লবণের সরবরাহে ঘাটতি না থাকলেও দাম বেড়েছে, তাতে চামড়া সংরক্ষণের ব্যয় বেড়ে যাবে বলে দুর্ভাবনা পুরান ঢাকার লালবাগের আড়তদারদের।
Published : 28 Jun 2023, 09:17 AM
কোরবানির ঈদের আগে পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তায় এখন সাজ সাজ রব। কাঁচা চামড়ার সবচেয়ে বেশি আড়ত এখানেই।
পোস্তার আড়তদাররা এখন সারা দেশের নিয়মিত ও মৌসুমী কাঁচাচামড়া সরবরাহকারীদের সঙ্গে শেষ মূহূর্তের যোগাযোগ সারছেন। আবার পুরনো চামড়া সরিয়ে আড়ৎ ফাঁকা করছেন নতুন চামড়া রাখার জন্য। চলছে ধোয়া মোছার কাজ।
বৃহস্পতিবার কোরবানির ঈদ, সেদিন থেকেই পশুর কাঁচা চামড়া আসতে শুরু করবে আড়তগুলোতে। তারা সেই চামড়া কিছুটা প্রক্রিয়াজাত করে ট্যানারিতে বিক্রি করবে।
বাংলাদেশে পশুর চামড়ার যে চাহিদা, তার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই পূরণ হয় কোরবানির পশু থেকে। সেকারণে এ সময়টাই চামড়া সংগ্রহের মূল মৌসুম।
কোরাবানির ঈদে পোস্তায় গড়ে ৪ লাখের মতো চামড়া আসে। কিন্তু এবার লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় চামড়া সংগ্রহ করে বিক্রির পর মুনাফা নিয়ে সংশয় দানা বেঁধেছে আড়তদারদের মনে।
পোস্তার ব্যবসায়ী সোহরাওয়ার্দী অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন চিন্তিত লবণের দাম বৃদ্ধি নিয়ে।
তিনি মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত বার ৭৪ কেজি লবণ কিনেছিলাম এক হাজার থেকে ১০৫০ টাকায়। কিন্তু এবার সেই দাম ১ হাজার ৩০০ টাকায়ও উঠেছে। প্রতি বস্তায় প্রায় ৩০০ টাকার মতো বেড়েছে।
“এর সঙ্গে রয়েছে লবণ ট্রাকে ওঠানো ও ফের আড়ৎ ঘরে নামানোর খরচ। এই খরচ মিলিয়ে বস্তা প্রতি ৩০০ টাকা খরচ বাড়তি হচ্ছে এবার।”
লবণের দাম এবার কিছুটা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিসিকের লবণ সেল এর কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, গতবারের চেয়ে এবার লবণ উৎপাদন যেমন বেশি হয়েছে, তেমনি শিল্প লবণ উৎপাদনের খরচও বেড়েছে।
লবণ উৎপাদনে ব্যবহৃত পলিথিন ও পানি সেচে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে ছিল পরিবহনে বাড়তি ব্যয়। সে কারণেই লবণের দাম বেড়েছে বলে জানান তারা।
লবণের সরবরাহে কোনো সমস্যা না দেখার কথা পোস্তার ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিনও বলছেন। তার ভাষ্যে, “লবণের অভাব নেই। চাইলেই পাওয়া যাচ্ছে। চাহিদার যা বাকি আছে, তা কালই (বুধবার) চলে আসবে।”
গতবার ২০ হাজার পিস লবণ ছাড়া চামড়া সংগ্রহ করলেও এবার খরচ বেড়ে যাওয়ায় লক্ষ্য ঠিক-ঠাক করেননি এই আড়তদার।
তিনি বলেন, “১৫ হাজার পিসের আশপাশে থাকবো। যদি বাজার ভালো পাই, তাহলে আমার চারটি আড়তে মোট ২০ হাজার পিস সংগ্রহ করতে পারব।”
পোস্তার আড়তগুলোতে দেখা গেছে, পরিচ্ছন্ন করার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক ছিটিয়ে গন্ধ দূর করতে।
আহমেদ আলী অ্যান্ড ব্রাদার্সের আড়তে গিয়ে দেখা যায়, ঘর পরিষ্কার করে চেয়ার পেতে বসে রয়েছেন কর্মচারীরা।
প্রয়োজনীয় লবণের বস্তা ও টুকরি মজুত করছেন সবাই। কর্মচারী ঠিক-ঠাক করা, অর্থ সংগ্রহে ফোন ও মৌসুমী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে আড়তদারদের।
পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরে ২৬ বছর ধরে পোস্তায় চামড়ার ব্যবসা করছেন আরএকে হাইডের পরিচালক সালাহ উদ্দিন।
গতবার ৮৫০টি চামড়া সংগ্রহ করার কথা জানিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইচ্ছা আছে, এবার ১ হাজার পিস সংগ্রহ করার।”
সাধারণত রাত ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত চামড়া সংগ্রহ করেন এ এলাকার ব্যবসায়ীরা। সংগ্রহকৃত চামড়া দ্রুত লবণ মিশিয়ে রাখতে হয়। সপ্তাহ খানেক পর সেই চামড়া চলে যায় বিভিন্ন ট্যানারিতে।
৭২ কেজি ওজনের সাড়ে ৬০০ বস্তা লবণ সংগ্রহ করেছেন পোস্তার ব্যবসায়ী আনোয়ারুল ওহাব অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তারিক ইবনে আনোয়ার পান্না।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৫০ কেজির প্রতি বস্তা লবণে ৬-৭টির মতো চামড়া সংরক্ষণ করা যায়। আমি এজন্য ৭২ কেজি ওজনের বস্তা ব্যবহার করি, যাতে গড়ে ছোট-বড় মিলিয়ে ১০টির মতো চামড়া সংরক্ষণ করা যায়।”
