“সব জিনিসের দাম বাড়ছে। কিন্তু কাস্টমারের বাজেট তো আর বাড়ে না। তাই বিক্রি হচ্ছে না”, বলছিলেন মিরপুর শাহ আলী প্লাজার এক বিক্রেতা।
Published : 16 Mar 2024, 10:04 PM
মার্কেট ঘুরে মিরপুরের শাহ আলী প্লাজার সিঁড়ি ভেঙে খালি হাতে ফিরতে দেখা গেল মধ্যবয়সী শাহাবুদ্দিন আহমেদকে।
‘ঘরে ঘরে হানা দেওয়া বাজারদর’ তার শখেও ‘খামচে’ ধরেছে বলে জানালেন তিনি।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাচ্চার জন্য কাপড় কিনতে আসছিলাম। কিন্তু দাম দেখে কুলাইতে পারলাম না। পরে সম্ভব হলে হয়ত আসব।
“সবকিছুর দাম বেশি, খাব না শখ করব বুঝতেছি না। রোজায় একটু ভালো মন্দ খাইতেও হয়।”
বাজার মূল্যের প্রভাব যে কাপড়ের মার্কেটে এসেও পড়েছে সে কথা জানালেন মার্কেটটির বিক্রেতারাও। তারা বলছেন, দাম বাড়ায় বিক্রি কম। কিন্তু তাদেরও বেশি দরে কিনতে হয়েছে। এখন দুইয়ের সমন্বয় কীভাবে হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় তারা।
মিরপুর শাহ আলী প্লাজার স্টাইলিশ পয়েন্টে ক্রেতার জন্য আরামদায়ক আর নতুন নতুন শৈলীর পোশাক নিয়ে অপেক্ষা করলেও তাদের দেখা তেমন পাচ্ছেন না বলে জানালেন দোকানটির স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত রোজার ঈদের তুলনায় এবার ২০ শতাংশ বিক্রি কম হচ্ছে।
“সব জিনিসের দাম বাড়ছে। কিন্তু কাস্টমারের বাজেট তো আর বাড়ে না। তাই বিক্রি হচ্ছে না। ছুটির পরও বাড়ছে না।”
পাঞ্জাবির দোকান অরবিট মার্টের ক্যাশিয়ার প্রিতম সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন, এক বছরের ব্যবধানে তারা হারিয়েছেন ৪০ শতাংশ ক্রেতা।
গত রোজার ঈদে তারা যে পাঞ্জাবি ১২০০ টাকায় বিক্রি করতেন সেটা এখন ১৫০০ টাকায় বিক্রি করছেন তারা।
“এ কারণে কাস্টমার নিতে চায় না। আর আমাদেরও দাম না বাড়িয়ে উপায় নেই। কারণ গজ কাপড় আমাদের বাড়তি দাম দিয়ে কিনতে হয়। গজ প্রতি এবার ৫০-৬০ টাকা বেড়েছে। সবকিছুর খরচ মিলিয়ে আমাদের দাম বাড়াতে হচ্ছে।”
বাজারের দর মানুষের পকেটে যে প্রভাব ফেলেছে এর ফলে তারা কাপড় কিনতে এসে একটু বেশিই দামাদামি করছে বলে জানালেন চন্দ্রবিন্দুর শাহ আলী প্লাজা মার্কেটের শাখা ব্যবস্থাপক সোহান আহমেদ ইকবাল।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে না থাকার ফলে গত ৫-৭ বছর ধরে ক্রেতারা ফুটপাতমুখি হচ্ছেন।
“মার্কেটে যত বিক্রি হয় তারচেয়ে বেশি বিক্রি চলে ফুটপাতে। ওখানে কমে পাওয়া যায়, আমরা তো কমে দিতে পারছি না। এমনও হয় পছন্দ করেছে কিন্তু টাকার জন্য নিতে পারছে না। দুটো পোশাক নিত, কিন্তু একটা নিয়ে চলে যাচ্ছে।”
মিরপুর ১২ নম্বর থেকে পরিবার নিয়ে ঈদের কেনাকাটা করতে শাহ আলী প্লাজায় এসেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী সাহাদাত হোসেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাঝের এক বছরে কাপড়ের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ; ফলে তার মতো ক্রেতাদের ‘ভালো মানের’ পোশাক কেনার সক্ষমতা আর নেই।
“অতিরিক্ত দাম। এই টাকার পোশাক তো কিনতে পারব না। কারণ, আমার সে সক্ষমতা নেই, আমি সামান্য আয়ের মানুষ। পছন্দ করে, ওইসব ড্রেস আর কিনিনি। নর্মাল ড্রেস কিনে চলে যাচ্ছি, দেশের পরিস্থিতি ভালো না।”
