ঢাকার শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এ দাবি জানানো হয়।
Published : 23 Feb 2024, 06:43 PM
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি মুছে ধর্ষণ ও নিপীড়নবিরোধী গ্রাফিতি আঁকার জেরে ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ও মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক একদল শিক্ষার্থী।
শুক্রবার বিকেলে ঢাকার শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এ দাবি জানানো হয়।
সমাবেশে তারা ‘অন্যায্য বহিষ্কার প্রত্যাহার কর’, ‘গ্রাফিতি আঁকার দায়ে বহিষ্কারাদেশ বাতিল কর’, ‘ছাত্রনেতাদের বহিষ্কারাদেশ বাতিল কর’সহ বিভিন্ন লেখা-সম্বলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।
ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানবিকী অনুষদের পশ্চিম পাশের দেয়ালে ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি চিত্র মুছে ধর্ষণবিরোধী দেয়ালচিত্র আঁকেন জাহাঙ্গীরনগর ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি অমর্ত্য রায় ও সাধারণ সম্পাদক ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলী।
তারা দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী। সেই দেয়ালচিত্রে তারা ‘ধর্ষণ ও স্বৈরাচার থেকে আজাদী’ বাক্যটি জুড়ে দেন।
বঙ্গবন্ধুর ছবি মুছে দেয়ালচিত্র অঙ্কনকারীদের শাস্তির দাবিতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর থেকে আমরণ অনশনে বসেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই নেতা এনামুল হক ও রিয়াজুল ইসলাম৷
টানা চারদিনের অনশন শেষে ১৯ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের আশ্বাসে ডাবের পানি খেয়ে অনশন ভাঙেন ছাত্রলীগের ওই দুই নেতা।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হেল কাফীকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
মঙ্গলবার সিন্ডিকেট সভায় কমিটির সুপারিশে অমর্ত্য রায় ও ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলিকে এক বছরের বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাদী হয়ে এই দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে সাভারের আশুলিয়া থানায় ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ মামলা দায়ের করে।
শাহবাগে বিক্ষোভ সমাবেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রয়োদশ ব্যাচের শিক্ষার্থী কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, “ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দুই শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করার পাশাপাশি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। আন্দোলন দমন করতেই বঙ্গবন্ধুর নাম অপব্যবহার করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
“রাষ্ট্র একটি ইস্যুকে ঘুরিয়ে দিতে অন্য ইস্যু বাজারে আনে। ঠিক একইভাবে জাহাঙ্গীরনগর প্রশাসনও একই কাজ করছে। আন্দোলনের মূলস্রোতকে ঘুরিয়ে দিয়ে মাস্টারপ্ল্যানের টাকার ভাগবাটোয়ারার পথ সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ড. মাসউদ ইমরান মান্নু বলেন, একটি রাষ্ট্রে কেন গ্রাফিতি মোছা যাবে না? অথচ এমন কোনো আইন নেই যা এই ধরনের গ্রাফিতিকে রক্ষা করবে।
“গ্রাফিতি একটি চলমান অবস্থা। যারা গ্রাফিতি করেন, তারাও আশা করেন না যে সেটা সব সময় থাকবে। অমর্ত্য ও ঋদ্ধ যে কাজ করেছে, সেটা যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তবে আমিও একই অন্যায় করতে চাই। শাহবাগে দাঁড়িয়ে আমি এ কথা বলে গেলাম। আমি এমন অপরাধ বার বার করতে চাই।”
বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৯তম আবর্তনের শিক্ষার্থী তন্ময় ধর বলেন, “বর্তমান সময়ে শিল্প সংস্কৃতির উপর খড়গ নেমে আসছে। এই ডিজিলাইজেশনের যুগে এসে কার্টুন আঁকার দায়ে মামলা হচ্ছে। ঋদ্ধ ও অমর্ত্যকে কেন তাদের বহিষ্কার করা হল, কেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হল, সে প্রশ্ন আমরা করতে চাই!
“তারা এদের কেন এত ভয় পায়? তাদের যে ভাগভাটোয়ারার কাজ, সেখানে এই দুইজন বাঁধা দিয়েছে। অন্যথায় ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল পরিস্থিতির ঘটনা ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার অন্য কোনো কারণ নেই।”
বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ইউল্যাবের শিক্ষক কাব্য কৃতিকা বলেন, “যে দেয়ালের গ্রাফিতি নিয়ে এত সমস্যা, এই দেয়ালে গত ৮ বছরে চার থেকে পাঁচটি চিত্র ছিল। সময়ের সাথে সাথে চিত্র পাল্টানো হয়। ২০১৯ সালে সেখানে তৎকালীন উপাচার্যকে নিয়ে একটি ক্যারিকেচার ছিল। আমরা জানি, সেই ক্যারিকেচার নিয়ে অনেকের সমস্যা ছিল। পরে সেখানে বঙ্গবন্ধুর চিত্র আঁকেন সেই সময়কার ছাত্রলীগ।”
তিনি বলেন, “দেশে যখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছিল, সেই সময় সব শিক্ষকই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরের এবারের ঘটনাটি কোনো ফরমাল ব্যাপার ছিল না। এটি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। অথচ এটিকে ভিন্ন একটি মোড় দেওয়া হয়েছে।”
৩৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৌমিত জয়দ্বীপ বলেন, “‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার মত করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার একটি প্রতিফলন হল প্রশাসনের এই উদ্যোগ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের বাইরেও বিকল্প ছায়া প্রশাসন কাজ করে। এখানে ৭৩ এর অধ্যাদেশের কোনো বালাই নেই।
“আজকে যে অরাজকতা জাহাঙ্গীরনগর শুরু করেছে, তারই ধারাবাহিকতায় দুজন ছাত্রনেতাকে লঘুপাপে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অথচ এটি খুব স্বাভাবিকভাবেই সমাধান করা যেত।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী অনিরুদ্ধ দাস অঞ্জন বলেন, “জাহাঙ্গীরনগরের মুক্ত পরিবেশের গলা টিপে ধরা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের এখন ধর্ষণের বিরুদ্ধে দফায় দফায় আন্দোলনে নামতে হয়। জাহাঙ্গীরনগরে আগে পাখি গান গাইত, এখন গায় না।
“এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অবাধে লুটপাট চালাচ্ছে। অবাধে ধর্ষণ চলছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন দমন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের চিরায়ত পথ বেছে নিয়েছে। তারা দুজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছে। প্রশাসনকে আমি বলব– রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রদ্রোহ– এইগুলা পুনরায় পাঠ করবেন আপনারা।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী কাজল সিদ্ধান্তের সঞ্চালনায় সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও ইউল্যাবের শিক্ষক অলিউর সান, সাবেক শিক্ষার্থী সোহেল জাফর, সাদিয়া ফেরদৌস, অনিন্দ্য আরিফসহ অনেকে বক্তব্য দেন।