পচেফস্ট্রুমে বাংলাদেশের ভুলে ভরা ম্যাচ

পচেফস্ট্রুম যেন ছিল প্রথম টেস্টের দুই দলেরই ঘরের মাঠ। সেই ২০০২ সালে এই ভেন্যুর অভিষেক টেস্টে মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকা। পনের বছর আবার সেই মাঠে টেস্ট ক্রিকেট ফেরার ম্যাচে খেলেছে দুই দল। স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে উইকেট বেশি সহায়ক ছিল মুশফিকুর রহিমের দলের জন্য। ভুলে ভরা এক ম্যাচ খেলে হেলায় সেই সুযোগ হারিয়েছেন তারা।

অনীক মিশকাতঅনীক মিশকাতপচেফস্ট্রুম থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Oct 2017, 10:02 AM
Updated : 3 Oct 2017, 10:02 AM

ম্যাচ শুরুর আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে উইকেট সম্পর্কে মুশফিক বলেছিলেন, ব্যাটিং সহায়ক উইকেট, তৃতীয় দিন থেকে সহায়তা পেতে পারেন স্পিনাররা। সেনওয়েস পার্কের উইকেট অনেকটাই পড়তে পেরেছিলেন বাংলাদেশের অধিনায়ক।

সোমবার প্রথম টেস্ট শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক ফাফ দু প্লেসি বলেন, উইকেট ছিল ফ্ল্যাট, বাউন্স ও গতি ছিল মন্থর। তৃতীয় দিনের শেষ বেলা থেকে সহায়তা পেয়েছেন স্পিনাররা, ঠিক যেমনটা হবে বলে গ্রাউন্ডসম্যানরা বলেছিলেন।

গ্রাউন্ডসম্যানের কথায় আস্থা রেখে পরিকল্পনা সাজিয়েছেন স্বাগতিক অধিনায়ক। চোখের দেখার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেননি মুশফিক। ভেবেছিলেন দেখতে যেমনই হোক, উইকেটে পেসারদের জন্য কিছু থাকবে। আর কিছু থাকলে সেটা থাকবে শুরুতেই। তাই টস জিতে নিলেন ফিল্ডিং, করলেন ম্যাচের সবচেয়ে বড় ভুল।

প্রথম টেস্টের পাঁচ দিনই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন, সমালোচনা তাড়িয়ে বেরিয়েছে বাংলাদেশ দলকে। ম্যাচের শেষে সংবাদ পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানেও প্রথম প্রশ্ন ছিল সেটাই। আগের চার দিন যারা সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন তাদের কেউই স্বীকার করেননি সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। তাদের দাবি, উইকেট চিনতে ভুল করেছিলেন তারা। দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটে আরও বাউন্স, গতি আশা করেছিলেন তারা। এতটা ফ্ল্যাট উইকেট তাদের কল্পনাতেও ছিল না। 

দেখার বাকি ছিল টেস্ট শেষে মুশফিক কি বলেন। শোচনীয় পরাজয়ের পরও অধিনায়ক নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অটল। ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে এত প্রশ্ন থাকার দায় দিলেন নিজেদের বাজে বোলিং-ব্যাটিংকে।

মুশফিকের ভাষায় প্রথম টেস্টে ব্যাটিং-বোলিংয়ের বাজে প্রদর্শনী দেখিয়েছেন তারা। বোলাররা পারেননি লম্বা সময়ের জন্য সঠিক লাইন লেংথে বল করে যেতে। ব্যাটসম্যানরা পারেননি দায়িত্ব নিয়ে খেলতে।

মুশফিকের নেতৃত্বও ছিল অনুজ্জ্বল। প্রথম দিন স্ট্রাইক বোলার শফিউল ইসলামকে প্রথম দুটি স্পেলে বল করিয়েছেন মাত্র দুই ওভার করে। ষষ্ঠ ওভারে এনেছেন স্পিন। প্রথম ১১ ওভারের মধ্যে ব্যবহার করেছেন চার জন বোলার। টেস্ট নয়, যেন অধিনায়কের মাথায় ঘুরছিল টি-টোয়েন্টি।