প্রতিটি চামড়ায় ৫ কেজির মতো মোট দানার লবণ প্রয়োজন হয় সাধারণত। কিন্তু ঈদের সময়ে অদক্ষ ও মৌসুমী শ্রমিক কাজ করায় লবণের খরচ বেড়ে যায়।
সালাহ উদ্দিন বলেন, “অনভিজ্ঞ মিন্তি ও দ্রুত কাজ করবে বলে লবণ বেশি লাগবে। সাধারণ সময়ে স্থায়ী শ্রমিকরা জেনে বুঝে ধীর-স্থিরভাবে লবণ মেশায়। কোনো তাড়াহুড়া থাকে না। ঈদের দিন তাড়াহুড়া থাকে। কারণ চামড়া বেশি, কাজও বেশি থাকে।”
ঢাকা ও আশপাশের এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে লবণ ছাড়া ও লবণ যুক্ত চামড়া সংগ্রহ করতে পোস্তার ব্যবসায়ীরা যোগাযোগ করছেন দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে।
সিলেটের হবিগঞ্জ এলাকা থেকে মৌসুমী ব্যবসায়ী ফরিদুল আগাম টাকা নিতে এসেছিলেন পোস্তার আড়তে। বায়না টাকা নিয়ে ধারণা দিয়ে গেলেন, কী পরিমাণ চামড়া দিতে পারবেন।
ফরিদুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিবছরই কোরবানির ঈদে চামড়া নিয়ে আসি। এবারও আনতে চাই। দাম বেশি পেলে কিছুটা ব্যবসা থাকে।”
কোরবানির ঈদের সময়ে ব্যবসায়ীদের অর্থ সরবরাহ বাড়িয়ে দিতে প্রতিবারের মতো এবারও ব্যাংকগুলোকে চামড়া কেনার জন্য ঋণ দিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি মিলিয়ে এবার ১২টি ব্যাংককে সর্বোচ্চ ২৫৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যাংকগুলো এর মধ্যে চামড়া খাতের ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে পারবে। এই সীমা অতিক্রম করতে পারবে না।”
২০২২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত ৪টি এবং বেসরকারি ৭টি ব্যাংকে মোট ৪৪৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাড়তি মোটা লবণের দাম
কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন হয় মোটা দানার লবণের, যা একটু লালচে বর্ণের হয়।
প্রতি বস্তায় ৫০, ৬০ ও ৭০ কেজির হয়। ৭০ কেজি বস্তায় লেখা থাকলেও তা বাস্তবে তা কম থাকে।
এই মোটা লবণের দামই বেড়েছে।
চাহিদার পুরোটাই দেশে উৎপাদিত হওয়া লবণের দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশেনের (বিসিক) লবণ সেলের প্রধান সরোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টেয়োন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতবারের চেয়ে এবার ৪ লাখ টন বেশি লবণ উৎপাদন হয়েছে। সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই।
“লবণ উৎপাদনের প্রধান উপকরণ হচ্ছে পলিথিন। সেই পলিথিনের দাম বেড়েছে আমদানি পণ্য হওয়ার কারণে। আর পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত ডিজেলের দামও বেড়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে শ্রমিক খরচ।”
লাবণের দাম বাড়লেও তা অযৌক্তিকভাবে যেন না বাড়ে, সেজন্য চট্টগ্রামে মঙ্গলবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
সাগড় পাড়ে তৈরি অপরিশোধিত লবণ ট্রাকে করে নেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার কারখানায়।
সেখানে পরিশোধনের পর শিল্প লবণ চলে যায় বিভিন্ন আড়ত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। একাধিকবার পরিবহন, উঠানো-নামানোতেও খরচ যুক্ত হয়। ইউক্রেইন যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ কারণে ডলারের দাম বেড়ে গিয়ে জ্বালানির দামও বেড়ে গিয়েছে। এতে পণ্য পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় লবণের দামেও প্রভাব পড়ছে, বলছেন বিসিক কর্মকর্তা সরোয়ার।
চামড়ার দর
ঈদ সামনে রেখে পশুর চামড়া সংগ্রহের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার; ঢাকায় গরুর চামড়ার দাম গতবারের চেয়ে ৩ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪ টাকা বেড়েছে।
ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনতে হবে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়; গত বছর এই দাম ছিল ৪৭ থেকে ৫২ টাকা। ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম হবে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা, গত বছর যা ৪০ থেকে ৪৪ টাকার মধ্যে ছিল।
এছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া গত বছরের মতই প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা, আর বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।