আগে দুই দফায় অতিথি ধারাভাষ্যকার হিসেবে ছোট্ট অভিজ্ঞতার পর এবার বাংলাদেশ দলের ভারত সফরে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি সিরিজের পুরোটায় ধারাভাষ্য দেবেন তামিম ইকবাল, নতুন ভূমিকায় তিনি রোমাঞ্চিত ও নার্ভাস।
Published : 18 Sep 2024, 10:07 AM
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তামিম ইকবালকে দেখা যায়নি গত প্রায় দেড় বছরে, কিন্তু এবারের ভারত সফরে তিনি আছেন। তবে সেটা ক্রিকেটার হিসেবে নয়, নতুন পরিচয়ে। ভারত-বাংলাদেশ সিরিজের দুটি টেস্ট ও তিনটি টি-টোয়েন্টিতে ধারাভাষ্য দেবেন দেশের সফলতম ব্যাটসম্যান। ২০২২ বিপিএল ও গত বছর মিরপুরে বাংলাদেশ-নিউ জিল্যান্ড টেস্টে অতিথি ধারাভাষ্যকার হিসেবে কিছুটা সময় দেখা গেছে তাকে। তবে পেশাদারভাবে ও গোটা সিরিজে ধারাভাষ্য দেবেন তিনি এবারই প্রথম।
প্রথম টেস্টের ভেন্যু চেন্নাইয়ে পৌঁছে গেছেন তিনি মঙ্গলবার। সেখান থেকেই রাতে ফোনালাপে তিনি শোনালেন তার নতুন শুরুর রোমাঞ্চ, নাভার্সনেস, ধারাভাষ্য নিয়ে তার সামগ্রিক ভাবনাসহ অনেক কথা।
সবশেষ ক্রিকেট সফর কবে ছিল, মনে আছে?
তামিম ইকবাল: সবশেষ ছিল সম্ভবত গত বছরের মে মাসে, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ইংল্যান্ডে। একটু অদ্ভুত লাগছে… এমনিতে তো ক্রিকেটের সফরে সবসময় গোটা দল থাকে, সবাই থাকে। এবার একার সফর… অন্যরকম লাগছে।
ক্রিকেটের সফর হলেও ভূমিকা নতুন। কেমন লাগছে? রোমাঞ্চ নিশ্চয়ই আছে, নার্ভাসনেসও কি আছে?
তামিম: অবশ্যই কিছুটা নার্ভাস আছি… নাভার্স লাগছে…। খেলার সময়টায় ম্যাচের আগে নার্ভাস থাকতাম যে, খেলা কেমন হবে, রান করতে পারব কী পারব না, কোন বোলারকে কীভাবে সামলাব, দল ভালো করতে পারবে কি না। এখন হলো, কথা কীভাবে বলব, মাঠের মুহূর্তগুলোকে ঠিকঠাক তুলে ধরতে পারব কি না, বড় কোনো ভুল করে বসি কি না…।
এই সিরিজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর তাই অনলাইনে কোর্স করার সিদ্ধান্ত নেই। আজকে (মঙ্গলবার) চেন্নাইয়ে এসেও একটা ক্লাস করেছি রাতে।
একটা ব্যাপার হলো, ধারাভাষ্য ব্যাপারটা যতটা সহজ মনে হয়, তত সহজ নয়। তাৎক্ষণিক কথা বলার ব্যাপার তো আছেই, এছাড়াও প্রযুক্তিগত অনেক ব্যাপার আছে, মাইক্রোফোনের ব্যবহার, প্রডিউসারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ, এসবের সঙ্গে অভ্যস্ততার ব্যাপার আছে। আমি ধরে নিয়েছি, এসবে অভ্যস্ত হতে দুই-তিন সিরিজ অন্তত লাগবে।
যাদের সঙ্গে আমি ধারাভাষ্যকক্ষে থাকব, সুনিল গাভাস্কার, রাভি শাস্ত্রী, হার্শা ভোগলে, উনারা তো ধারাভাষ্যের কিংবদন্তি। আমাদের আতহার ভাই ২০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজটা করছেন। দিনেশ কার্তিক, মুরালি কার্তিকরাও এখন যথেষ্ট ভালো। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারব। যদি ভবিষ্যতে নিয়মিত ধারাভাষ্য দেই, তাহলে এসব আমার কাজে লাগবে।
এই সিরিজটাকে তাহলে কিভাবে দেখছেন আপনি?
