তাকে দোষারোপ না করে যে ভালো করে তার প্রশংসা করা হয়। বিশ্বকাপে যা করেছি সেটা একদিনে হয়নি, মাঠ ও মাঠের বাইরে দুই বছরের পরিশ্রমে হয়েছে। আর নিজেদের ওপর আস্থা। সবাই জানে, প্রয়োজনের সময় কেউ না কেউ ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে।”

বিশ্বকাপের আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় একটা দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলে ভারত। দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউ জিল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ের সঙ্গে খেলে একটি চার দেশীয় সিরিজ। বিশ্বকাপ জয়ের পথে এই চার দলকেই হারিয়েছে বাংলাদেশ!

দক্ষিণ আফ্রিকা সফর আর ব্যর্থতা যেন যুগলবন্দী বাংলাদেশের জন্য। কঠিনতম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার আগে প্রস্তুতির ঘাটতির শঙ্কা ছিল। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে যে দক্ষিণ আফ্রিকায় কোনো সিরিজ আয়োজন করতে পারেনি বিসিবি। প্রস্তুতির পূর্ণতা দিতে এক মাস আগে যুবাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় পচেফস্ট্রুমে। নিজেদের উদ্যোগে খেলে চারটি প্রস্তুতি ম্যাচ। দক্ষিণ আফ্রিকার কন্ডিশন ও পিচের বাড়তি বাউন্সের সঙ্গে মানিয়ে নেয় নিজেদের।

এরপরও পথ চলার শুরুটা ভালো ছিল না। প্রস্তুতি ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে কেবল ১১২ রানে গুটিয়ে গিয়ে হারতে হয়েছিল। দ্রুত নিজেদের সামলে নিয়ে মূল টুর্নামেন্টে উজ্জ্বীবিত ক্রিকেট খেলে তানজিম হাসান-রকিবুল হাসানরা।

দুটি ম্যাচ খেলার পরেই বড় একটা ধাক্কা খায় বাংলাদেশ। চোটের জন্য ছিটকে যান পেস বোলিং অলরাউন্ডার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী। তার অনুপস্থিতিতে দুই ম্যাচে দারুণ বোলিং করেন হাসান মুরাদ। ফাইনালে বাঁহাতি এই স্পিনারের জায়গায় খেলতে নেমে বোলিংয়ে আলো ছড়ান অভিষেক দাস।   

ফাইনালে ডাকওয়ার্থ ও লুইস পদ্ধতিতে ৩ উইকেটে জিতে বাংলাদেশ সত্যি করেছে বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন। দলের বেশিরভাগ সদস্যের যুব ক্রিকেটের পথ চলা এখানেই শেষ। সামনে এখন সিনিয়র ক্রিকেটে নিজের ছাপ ফেলার পালা। অধিনায়ক আকবর চান, লড়াকু মানসিকতা যেন টিকে থাকে সবার। 

“আমাদের ভবিষ্যতের ক্রিকেটের জন্য এটা কেবলই শুরু। আমরা যখন সিনিয়র দলে যাব তখন আমাদের মোমেন্টাম ও ক্ষুধা ধরে রাখতে হবে…দেড় বছর আগে যখন যাত্রা শুরু করি, আমাদের একটা স্বপ্ন ছিল। ঠিক স্বপ্ন না, একটা লক্ষ্য ছিল। এই শিরোপা জেতা আমাদের জন্য একটা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো ব্যাপার।”

আকবরদের শিরোপা জয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জেনে গেল বৈশ্বিক শিরোপা জেতার ফর্মুলা। এই টেমপ্লেট ধরে ভবিষ্যতের যুব দলগুলোকে চালানোর কথা জানালেন বিসিবি সভাপতি। ইতিহাস বলছে, একেকটা যুব দলের কম খেলোয়াড়ই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেন। এই দলের কেউ যেন হারিয়ে না যায়, সে জন্য উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন নাজমুল হাসান।

আকবরদের সামনে এখন কঠিন পথ। সিনিয়র ক্রিকেটের জন্য নিজেদের তৈরির চ্যালেঞ্জ। এমন এক জাতীয় দলের জন্য তৈরি হতে হবে যারা সবশেষ তিনটি সফরে পায়নি কোনো প্রস্তুতি ম্যাচ। সফরের আগের দিন যারা জানতে পারে, খেলতে হবে দিবা-রাত্রির টেস্ট!