টানা দুইবার বরিশালকে বিপিএলের ট্রফি জেতালেন তামিম ইকবাল, এই ফ্র্যাঞ্চাইজির দল গোছানো, বিদেশি ক্রিকেটার আনা, ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা, পরিকল্পনা ও পরিচালনা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই করেন তিনি।
Published : 08 Feb 2025, 09:50 AM
“নিজ এলাকাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলেন… চট্টগ্রাম কখনও পারেনি চ্যাম্পিয়ন হতে…!”, প্রশ্নের এটুকু শুনেই তামিম ইকবাল হাসতে হাসতে বললেন, “চিটাগং নেয় না তো আমাকে… আমি কী করব বলেন!” তামিমের এই কথায় আর হাসিতে মূলত ছিল রসিকতা। হাসি শেষে পরক্ষণেই চিটাগং কিংসের প্রশংসা করে অনেক কথা বললেন তিনি।
এই সংবাদ সম্মেলনে একটু আগে তার কাছে আরেকটি প্রশ্ন ছিল, “আপনি কি এখন নিজেকে সম্মানসূচক বরিশাইল্যা দাবি করতে পারেন?”এই প্রশ্ন শুনেও হেসেছিলেন তামিম। এই হাসিতে মিশে ছিল প্রশ্রয় আর সম্মতি। যেটির মানে, তাকে ‘বরিশাইল্যা’ বলতেই পারেন!
এমনিতে তিনি চট্টগ্রামের বিখ্যাত ক্রিকেট পরিবারের সন্তান। চট্টগ্রামের ছেলে হিসেবে তার গর্বের জায়গাটাও আছে নিজ শহর নিয়ে। তবে বিপিএল তাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে কিংবা গেছে, ‘বরিশাইল্যা’ বললেও তার আপত্তির কারণ নেই, বরং মজা পাবেন কিংবা তার ভালো লাগবে।
আইপিএলে এই ব্যাপারটি তো অন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। ঝাড়খান্ডের সন্তান মাহেন্দ্র সিং ধোনি চেন্নাই সুপার কিংসে বছরের পর বছর খেলে এবং সাফল্য এনে দিয়ে হয়ে উঠেছেন এই দলের প্রতীক, এই শহরের প্রিয় সন্তান। সেখানে তার তুমুল জনপ্রিয়তা। দিল্লির ভিরাট কোহলি হয়ে উঠেছেন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর প্রতিশব্দ।
আইপিএলের এসব উদাহরণের সঙ্গে বিপিএলকে মেলানো এখনও অবান্তর ও অসম্ভব। সেই বাস্তবতা, সেই পেশাদারিত্ব, ধারাবাহিকতা, বিশালত্ব, কিছুই নেই বিপিএলের। তবে ফরচুন বরিশালের হয়ে দুই মৌসুমে তামিম যা করলেন, যেভাবে মিশে গেছেন এই ফ্র্যাঞ্চাইজির মাঠের ভেতরে-বাইরে সবকিছুতে, তিনি তো ‘বরিশাইল্যা’ হয়েই উঠেছেন!
২০২০ বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি দিয়ে এই ফ্র্যাঞ্চাইজির পথচলা শুরু। তামিমের নেতৃত্বে সেবার এলিমিনেটর থেকে ছিটকে যায় দলটি। বিপিএলে তাদের প্রথম অংশগ্রহণ ২০২২ আসরে। সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে সেবার ফাইনালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের কাছে ১ রানে হেরে রানার্স আপ হয় তারা। পরের বছর সাকিবের নেতৃত্বেই বাদ পড়ে যায় এলিমিনেটর থেকে।
এই ফ্র্যাঞ্চাইজির ও বরিশালবাসীর শিরোপা তেষ্টা অবশেষে মেটে ২০২৪ আসরে। তামিমের অধিনায়কত্বে ফাইনালে তারা হারিয়ে দেয় টুর্নামেন্টের সফলতম দল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে। এবার সেই ট্রফি তারা ধরেও রাখল।
টানা দুটি শিরোপা জিতে তামিম বেশি খুশি এই ফ্র্যাঞ্চাইজি ও বরিশালের মানুষদের জন্য।
“বরিশালের জন্য এটা বিশাল ব্যাপার। আগের চার-পাঁচ বছরে বরিশাল সম্ভবত একবার ফাইনাল খেলেছে, যদি ভুল না করে থাকি। এরপর বরিশালের পারফরম্যান্স প্রত্যাশিত ছিল না। ঢাকা শহরে বরিশালের অনেক লোক থাকেন, বিশেষ করে মিরপুরে। টুর্নামেন্টজুড়ে আমরা কতটা সমর্থন পেয়েছি, দেখতেই পেয়েছেন। তাদের জন্য ট্রফি জিততে পারা দারুণ ব্যাপার।”
তামিম যেটি বললেন, বরিশালের বিশেষত্ব এখানেও। বিপিএলের গড়পড়তা মানের চেয়ে তা ওপরে। নিজ শহরের প্রতি আবেগের কারণে হোক বা দলের প্রতি ভালোবাসা কিংবা নানা কিছু মিলিয়ে, এই ফ্র্যাঞ্চাইজির একটা সমর্থকগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। খেলা মিরপুরে হোক বা সিলেটে অথবা চট্টগ্রামে, বরিশালের দর্শকে ভরা ছিল গ্যালারি। আগের মৌসুমগুলো থেকেই সেটা চোখে পড়ার মতো ছিল, এবার তা ভিন্ন উচ্চকায় পৌঁছে গেছে। বিপিএলের কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজিকে ঘিরে এতটা সমর্থন আর উন্মাদনা আগে চোখে পড়েনি।
সেই দলের টানা দুই বারের চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক তো তাদেরই আপনজন!
