জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় এ সঙ্কটের শুরু থেকে হালনাগাদ তথ্য নিয়ে নিয়মিত যে টালি প্রকাশ করে আসছে, বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাত ১১টা ২২ মিনিটে তাতে মৃত্যুর সংখ্যা ২০ লাখ ৯০৫ জনে পৌঁছায়।
এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ভারত, মেক্সিকো ও যুক্তরাজ্যে, যেখানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশের বসবাস।
বিশ্বজুড়ে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দ্রুত এগোচ্ছে ১০ কোটির দুঃখজনক মাইলফলকের দিকে। ইতোমধ্যে তা নয় কোটি ৩৪ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এর অর্ধেক রোগীই শনাক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রাজিল, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যে।
এর সবই সরকারি সংখ্যা। বিশ্বের অনেক দেশে এখনও করোনাভাইরাস পরীক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। ফলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর অনেক তথ্যই এ হিসাবের বাইরে থেকে গেছে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
সিয়াটলে ইউনিভঅর্সিটি অব ওয়াশিংটনের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশনের পরিচালক ক্রিস্টোফার মা তাদের গবেষণার বরাত দিয়ে বলেছেন, এমনও হতে পারে যে করোনাভাইরাসে প্রকৃত মৃত্যুর এক পঞ্চমাংশই হিসাবের খাতায় আসছে না।
“আমরা দেখেছি, যত মৃত্যুর তথ্য রেকর্ডে আসছে, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। অবশ্য দেশে দেশে এই হারে উল্লেখযোগ্য হেরফের হতে পারে।”
এই ২০ লাখ মৃত্যুর সংখ্যার কতটা ভয়াবহতা লুকিয়ে আছে, তা একটি তুলনা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছে সিএনএন।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ৫৪৪ জন যাত্রী বহন করতে পারে এয়ারবাস এ৩৮০ উড়োজাহাজ। যদি প্রতিদিন যাত্রীবোঝাই দশটি করে এয়ারবাস এ৩৮০ উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়, আর এই ধারা যদি একবছর ধরে চলে, তবে মোট মৃত্যুর সংখ্যা করোনাভাইরাসের মহামারীতে মৃত্যুর সংখ্যার কাছাকাছি হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে সতর্ক করেছে, মহামারীর দ্বিতীয় বছরটি আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে, অন্তত বছরের প্রথম কয়েক মাস।
ইউরোপ, আমেরিকার সাম্প্রতিক সংক্রমণ পরিস্থিতিই তাদের এই উদ্বেগের কারণ। যুক্তরাজ্যের পর ব্রাজিলেও করোনাভাইরাসের অতি সংক্রমাক নতুন কয়েকটি ধরনের দেখা মিলেছে। সংক্রমণ বাড়তে থাকায় বিভিন্ন দেশকে নতুন করে লকডাউনের কড়াকড়িতে ফিরে যেতে হচ্ছে।
করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হারও এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছাতে লেগেছিল নয় মাস। এরপর তা দ্বিগুণ হতে চার মাসও লাগেনি। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, সুইডেন, ইন্দোনেশিয়া, ইসরায়েল আর জাপান গত সপ্তাহেই সবচেয়ে বেশি মৃত্যু দেখেছে।
রয়টার্স লিখেছে, প্রতিদিন এখন গড়ে ১১ হাজার ৯০০ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে করোনাভাইরাস; প্রতি ৮ সেকেন্ডে মৃত্যু হচ্ছে একজনের।
ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশনের পূর্বাভাস বলছে, ১ এপ্রিলের মধ্যে বিশ্বে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা পৌঁছাতে পারে ২৯ লাখে। বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভর করবে অতি সংক্রামক নতুন ধরনগুলো কত দ্রুত ছড়াচ্ছে তার ওপর।
যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত ৩ লাখ ৮৯ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে ২ কোটি ৩৩ লাখের বেশি মানুষ। বিশ্বে এখন এ ভাইরাসে যত মানুষ মারা যাচ্ছে, তাদের প্রতি চারজনের একজন যুক্তরাষ্ট্রের।
বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখা ব্রাজিলে ২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এ ভাইরাস। সেখানে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে প্রায় সোয়া ৮৩ লাখে।
দেড় লাখ লোকের মৃত্যু নিয়ে ভারত মৃতের সংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও এক কোটি ৫ লাখ শনাক্ত রোগী নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যায় আছে দ্বিতীয় স্থানে।
অবশ্য অঞ্চলের হিসাবে এই মহামারীতে সবচেয়ে বেশি প্রাণক্ষয় হয়েছে ইউরোপে। এই মহাদেশে এ পর্যন্ত ৬ লাখ ১৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা পুরো বিশ্বের ৩১ শতাংশ।
আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় এই দেশগুলো অনেক বেশি এগিয়ে থাকলেও করোনাভাইরাস পৌঁছে গেছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। একেবারে বিচ্ছিন্ন ও ক্ষুদ্র কয়েকটি দ্বীপ দেশই কেবল কোভিড-১৯ এর মৃত্যুর তালিকা থেকে দূরে থাকতে পেরেছে।
বয়স্কদের মধ্যেই এ ভাইরাস সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে বয়স, বিত্ত, জাতিভেদে মৃত্যু এসেছে সব শ্রেণিতেই, বিখ্যাত আর ক্ষমতাধররাও রেহাই পায়নি।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, “আজ আমাদের বিশ্ব এক হৃদয় বিদারক মাইল ফলকে পৌঁছালো। এই প্রতিটি সংখ্যার পেছনে আছে এক একটি নাম, এক একটি মানুষের মুখ। তাদের হাসি মুখ এখন কেবল স্মৃতি। খাবার টেবিলে তাদের আসনটি চিরদিনের জন্য খালি হয়ে গেছে। প্রিয় মানুষটি যে ঘরে থাকত, সেখানে এখন কেবল নিরবতার প্রতিধ্বনি।”