তামিম: বেশ কিছুদিন আগে প্রস্তাবটা পাই বিসিসিআই থেকে। বেশ ভালো প্রস্তাব মনে হয়েছে। এই সময়টায় আমার অন্য কোনো কাজ নেই। ঘরোয়া ক্রিকেটের ব্যস্ততা নেই। এজন্যই তখন রাজি হয়েছি, করে দেখি কেমন লাগে। ধারাভাষ্য দেওয়ার একটা ইচ্ছে তো সবসময় ছিলই। ভবিষ্যতে এটাই করব কি না, তা জানি না। তবে সবকিছু মিলিয়ে এবার সবদিক থেকে মিলে গেছে বলে এই সিরিজটা করছি।
আগে বিপিএলে ও গত বছর নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে অতিথি ধারাভাষ্যকার হিসেবে একটু অভিজ্ঞতা আপনার হয়েছে। সেগুলোর সঙ্গে এবারের পার্থক্যটা আসলে কত বেশি?
তামিম: সেটা ছিল আসলে নেট প্র্যাকটিসের মতো। নেটে ১০ মিনিট প্র্যাকটিস করেছি তখন। এখন পুরো ম্যাচ খেলতে হবে।
তখন এত চিন্তাভাবনা ছিল না। মাঠে গিয়ে ঝটপট করে এসেছি। এবার যেহেতু পেশাদারভাবে করছি, অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে।
এই চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুতি কেমন আপনার?
তামিম: যেটা বললাম, অনলাইনে একটা বেশ ভালো কোর্স করছি। আজকেও (মঙ্গলবার) এখানে এসে এতক্ষণ ক্লাস করলাম। কথা বলার ধরন কেমন হতে পারে, ধারাভাষ্যকক্ষে অনেক ধরনের গ্যাজেট থাকে, সেগুলোর ব্যবহার কীভাবে হয়, আরও নানা যন্ত্রপাতির সঙ্গে অভ্যস্ততা, এই ধরনের বেসিক ব্যাপারে শেখায় কোর্সে। কালকের দিনটা (বুধবার) আমাকে ঠিক করতে হবে, আমি কোন ধরনের কথা বলতে চাই বা কী উপস্থাপন করতে চাই, এরকম নানা কিছু লিখে রাখতে হবে। ডায়েরি মেইনটেইন করতে হবে, যেটা আগে জীবনে কখনও করিনি।
ভবিষ্যতে যদি এটাকে পেশা হিসেবে নেই, তাহলে আরও অনেক কাজ করতে হবে। একটা পাবলিক পরীক্ষার আগে যেমন দেড়-দুই বছরের প্রস্তুতি লাগে, আমারও তেমন লাগবে। প্রতিদিন নতুন নতুন শব্দ শেখা, ভালো করে ডেলিভারি দেওয়া, তাৎক্ষণিক এমন কিছু বলা যা মানুষের মনে গেঁথে যাবে, এসব অনেক কিছুই শিখতে হবে।
ইংরেজি বলতে পারলেই ধারাভাষ্য দেওয়া যাবে, ব্যাপারটি তা নয়। কোন সময়ে কোনটি বলতে হবে, সবচেয়ে উপযুক্ত কথাটি বলা এবং লোকে যা দেখছে, সেটিই ভিন্নভাবে তুলে ধরতে হবে, অনেক কঠিন কাজ। আমি হয়তো ইংরেজিতে ভালোভাবে কথা বলছি। কিন্তু গোটা দিন বা পাঁচ দিন ধরে ধারাভাষ্য দিতে গেলে একই শব্দ বারবার বলা বা ভুল কোনো শব্দ কিংবা টার্ম ব্যবহার করা, কোনো টার্ম হয়তো বেশি ব্যবহার করে ফেলব, এসব হতে পারে প্রথম কয়েক সিরিজ বা শুরুর এক-দেড় বছর। যদি নিয়মিত ধারাভাষ্য দেই, তাহলে আস্তে আস্তে এভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।
বাংলাদেশের ধারাভাষ্যের সবচেয়ে পরিচিত মুখ আতহার আলি খানের সঙ্গে কথা হয়েছে এসব নিয়ে?