তামিম নিজেও এই ফ্র্যাঞ্চাইজিকে আপন করে নিয়েছেন। তিনি শুধু দলের অধিনায়ক আর ক্রিকেটারই নন, কোচ-ম্যানেজার-প্রধান নির্বাহী-পরিচলন কর্মকতা, প্রয়োজনমতো তিনি এই দলের সবকিছুই। দলের কর্ণধার মিজানুর রহমান এটা প্রকাশ্যেই বলেছেন নানা সময়ে।
টানা দুই ট্রফি জিতে তামিম নিজেও বললেন, এই সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা তিনি উপভোগই করছেন।
“বরিশাল ফ্র্যাঞ্চাইজিতে আমি যে দুই বছর খেললাম, তারা অসাধারণ ছিল। এই দলের কর্ণধারের কথাও বলতে হবে। উনার একটা ভালা গুণ হলো, ক্রিকেট নিয়ে আমার সঙ্গে কোনো ধরনের কথা বলেন না। কে খেলবে, কোন বিদেশি আসছে, কে আসছে না, এসব জানাটা তার অধিকার। কিন্তু তার কোনো আগ্রহ নেই এসবে। আমি যা করতে চাই, সব দায়িত্ব আমাকে দিয়ে রেখেছেন।”
“মুশফিককেও প্রচুর কৃতিত্ব দিতে হবে। কারণ, যেভাবে এই ফ্র্যাঞ্চাইজি কাজ করে, মাঠের বাইরের সবকিছু আমি দেখভাল করি। ক্রিকেটার আনা, তাদের পেমেন্ট সময়মতো হচ্ছে কি না, সবকিছুই। অবশ্যই সাব্বির ভাইয়ের (সাবেক ক্রিকেটার ও বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের সাবেক ম্যানেজার) মতো দারুণ একজন প্রধান নির্বাহীও আছেন আমাদের। আর মাঠের ভেতরের কাজগুলি মুশফিক করে এবং খুব ভালোভাবে করে।”
বরিশালের বড় বাজেটে দল গড়া নিয়ে নানারকম আলোচনার জবাবও দিলেন তামিম। পাশাপাশি বললেন, এই ফ্র্যাঞ্চাইজি যেন প্রাপ্য মূল্যায়ন পায় বিসিবির কাছে।
“আমি অনেককে বলতে শুনি যে, বরিশাল বড় বাজেটের দল। কিন্তু ‘এ’ ক্যাটাগরির ছয়জন ক্রিকেটারকে নেওয়ার জন্য এই ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রশংসাও তো করা উচিত। কারণ, অন্যদেরও সুযোগ ছিল নেওয়ার। তারা নেয়নি। আমরা নিয়েছি। আমাদের চেয়েও বড় ফ্র্যাঞ্চাইজি ছিল। কেউই তাদের নেয়নি। আমরা নিয়েছি দুটি কারণে। প্রথমত, তাদের ওপর আস্থা আছে, দ্বিতীয়ত তাদেরকে সম্মান দেখানোর জন্যও।”
“এই ফ্র্যাঞ্চাইজি ও এই ফ্র্যাঞ্চাইজির কর্ণধার, বিসিবির উচিত তাদেরকে সম্মানটুকু দেওয়া। কারণ, এই ধরনের দল, এই ধরনের স্বত্বাধিকারী বিপিএলের চেহারা বদলে দেবেন। এই ধরনের মানুষ যদি ক্রিকেটে থাকেন, শুধু ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে বলব না, যদি তারা ক্রিকেটের সঙ্গে থাকেন, বাংলাদেশের ক্রিকেট তাহলে ভালো দিকে এগোবে।”