অধিনায়কের দ্রুত ধৈর্য হারানোর মাশুল দিয়েছে দল। তিন পেসার মুস্তাফিজুর রহমান, শফিউল ও তাসকিন আহমেদের চেয়ে অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজের ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিলেন অধিনায়ক।

প্রথম দিন সবচেয়ে বেশি ৩৬ ওভার বল করে উইকেটশূন্য থাকেন অফ স্পিনার মিরাজ। তিন পেসার মিলে করেন ৪৬ ওভার। উইকেটে যে আর্দ্রতার আশায় ফিল্ডিং নিয়েছিলেন অধিনায়ক সেই আর্দ্রতা আসলে ছিলই না। ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে টস হেরেও ব্যাটিং পাওয়ার সুবিধা নিয়ে রানের পাহাড়ে অতিথিদের চাপা দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা।

ব্যাটসম্যানরা একটু থিতু হয়ে গেলেই সীমানায় ফিল্ডার বাড়িয়েছেন অধিনায়ক। দ্বিতীয় ইনিংস উদ্বোধন করিয়েছেন অফ স্পিনার মিরাজকে দিয়ে। ম্যাচে সবচেয়ে বেশি বেশ বল করেও উইকেটশূন্য ছিলেন তরুণ এই অফ স্পিনার।   

ব্যাটিংয়ে প্রথম ইনিংসে ছিল আশার ইঙ্গিত। ফিফটি এসেছিল মুমিনুল হক, মাহমুদউল্লাহর ব্যাট থেকে। রান পেয়েছিলেন তামিম ইকবাল, মুশফিক। কিন্তু কেউই বড় ইনিংস খেলতে পারেননি। টানা চারটা জুটি পেয়েছে পঞ্চাশ ছোঁয়া রান কিন্তু ৭০ এর ঘর পর্যন্তও যেতে পারেনি কোনোটা।

থিতু হয়েও ব্যাটসম্যানদের বড় ইনিংস খেলতে না পারা পুড়িয়েছে মুমিনুল, মুশফিকদের। তারপরও প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনশ ছাড়ানো স্কোর পাওয়ায় একটু খুশিই ছিলেন অধিনায়ক। সেটা পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে দ্বিতীয় ইনিংসের ভীষণ বাজে ব্যাটিংয়ে।

আগের ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকায় সর্বোচ্চ রানের ইনিংস গড়া দলটি দ্বিতীয় ইনিংসে ডুবেছে দেশটিতে নিজেদের সর্বনিম্ন রানে অলআউটের লজ্জায়। মাত্র ৩২.৪ ওভার খেলে গুটিয়ে গেছে ৯০ রানে। ১০ বছরের মধ্যে এটাই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের একশ রানের নিচে গুটিয়ে যাওয়া।

৪১ রানে শেষ ৮ উইকেট পতনের কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না মুশফিক। অধিনায়ক নিজেও ছিলেন আসা-যাওয়ার মিছিলে। বাঁধ দিতে পারেননি তিনিও, বুক চিতিয়ে লড়াই করার মানসিকতা ছিল না তার কোনো সতীর্থের মাঝে।

উইকেট আনপ্লেয়েবল ছিল না। আনেপ্লেয়েবল বলেও কেউ আউট হননি। স্রেফ লড়াই করার জেদ, স্পৃহা ছিল না কারোর। একজন ব্যাটসম্যানও উইকেটে পড়ে থেকে খেলার চেষ্টা করেননি। কেউ ছাড়ার বল মেরে আউট হয়েছেন, কেউ মারার বল ছেড়ে। কেউবা পারেননি স্টাম্পের বল খেলতে। দুই ইনিংসে অনেকেরই শট সিলেকশন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

শেষ দিন এক সেশনও টিকেনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস। অধিনায়ক বুঝতে পেরেছেন, এমন ক্রিকেট খেললে এত পরিশ্রমে পাওয়া শ্রদ্ধা ভেসে যাবে এই সফরেই। সতীর্থদের দিয়েছেন জেগে উঠার ডাক। ব্লুমফন্টেইনে ঘুরে দাঁড়াতে চান। ক্রিকেট বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চান, দেশের বাইরেও ভালো খেলার সামর্থ্য তার দলের আছে। তার জন্য ভুলগুলো শোধরে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই তাদের।