তামিম: নিয়মিতই হচ্ছে। আতহার ভাই গত ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ভয়েস অব বাংলাদেশ ক্রিকেট। উনার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক অনেক বছর ধরেই। যখন এই সিরিজটার জন্য চুক্তি করি, তখন থেকে অনেকবারই কথা বলেছি উনার সঙ্গে। অনেক সহায়তা করেছেন আমাকে। কালকে (বুধবার) উনি এখানে আসার পর আবার একসঙ্গে বসে আরও কিছু জানার চেষ্টা করব।
ভারাভাষ্যে একেকজনের একেকটা স্টাইল বা ঘরানা থাকে। রাভি শাস্ত্রি যেমন খুব উঁচু কণ্ঠের, ড্যানি মরিসন নাটকীয়, রিচি বেনো খুব ছোট্ট কথায় সবকিছু ফুটিয়ে তুলতেন দারুণভাবে, ইয়ান বিশপ ও ইয়ান স্মিথকে দেখা যায় মুহূর্তগুলোকে কথার খেলায় স্মরণীয় করে রাখতে, অনেকেই টেকনিক্যাল বিশ্লেষণে আলাদা করে তোলেন নিজেকে। আপনি কি শুরু থেকে আলাদা ঘরানা গড়ে তুলতে চান নাকি সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে চান?
তামিম: এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, ধারাভাষ্যকে পেশা হিসেবে নিচ্ছি কি না। যদি নিয়মিত ধারাভাষ্য দেই সামনে, তাহলে তো একটা নিজস্ব পরিচয় গড়ে তোলার চেষ্টা থাকবেই। অমুকে একটু, তমুকের একটু নিয়ে যদি তাদের মতো ধারাভাষ্য দেওয়ার চেষ্টা করি, তাহলে নিজে কিছু হতে পারব না।
ব্যক্তিগত একটা স্টাইল তো সবার এমনিতেই থাকে। আমি যদি ধারাভাষ্যে নিজের আলাদা কিছু আনতে পারি… এখানে আমার কথা বলার ধরন বা কী বলছি, সেসব গুরুত্বপূর্ণ নয়… তবে ভিন্ন কিছু যদি যোগ করতে পারি, সেটা হতে পারে ভেতরের কোনো কথা বা ভাবনা অথবা যে কোনো কিছু… আলাদা অ্যাঙ্গেল থেকে কিছু করতে পারলে হয়তো ধারাভাষ্যে ছাপ রাখতে পারব। মাঠে গেলাম, কিছু একটা বলে আবার চলে এলাম, এভাবে করলে নিজের অবস্থান গড়ে উঠবে না।
আতহার ভাই অনেক বছর ধরে নিজের একটা অবস্থান গড়েছেন। আমাকে কিন্তু উনার চেয়ে আলাদা কিছু করতে হবে। আমি শিখব উনার কাছ থেকে, কিন্তু করার চেষ্টা করব ভিন্নভাবে।
আপনার প্রিয় ধারাভাষ্যকার কে বা কারা?
