ফিরে পাওয়া হল সংস্কারে হাত গুটিয়ে জগন্নাথ কর্তৃপক্ষ

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উদ্ধার হওয়া দুটিসহ কলেজ আমলের তিনটি ছাত্রাবাসের দখল ফিরে পেয়েও জরাজীর্ণ সেগুলোকে বসবাসের উপযোগী করে তোলার কোনো পরিকল্পনাই নেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।

সাবিকুন্নাহার লিপিসাবিকুন্নাহার লিপি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Nov 2020, 06:04 PM
Updated : 11 Nov 2020, 08:28 PM

অর্ধযুগেরও বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ও কর্মচারী এসব পুরনো ভবনে থাকলেও কোনোটিই বসবাসের উপযোগী নয়।

হল উদ্ধারে নেতৃত্ব দেওয়া সাবেক ছাত্রনেতারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের তীব্র আবাসন সংকট থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এসব স্থাপনার উন্নয়ন হয়নি।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, সরকারের বরাদ্দ ও নির্দেশনা ছাড়া হলগুলোর পরিকল্পনায় যেতে পারছেন না তারা।

তিন হলের হাল-হকিকত

হাবিবুর রহমান হল

ড. হাবিবুর রহমান হল: পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার যেসব পরিত্যক্ত বাড়িকে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাস বানিয়েছিলেন, ১৯৮৫ সালের পর সেসব একে একে বেহাত হতে থাকে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হওয়ার পর প্রভাবশালীদের দখল থেকে এসব ছাত্রাবাস উদ্ধারে নিয়মিতই আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা।

২০১১ সালের আন্দোলনের পর ওই বছরের ৩ অক্টোবর বংশালের মালিটোলার গোলক পাল লেনের ড. হাবিবুর রহমান হলটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বুঝিয়ে দেয় জেলা প্রশাসন।

ক্যাম্পাস থেকে পৌনে এক কিলোমিটার দূরে ৯ দশমিক ৩৯ কাঠার এই জমিতে দুটি টিনশেড ভবন রয়েছে।

বর্তমানে ভবন দুটিতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিসহ বিভিন্ন শ্রেণির ২১ জন কর্মচারী পরিবার নিয়ে থাকছেন।

সেখানকার বাসিন্দা তৃতীয় শ্রেণির একজন কর্মচারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এখানে ছয়-সাত বছর ধরে আছি। প্রশাসন থেকে অনুমতি নিয়ে আমরা আমাদের মতো করে থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় কিছু দেয় না, নেয়ও না।”

নজরুল ইসলাম হল: ওয়ারীর টিপু সুলতান রোডের গোপীমোহন বসাক লেনের এক বিঘা আয়তনের নজরুল ইসলাম হলটি উদ্ধার হয় শিক্ষার্থীদের ২০১৪ সালের আন্দোলনে।

স্থানীয় দখলদারদের সরিয়ে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ওই বছরের ২ এপ্রিল হলটি বুঝে পায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

সম্প্রতি দোতলা ভবনটি ঘুরে দেখা গেছে, বারান্দার ওপর থেকে টিন সরে গেছে, মেঝেতে ময়লা জমে আছে। শ্যাওলা পড়া দেয়ালে গাছও জন্মেছে।

পুরনো ভবনটির সাতটি রুমে নানা সমস্যা নিয়েই ২০-২৫ জন শিক্ষার্থী থাকছেন। কর্তৃপক্ষের তদারকি না থাকায় তারা নিজেরাই ভবনটির প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নিয়েছেন।

এই হলের বাসিন্দা সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলেন, “এখনও ভবনটা মোটামুটি ভালো আছে, কিছুটা সংস্কার করলেই আমরা ভালোভাবে থাকতে পারতাম।”

ওয়ারীর টিপু সুলতান রোডের গোপীমোহন বসাক লেনের এক বিঘা আয়তনের নজরুল ইসলাম হল

নিজেদের উদ্যোগে ভবনটিতে রঙ করার পাশাপাশি পানির ব্যবস্থা করার কথা জানান তিনি।

“এখনও বাথরুমের সমস্যা রয়েছে। আগে তো থাকার মতো পরিবেশই ছিল না। আমরা ঠিক করে নিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় কোনো দেখভালই করছে না।”

২০১৪ সালে হলটিতে শিক্ষার্থীরা ওঠার আগে থেকেই বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ও টেলিফোন বিল জমে ছিল। জমে থাকা সেসব বিলের কারণে এখনও প্রায়ই বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় বলে জানান শিক্ষার্থীরা।

প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী আবু মুসা রিফাত বলেন, “লক্ষাধিক টাকা বিদ্যুৎ বিল বাকি আছে। এত টাকা আমরা কিভাবে দেব? মাঝেমাঝেই সংযোগ কেটে দেয়। যেহেতু আমরা শিক্ষার্থী, তাদের অনুরোধ করলে বিষয়টি বিবেচনা করে আবার সংযোগ দিয়েও দেয়।”

