এই টুর্নামেন্ট থেকে পাওয়া বিশ্বাস কাজে লাগিয়ে সামনের বিশ্বকাপগুলোয় আরও ভালো খেলার প্রত্যয় আফগান অধিনায়কের।
Published : 27 Jun 2024, 11:42 AM
জোনাথান ট্রট তাকিয়ে শূন্যে। আফগানিস্তান কোচের চোখেমুখে রাজ্যের হতাশা। রাশিদ খানের চেহারাটাও দেখা যাচ্ছে না। হতাশায় মুখ ঢেকেছেন তিনি হাত দিয়ে। এরকম দৃশ্যই ফুটে উঠল টিভি পর্দায়। বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালের মঞ্চে যদি এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে ব্যাটিং, দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দিনেই যদি সবচেয়ে কম রানে গুটিয়ে যায় দল, এমন প্রতিক্রিয়াই স্বাভাবিক।
তবে সেই হতাশা সাময়িক। আফগান ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় টুর্নামেন্ট তো স্রেফ সেমি-ফাইনালের ব্যর্থতায় আড়াল হতে পারে না। পেছন ফিরে তাকিয়ে তাই তৃপ্তির উপকরণ অনেক পেয়েছেন রাশিদ। আর পেয়েছেন ভবিষ্যতের পথচলার অনেক রসদ। আফগান অধিনায়ক প্রতয়ী কণ্ঠে শোনালেন, এবারের প্রাপ্তিকে সঙ্গী করে সামনের বিশ্বকাপগুলোয় আরও ভালো করবে তার দল।
প্রথমবার বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনাল খেলতে নেমে ভুলে যাওয়ার মতো অভিজ্ঞতা হয়েছে আফগানদের। ত্রিনিদাদে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মাত্র ৫৬ রানে গুটিয়ে গিয়ে তারা ম্যাচ হেরেছে ৯ উইকেটে।
এবারের আসরে প্রথম দুটি ম্যাচ এই মাঠেই খেলেছিল আফগানিস্তান। তবে সেমি-ফাইনালের আগে এখানে অনুশীলনের সুযোগ তারা পাননি। বাংলাদেশের বিপক্ষে সুপার এইটের ম্যাচের পর নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগও তাদের ছিল না ততটা। ম্যাচের পর সেন্ট ভিনসেন্ট থেকে ত্রিনিদাদে যেতে হয়েছে তাদের। ফ্লাইটে বিলম্বিত হয়েছে চার ঘণ্টা। ম্যাচের আগের দিন অনুশীলনের কোনো সুযোগই ছিল না।
কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারার সেই কথা তুলে ধরলেন রাশিদ। সঙ্গে মেনে নিলেন নিজেদের ব্যর্থতাও।
“দল হিসেবে আমাদের জন্য কঠিন এক রাত। এর চেয়ে একটু ভালো করা আমাদের উচিত ছিল। যেভাবে খেলতে চেয়েছিলাম, কন্ডিশনের কারণে সেভাবে খেলতে পারিনি। তবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটই এরকম। যে কোনো কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে মানসিকভাবে তৈরি থাকতে হয়।”
“তবে তারা যেভাবে বল করেছে, তা অসাধারণ। আমরা স্রেফ ভালো ব্যাট করতে পারিনি।”
ফাইনালে খেলার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে সেমি-ফাইনালে উঠতে পারাও তো বিশাল এক অর্জন। মাত্র ২০ বছর আগে এশিয়ার আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে খেলতে শুরু করেছে যে দেশ, ২০০৮ সালেও যারা ছিল আইসিসি ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড ডিভিশন ফাইভ-এ, যুদ্ধবিধ্বস্ত যে দেশ নিজেদের মাঠে খেলার সুযোগ পায় না, তারাই সেমি-ফাইনালে খেলল আইসিসির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিশ্বকাপে।
বিদায় বেলায় সেই তৃপ্তি রাশিদের সঙ্গী।
“আমরা অনেক উপভোগ করেছি। সত্যি বলতে, টুর্নামেন্ট শুরুর আগে যদি বলতেন যে, আমরা সেমি-ফাইনালে উঠব এবং সেরা দলগুলির একটি দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলব, তাহলে আমরা সবাই তা সাদরে গ্রহণ করতাম। সব মিলিয়ে টুর্নামেন্টজুড়ে চাপের সময়টায় আমরা নিজেদের যেভাবে সামলেছি, তাতে দারুণ খুশি আমরা। কঠিন পরিস্থিতিতেও ছেলো দারুণ সাড়া দিয়েছে। এটা আমার জন্য ছিল সন্তুষ্টির।”