তবে ক্রেতা টানতে নতুন কৌশল অবলম্বন করতে দেখা গেল মিরপুর ১ নম্বরের ‘আঙ্গিনা মেগামলে’। যদিও দুপুরের দিকে সেখানে তেমন ক্রেতা সমাগম দেখা যায়নি।
ঈদ উপলক্ষে তারা বাধা দামের উপর ২০ শতাংশ ছাড় দিয়েছেন, যেটি চলবে পুরো রোজার মাস জুড়েই।
বিপণি বিতানে ১ হাজার ৬৫০ থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যে নারীদের পোশাক বিক্রি হচ্ছে। তার মধ্যে ছাড় পেয়ে ক্রেতারা ‘মোটামুটি আগ্রহ’ দেখাচ্ছেন বলে জানালেন আঙ্গিনার একজন স্বত্বাধিকারী মিন্টু সরকার।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের রেট আগেরটাই রেখেছি। ছাড়ও ছিল না আগে। বিক্রি বাড়ানোর জন্য এবার দিয়েছি। দাম আগের থাকলেও অন্যান্য জিনিসের দাম বাড়ার কারণে তো তারা কুলাতে পারবে না, তাই আমাদের এ কৌশল নিতে হইছে।”
মিরপুর নিউমার্কেটেও একই অবস্থা দেখা গেল।
রঙজয়ী মেগামলের ব্যবস্থাপক শহীদুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাজেটে কুলাতে না পেরে ক্রেতারা ছাড় চাচ্ছে।
“সবার একটা বাজেট থাকে। তার মধ্যে নিতে চায় আরকি। সবকিছুর মধ্যে এভারেজ দামের পোশাকটা বেশি বিক্রি হচ্ছে, দামি পোশাকের দিকে যেতে চায় না।”
মার্কেট শেষে বাড়ি ফিরছিলেন মায়শা তাবাসসুম। তিনি বলেন, “হালকা কেনাকাটা করেছি। ভালো মানের জিনিস কিনতে পারিনি। নতুন কাপড় পেয়ে ছোটরা খুশি হবে, সেটার জন্যই কেনা।”
মার্কেটটির দ্বিতীয় তলার এক কোণায় শিশুদের পোশাকের দোকান লাইফ স্টাইল। সেখানে বিক্রেতাদের বসে থাকতে দেখা গেল।
বিক্রয়কর্মী হাবিব খান রাজিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেমন হওয়া উচিত তেমন বেচাবিক্রি নাই। আগে জামা কিনত দুইটা, দাম বাড়ার কারণে এখন হিসাব করে চলে; কোথায় কীভাবে কম খরচে চলা যায়।”
ফুটপাতে ভিড়
মিরপুরের মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সে দেখা গেল সুনসান নীরবতা। ‘নিউ বৈশাখী শাড়ী হাউজ’ এর বিক্রয়কর্মী মো. মুন্না বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মার্কেটে এখন কম মানুষ আসতেছে। হয়ত পরে বাড়তে পারে। সব কিছুরই তো দাম বেশি, মানুষ আর কেনাকাটা করবে কীভাবে।”
তবে মার্কেটটির পাশের ফুটপাতে মোটামুটি ভিড় করতে দেখা যায়। সেখানে নিজেদের জন্য পোশাক পছন্দ করতে দেখা যায় মালিহা মৌ ও তার মাকে।
মালিহার মা বলেন, “এখানকার কাপড়ও খারাপ না। আর সবার সক্ষমতা তো সমান না। আমাদের কম, তাই এখান থেকেই নিচ্ছি। মার্কেটে একটা পোশাকের যে দাম, পুরো পরিবারের জন্য কেনা সম্ভব না। সবকিছুর দাম বাড়ছে, কিন্তু আমাদের আয় তো বাড়ছে না।”
মুক্তিযোদ্ধা সুপার মার্কেটে শপিং শেষে কাউকে হাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে যেতে দেখা গেল, কেউ এক- দুইটা ব্যাগ নিয়ে বের হচ্ছেন, কেউ কেউ আবার ঘুরে দেখে চলে যাচ্ছেন।
মন ময়ূরী শাড়ী সম্ভারের স্বত্বাধিকারী লুৎফর রহমান চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গজ কাপড়ের দাম বাড়াসহ বিভিন্ন কারণে তাদের প্রতি পোশাকে ৭০০-৮০০ টাকা দাম বেড়েছে। ফলে দামাদামি করে খালি হাতে ফিরছেন ক্রেতারা।”
তিনি বলেন, “পছন্দ করে চলে যাচ্ছে তারা। অন্য জায়গা থেকে কম দামেরটা নেয়। আমরা চেষ্টা করি একটু দেওয়ার, কিন্তু লস দিয়ে তো দেওয়া যায় না।
“শুক্রবার আমরা যে প্রত্যাশা করেছিলাম তেমন কাস্টমার আসেনি। আমাদের কিছু পার্মানেন্ট কাস্টমার আছে, তারা আসছে।”