তামিম: অনেককেই ভালো লাগে আলাদা আলাদা কারণে। নাসের হুসেইনকে খুব ভালো লাগে। তার কথা বলার অন্য একটা ধরন আছে। মার্ক নিকোলাস আমার প্রিয়দের একজন। ইয়ান বিশপকে তো অবশ্যই খুব পছন্দ করি। অ্যালান উইলকিন্সকেও ভালো লাগে। ছোট থেকে শুনছি, তার কণ্ঠ ভালো লাগে খুব।
আতহার ভাইকে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে এই কারণে যে, উনি যখন শুরু করেছেন, তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধারাভাষ্যকার তেমন কেউ পরিচিত ছিল না আমাদের। আমরা তখন জিততাম খুব কম। অনেক হাসাহাসি হতো আমাদের নিয়ে। অনেক সময় অপমান করে কিছু বলা হতো। আতহার ভাই সেখানে সবসময় লড়াই করেছেন এবং বাংলাদেশের ইতিবাচক দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। হয়তো খুব ছোট কিছু, তবু তিনি সেটাই বলার চেষ্টা করতেন। এজন্য তাকে সবসময় সম্মান করি।
ধারাভাষ্যে অনেক সময় অনেক কঠিন কিছু বলতে হয়, যা হয়তো ক্রিকেটারদের পছন্দ হয় না। বাংলাদেশ দলে এখনও আপনার বন্ধু, সতীর্থ, ছোট ভাইরা আছেন, আপনার ঘনিষ্ঠজন তারা। ধারাভাষ্যে আপনার অনেক কথা বা আপনি সঞ্চালনা করলে অনেক প্রশ্ন তাদের পছন্দ হবে না বা তারা বিরক্ত হবেন। সেটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
তামিম: এটা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আশা করি, ওরা সবাই ব্যাপারটিকে স্পোর্টিংলি নেবে এবং বুঝতে পারবে যে, আমি কেবল আমার কাজটাই করছি। পেশাদারভাবে কিছু করলে আমাকে তো সেই পেশার প্রতি সৎ থাকতে হবে। কার দুর্বলতা কোথায়, শক্তির জায়গা কোথায়, কোন দিকটা ভালো বা খারাপ, সবই তুলে ধরতে হবে। কেউ বাজে শট খেললে বা খারাপ স্পেল করলে সেটিকে আমি ভালো বলতে পারব না।
আমি যখন খেলেছি, অনেক সময় আমাকে নিয়ে ধারাভাষ্যকারদের অনেক কথা আমার নিজেরও ভালো লাগত না। বিশেষ করে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে। ওই অনুভূতিটা তাই জানি। কিন্তু পরে যখন অনেক খেলেছি, অভিজ্ঞতা হয়েছে, তখন বুঝতে পেরেছি যে, এটাই তাদের কাজ।
একটা কথা দিতে পারি, আমি কখনও কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করব না। সবই হবে পেশাদারভাবে। ভুল কিছু দেখলে অবশ্যই তা তুলে ধরতে হবে। সেটা না করলে তো নিজের কাজের প্রতি সুবিচার করছি না। আশা করি, আমার বন্ধুরা, কাছের মানুষ যারা ক্রিকেটার ও সবাই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।
ধারাভাষ্যের বাইরে একটা প্রশ্ন, যেটা নিয়ে কৌতূহল অনেকের কাছে। আপনার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ, বিসিবি পরিচালক হওয়ার সম্ভাবনা, এসব নিয়ে অনেক অলোচনা চলছে সংবাদমাধ্যমে ও সামাজিক মাধ্যমে। এই মুহূর্তে আপনি কতটুকু বলতে পারেন এসব নিয়ে?
তামিম: জানি, অনেক আলোচনা চলছে। যারা সত্যিকার অর্থেই জানতে চান, তাদের প্রতি একটা অনুরোধ করব, আমার মুখ থেকে কিছু না শোনা পর্যন্ত দয়া করে কোনো ধারণা তৈরি করে নেবেন না। এটা সত্যি, অনেক কিছুই হচ্ছে। তবে আমার হয়ে অন্যরা বলছে বা ধারণা তৈরি করে নিচ্ছে। বলার মতো অবস্থা সত্যিই তৈরি হলে আমি নিজেই বলব। দয়া করে সেই সময়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।