তার আশঙ্কা, ছাত্ররা এখানে না থাকলে ভবনটি আবার বেদখল হয়ে যেতে পারে।

“করোনাভাইরাসের মধ্যে আমরা বাড়ি চলে যাওয়ায় সার্টিফিকেট, রাউটার, কম্পিউটার ও পোশাকসহ আমাদের লক্ষাধিক টাকার জিনিস চুরি হয়েছে। আমাদের সরানোর জন্য স্থানীয়রা এগুলো চুরি করেছে। পরে স্থানীয় বন্ধুদের এখানে এসে থাকতে বলি। তারা থাকার পর আর কিছু চুরি যায়নি।”

রিফাত আরও বলেন, “এখানে অনেক জায়গা শুধু শুধু পড়ে আছে। প্রশাসন চাইলে বড় ভবন করতে পারে। তাহলে অনেক শিক্ষার্থী থাকতে পারত, আবাসন সমস্যা কিছুটা হলেও দূর হতো।”

প্যারিদাস রোডের ঈশ্বরচন্দ্র দাস লেনের বাণী ভবন।

বাণী ভবন: দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মচারী প্যারিদাস রোডের ঈশ্বরচন্দ্র দাস লেনের বাণী ভবনটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধা কিলোমিটার দূরের ১০ দশমিক ০৯ কাঠার জমিটিতে ঝুঁকিপূর্ণ দোতলা এই ভবনের পাশে একটি টিনশেডও রয়েছে।

কলেজ আমলের এই ছাত্রাবাসটিতে গিয়ে দেখা যায়, অর্ধশতাধিক কর্মচারী সেখানে থাকছেন; কয়েকজন পরিবার নিয়েও আছেন।

হলটিতে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী এরশাদ মিয়া বলেন, “এটা থাকার উপযুক্ত না, তারপরও আমরা রিস্ক নিয়ে থাকছি।”

‘দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের’

২০১৪ সালের যে আন্দোলনে একটি হল উদ্ধার হয়েছিল, সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম ছাত্রাবাসগুলোর বেহাল দশার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেছেন।

“বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেখায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের সামনে মাঠ থাকে, বাগান থাকে; কিন্তু উদ্ধার হওয়া জমিগুলো তেমন না হওয়ায় এসব স্থানে হল করা নাকি সম্ভব না। এই অজুহাতে তারা কোনো কার্যক্রম চালায় না। কিন্তু আমাদের তো মাঠ-বাগানের দরকার নাই, থাকার ব্যবস্থাটা আগে দরকার।

“হাবিবুর রহমান হলে আমরা চেয়েছিলাম ভবন তৈরি করা হোক, অন্তত যতজন থাকতে পারে সে ব্যবস্থা করুক। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।”

হাবিবুর রহমান হলে বর্তমানে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিসহ বিভিন্ন শ্রেণির ২১ জন কর্মচারী পরিবার নিয়ে থাকছেন।

হল উদ্ধারে সরকারের গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির এই সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে দাবি জানিয়েছিলাম, উদ্ধারকৃত জায়গাগুলোতে হল করা হোক। কোথাও যদি হল না করা যায়, সেখানে শিক্ষক, কর্মকর্তাদের কোয়ার্টার হতে পারে।”

সম্পূর্ণ অনাবাসিক এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার দেড় দশক পর গত ২০ অক্টোবর ৬২৪ শয্যার ১৬তলা একটি ছাত্রী হলের উদ্বোধন করা হয়েছে, যদিও তা বসবাসের উপযোগী হতে আরও কিছু সময় লাগবে।

২০ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য দ্রুত আরও হল প্রয়োজন জানিয়ে সিরাজুল ইসলাম বলেন, “শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গা নেই, তারা মেসে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। একটি ছাত্রী হলে তো সবাই থাকতে পারবে না। উদ্ধারকৃত জমিগুলোতে হল করলে সংকট কমবে।”

হাত গুটিয়ে কর্তৃপক্ষ

হলগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী ওহিদুজ্জামান বলেন, “সরকার যদি টাকা দেয়, তাহলে হলগুলো সংস্কার করা যাবে। টাকা না দিলে তো সংস্কার করা যাবে না। সরকার টাকা দেবে কিনা তা জানি না।“

বরাদ্দ পেতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের হল উদ্ধার কমিটি এসব বিষয়ে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছিল। কিন্তু সরকার কিছু জানায়নি।”

হল উদ্ধারে সরকারের গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির সদস্য সচিব ওহিদুজ্জামান জানান, কেরাণীগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের জন্য যে প্রকল্প রয়েছে, সেজন্যও উদ্ধারকৃত হলগুলো নিয়ে পরিকল্পনা নেওয়া যায়নি।

“সরকার যদি বলে, চলে যাবে; এখানে আবার টাকা খরচ করবে কেন?” বলেন তিনি।