ফের ঢাকা-নারিতা ফ্লাইট: রাস্তায় নেমে ‘হাঁটতে শিখতে’ চান বিমানের এমডি

‘আমাদের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে, জেনেই তারা আসছে,’ এয়ারবাস ও বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব প্রসঙ্গে বলেন তিনি। 

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 May 2023, 06:24 PM
Updated : 21 May 2023, 06:24 PM

জাপানের সঙ্গে আবার সরাসরি উড়োজাহাজ চলাচল শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ বিমান; যা ধাপে ধাপে এগোবে জানিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইন্সটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম বলেছেন, ‘রাস্তায় না নামলে হাঁটতে শেখা যায় না। এ নিয়ে স্টাডি করছে বিমান’।

আগামী ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে জাপানের বৃহত্তম বিমানবন্দর নারিতার সঙ্গে ফ্লাইট শুরুর কথা জানান তিনি। এজন্য জুন থেকে টিকিট বিক্রির প্রচারণা শুরু হবে।

রোববার বিমান বাংলাদেশের প্রধান কার্যালয় বলাকায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানোর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সটির এমডি বিমান বাংলাদেশের আরও কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলেন।

এর আগে ১৯৭৯ সালে টোকিও ফ্লাইট চালু করেছিল বিমান। ১৯৮১ সালে সাময়িক বিরতির পর ঢাকা-নারিতা রুটে ফ্লাইট চালাতে শুরু করে বিমান। পরে ২০০৬ সালে জাপানের সঙ্গে বিমানের সরাসরি এ ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়।

১৭ বছর পর এ রুটে আবার চালুর আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে শফিউল বলেন, “রাস্তায় না নামলে হাঁটতে শেখা যায় না। এ নিয়ে স্টাডি করছে বিমান। সেই বিশ্লেষণ ইতিবাচক হলেই ধাপে ধাপে এগোবে বিমান।”

সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বের প্রধান দুই উড়োজাহাজ নির্মাতা এয়ারবাস ও বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব প্রসঙ্গে বিমানের এমডি বলেন, “তারা আমাদের কাছে আসছে কারণ তারা জানে আমাদের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। উভয়ই প্রস্তাব দিয়েছে। এটা আমাদের জন্য ভালো সুযোগ তৈরি করবে।”

টরন্টোর মত লাভজনক হওয়ার আশা

বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে জাপানে সরাসরি যোগাযোগ নেই। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা অন্য দেশে ‘স্টপওভার’ দিয়ে জাপানে নিয়ে যায় সংশ্লিষ্ট দেশের এয়ারলাইন্সগুলো।

নারিতা রুটে বিমানের ফ্লাইট পুনরায় শুরুর সিদ্ধান্তটি ‘ব্যবসায়িক না কি রাজনৈতিক’ জানতে চাইলে বিমানের এমডি বলেন, “নারিতাতে বিমানের ফ্লাইট চালানোর বিষয়টি শুধু ব্যবসায়িক নয়। এখানে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে আন্তঃসম্পর্ক, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয় জড়িত। জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ খুব গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘদীনের সম্পর্ক। এই রুটে যাত্রী চাহিদাও আছে।”

তিনি বলছেন, এখন অর্থনীতিতে বড় শক্তি হয়ে উঠেছে পূর্বের দেশগুলো। সেইদিক থেকে (জাপানের) নারিতা ফ্লাইট বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। এক্ষেত্রে তিনি উদাহরণ হিসেবে কানাডার টরন্টো রুটের কথা তুলে ধরেন।

শুরুর সময় অনেক সমালোচনা হলেও এখন বিমান বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয রুট টরন্টো দাবি করে তিনি বলেন, আশপাশের দেশের যাত্রীদের মধ্যেও বিমানের টরন্টো ফ্লাইটটি জনপ্রিয় হয়েছে। নেপালের প্রায় দেড় লাখ মানুষ জাপানে আছেন।

এছাড়া কলকাতা-দিল্লি থেকেও নারিতা ফ্লাইটের যাত্রী আনতে পারবে বিমান। সব মিলিয়ে রুটটি জনপ্রিয় হওয়ার আশা দেখছেন তিনি।

এসময় চীনের গুয়াংজু রুটে চালুর ছয় মাসের মাথায় ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে বিমানের এমডি বলেন, “গুয়াংজুতে ফ্লাইট চলাচল শুরু করেছিল বিমান। তবে করোনা মহামারির ধাক্কার কারণে এই রুট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আগামী ২৭ মে একটি সভা আছে। সে সভাটি হবে চীন সরকারের সঙ্গে। বিষয়টি সরকারের সঙ্গে সরকারের (জিটুজি)। সেই সভায় গুয়াংজু রুট চালুর বিষয়ে আলোচনা করা হবে।”

২০২২ সালের ১৮ অগাস্ট ঢাকা থেকে সরাসরি চীনের বাণিজ্যিক শহর গুয়াংজুতে ফ্লাইট চালু করে বিমান। এ বছরের মার্চে তা নিরবেই বন্ধ হয়ে যায়।

শফিউল আজিম বলেন, “গুয়াংজু রুটের বিষয়টি অপারেশনাল ইস্যু। চীন স্লট দিচ্ছে। কিন্তু আমরা নিচ্ছি না। ফ্লাইট অপারেট করার জন্য স্লট ভিন্ন সময়ে নিলে তো হবে না। যে সময়ে আমার স্লট প্রয়োজন, সে স্লট তারা দিতে পারছে না।