“যেভাবে আমরা বড় দলগুলিকে হারিয়েছি এই টুর্নামেন্টে, আমাদের জন্য তা ছিল স্পেশাল। আমাদের জন্য এটা কেবলই শুরু। যে ধরনের আত্মবিশ্বাস ও ভরসা আমাদের দরকার ছিল, তা পেয়েছি। প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে পারলে এবং নিজেদের ওপর আস্থা রাখলে আমরা যে কোনো দলকে হারাতে পারি।”
যে কোনো দলকে হারাতে পারার বিশ্বাসটাকেই এই আসর থেকে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মানছেন রাশিদ। আগেও নানা সময়ে বড় দলকে তারা হারিয়েছে। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো জায়গায় নিউ জিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশকে হারিয়ে সেমি-ফাইনালে পৌঁছার পর তাদের আত্মবিশ্বাসও নতুন উচ্চতায় উঠে গেছে।
“সব মিলিয়ে আমাদের জন্য এটা ছিল দারুণ এক টুর্নামেন্ট। আমরা অনেক কিছু শিখেছি। পরেরবার যখন আমরা এরকম একটি টুর্নামেন্টে খেলব, বিশ্বাসটা আমাদের থাকবে এবং আশা করি আরও অনেক ভালো করব আমরা।”
“এই টুর্নামেন্ট থেকে শিক্ষাটা আমরা নিয়ে যাচ্ছি। আমরা এখন জানি যে, স্কিল আমাদের আছে। বিশ্বাসও আছে এখন। প্রতিভাও আছে। স্রেফ চাপের সময়টায় নিজেদের ভালোভাবে সামলানোর ব্যাপার। বড় বড় দল, কঠিন সব বোলারের সামনে খেলতে হলে কীভাবে সাড়া দেব। দল হিসেবে এসব শেখার ব্যাপার আমাদের জন্য।”
এবারের বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের পারফরম্যান্সের উল্লেখযোগ্য একটি ব্যাপার ছিল পেসারদের দারুণ পারফরম্যান্স। আফগান বোলিং বরাবরই স্পিন-নির্ভর। তাদের বোলিং আক্রমণের মূল চালিকাশক্তি রাশিদ খান, মুজিব-উর-রাহমান ও মোহাম্মদ নাবি। তবে এবার প্রথম ম্যাচের পর চোটের কারণে ছিটকে যান নাবি। পেসাররা জ্বলে ওঠেন প্রথম ম্যাচ থেকেই। ১৭ উইকেট নিয়ে এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি শিকারের রেকর্ড গড়েন ফাজালহাক ফারুকি। আরেক পেসার নাভিন-উল-হাকের প্রাপ্তি ১৩ উইকেট।
পেসারদের প্রশংসা তাই আলাদা করেই ফুটে উঠল আফগান অধিনায়কের কণ্ঠে।
“তারা যেভাবে নিজেদের মেলে ধরেছে টুর্নামেন্টজুড়ে, আমাদের সাফল্যের বড় কারণ তা। সিমাররা আমাদেরকে ভালো শুরু এনে দিয়েছে। টি-টোয়েন্টিকে সবসময়ই ভালো শুরু প্রয়োজন নতুন বলে। শুরুতে মুজিব চোট পেয়ে ছিটকে যাওয়ার পর আমরা একটু ভুগছিলাম। কিন্তু নাভিন ও ফাজাল দায়িত্ব নিয়েছে। এমনকি নাবিও নতুন বলে বল করেছে, যা ছিল বিশেষ কিছু। ওরা মাঝের সময়টায় আমাদের স্পিনারদের কাজ সহজ করে করে তুলেছে। তাদেরকে ধারাবাহিকভাবে ভালো করতে দেখা ছিল সন্তুষ্টির।”
এই আসরের সাফল্যকে সঙ্গী করে সামনের সময়টায় নিজেদের আরও শাণিত করতে চান রাশিদ। পরের বিশ্ব আসরে আরও ভালো কিছুর আশাবাদ তার কণ্ঠে।
“আরও অনেক কঠোর পরিশ্রম করতে হবে আমাদের। বিশেষ করে মিডল অর্ডারে এমন কাউকে আমাদের প্রয়োজন, আগ্রাসী হওয়ার পাশাপাশি খেলাটাকে গভীরে নিয়ে যাবে যে। টপ অর্ডারের ওপর সবসময় নির্ভর করা যাবে না। দল হিসেবে সবসময়ই শিখে যেতে হবে আমাদের। দারুণ কিছু ফল আমরা এই টুর্নামেন্টে পেয়েছি। তবে আরও পরিশ্রম করে আমরা বড় টুর্নামেন্টে ফিরে এসে আরও ভালো করব।”