গ্রামীণ সমাজে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র রাজনীতিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় বিরোধ মীমাংসায় সালিশ কিংবা বিচারে পৃষ্ঠপোষকতার কারণে দুর্নীতি বাড়ছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার অডিটোরিয়ামে ‘গ্রামবাংলার রুপান্তর’ নামে গবেষণা গ্রন্থের আলোচনায় লেখক গবেষক স্বপন আদনান এসব কথা বলেন।
সোয়াস ইউনিভার্সটি অব লন্ডনের প্রফেশনাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট স্বপন জানান, গত কয়েক দশকে গ্রামের পরিবারসমূহের মধ্যে সমাজ-ভিত্তিক সম্পর্কের দৃঢ়তা দুর্বল হয় পড়েছে।
বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সালিশ-বিচারের কার্যকারিতা কমে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “গ্রামের মানুষের মধ্যে বৈধ কর্তৃত্বের যে প্রথাগত ধারণা ছিল, তা থেকে ক্রমবর্ধমান বিচ্যুতি ঘটেছে।
“ক্ষমতার ভরকেন্দ্র সরে গেছে আগের সমাজ সালিশ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ, থানা-পুলিশ বা রাজনৈতিক পার্টির নেতাকর্মীর হাতে।
“এভাবে ক্ষমতার বিন্যাস ও অর্থনৈতিক সম্পর্কসমূহ বদলে যাওয়ায় গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার কার্যকারিতায় চিড় ধরেছে বহু ক্ষেত্রে।”
গ্রামীণ সমাজের বর্তমান চিত্র তুলে ধরে ওই গবেষক বলেন, “এখন কোথাও কোথাও থানার ওসি সালিশ করছেন, রাজনৈতিক নেতা বা ছাত্রনেতারা সালিশ করছেন।
“যার ফলে প্রাধান্য পেয়েছে পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি, যেখানে মানুষ সমাজের কথা না ভেবে নিজের কথা ভাবে, স্থানীয় নেতা-নেত্রীদের প্রতি আনুগত্য দেখাতে হয়।”
এসব কারণে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে দাবি করে স্বপন বলেন, “নেতা বা পৃষ্ঠপোষকের প্রতি আনুগত্য দেখানোর জন্য সমাজের দরিদ্র ও দুর্বল মানুষেরা বিভিন্ন খণ্ড বা দলে বিভক্ত হয়ে যায়।
“পৃষ্ঠপোষতার ফলে যারা দুর্নীতি করছে, তারা মনে করছে অন্যায় করলে তাদের শাস্তি হবে না। ফলে সমাজে দুর্নীতি বাড়ছে।”
‘গ্রামবাংলার রুপান্তর’ গ্রন্থে লেখক ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরের সময়ে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “নগরায়ণ, শিল্পায়ন, উন্নয়ন-কার্যক্রম ও দেশ-বিদেশে শ্রমিকদের অভিবাসন- এসব বহুমুখী প্রক্রিয়ার ফলে গ্রামের মানুষের জীবিকায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
“একই সঙ্গে শহুরে জীবনযাত্রার রুচি ও স্টাইল তাদের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছে।”
ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছাড়াও জাতিসত্ত্বা এবং ভাষাগত ভিন্নতার ওপর ‘ঝোঁক’ তৈরি হয়ে নতুন ধরনের সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ঘটছে বলেও জানান তিনি।
“এভাবে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বিস্তার ঘটানো হলেও তার আড়ালে শ্রেণিভিত্তিক ক্ষমতাবিন্যাস এবং শোষণের ভূমিকা প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করে চলেছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ এ আলোচনাসভার আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক সাদেকা হালিম।
অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল আই খান ও অধ্যাপক এএসএম আমানুল্লাহ আলোচনায় অংশ নেন।