“বিমানের ক্ষতি হয় এমন সময়ে স্লট নিয়ে তো লাভ নেই। এ কারণেই গুয়াংজু রুটে বিমান চলাচল বন্ধ আছে।”

গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ে কী করছে বিমান

বিমান সেবা পরিচালনার পাশাপাশি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্বেও রয়েছে বিমান বাংলাদেশ। সংবাদ সম্মেলনে এ সেবা নিয়ে নিজের সহকর্মীদের প্রশংসা করেন এমডি।

বিমানবন্দরে লাগেজ ভোগান্তি কমেছে দাবি করে তিনি জানান, শাহজালালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিস দিতে বিমানের প্রায় সাড়ে তিন হাজার জনবল ২৪ ঘণ্টা তিন শিফটে কাজ করছে। এখানে ১১৯টি ক্যাটাগরির প্রায় দেড় হাজার ইকুপমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে এ সেবা দিতে। এখন বিমানবন্দরে প্রথম লাগেজ পাওয়া যায় বিমান অবতরণের ১৮ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে।

গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবার কারণেই বিমানকে সিঙ্গাপুর কিংবা যুক্তরাজ্য বিশেষ মূল্য দেয় বলেও জানান তিনি।

বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা বিদেশি কোম্পানির কাছে চলে যেতে পারে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এমডি বলেন, “বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনা ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিস বিষয় দুটি এক নয়। আমাদের সক্ষমতার কমতি কোথায়? থার্ড টার্মিনাল চালু হলে বিমানের সক্ষমতা আরও বাড়বে। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবার মান বাড়াতে আরও আধুনিক যন্ত্র কেনা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার জন্য বিমান প্রস্তুতি নিচ্ছে।”

গাউন্ড হ্যান্ডেলিং কর্মীদের ভুলের কারণে এর আগে বিমানের দুটো উড়োজাহাজের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, বোর্ডিং ব্রিজের ঘষাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আরেকটি বোয়িং। সম্প্রতি একটি বিদেশি এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজের ক্ষতি হয়েছে।

এগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, যে কর্মীর কারণে সম্প্রতি বিদেশি উড়োজাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবার আগে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

“আমাদের এখানে যদি কেউ দোষী প্রমাণিত হয় তবে তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হয়। কারণ আমাদের সবসময় অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থার নজরদারির মধ্যে থাকতে হয়, তারা নিয়মিত এসব অডিট করে। ৭-৮টা আন্তর্জাতিক এভিয়েশন সংস্থার সনদ আমাদের নিতে হয়।”

কোভিডের সময় সরকারের কাছ থেকে নেওয়া প্রণোদনার অর্থ ইতোমধ্যে সুদে আসলে পরিশোধ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারের যেসব সংস্থার কাছে বিমানের যেসব দেনা রয়েছে সবই চলমান।

এসময় তিনি জানান, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪১৯ কোটি টাকা লাভ করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ এয়ারলাইন্স।

পাইলট ও কেবিন ক্রুর বিষয়ে তদন্ত চলছে

সংবাদ সম্মেলনে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিমানের সিলেটগামী একটি ড্যাশ ৮ উড়োজাহাজ মাঝ আকাশে থাকা অবস্থায় ইঞ্জিনে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করা এবং পরে তা গোপনের অভিযোগ ওঠে এক পাইলটের বিরুদ্ধে। বিষয়টির তদন্ত চলছে জানিয়ে এমডি বলেন, সেদিন পাইলট টার্বুলেন্স এড়াতে ওপরে যাওয়ার পর সেখানে বরফ জমার সংকেত পান। এরপরই তাকে ইঞ্জিনের সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হয়।

এসময় তিনি উল্টো সাংবাদিকদের জিজ্ঞেস করেন, “এমন পরিস্থিতিতে আপনারা থাকলে কী করতেন। আগে উড়োজাহাজ বাঁচাতেন না মানুষের জীবন? ওই পাইলট এর আগেও সুনিশ্চিত দুর্ঘটনা থেকে উড়োজাহাজ ও মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন আমাদের ইমেজ বাঁচিয়েছেন। (সংবাদমাধ্যম) এমন করলে তো কোনো পাইলটই উড়োজাহাজ চালাতে চাইবে না।”

প্রটোকল অনুযায়ী ইঞ্জিনে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করার তথ্য যথাযথ মাধ্যমে জানানোর কথা ছিল পাইলটদের। ইঞ্জিনে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করলে অতিরিক্ত তাপে এর যন্ত্রাংশ গলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যে কারণে এ ধরনের পরিস্থিতিতে ইঞ্জিন পরীক্ষা না করে পরের ফ্লাইট চালানো হয় না। পাইলটরা তথ্য গোপন করায় ওই উড়োজাহাজ দিয়েই এরপরে আরও সাতটি ফ্লাইট পরিচালনা করা হয় বলে সংবাদমাধ্যমের খবর।

এসব বিষয় তদন্তে আসবে জানিয়ে এমডি বলেন, ধাপে ধাপে তদন্ত চলছে। সব বিষয়ই আসবে।

সম্প্রতি একজন কেবিন ক্রুর বিরুদ্ধে ফ্লাইটে ধুমপানের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি জানান, ভিডিওতে দেখা গেছে তিনি একটি ই-সিগারেট বের করেছিলেন। এ বিষয়েও তদন্ত চলছে।