খামার মালিকদের সমিতির হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি সপ্তাহে গড়ে উৎপাদন ও বিক্রি হচ্ছে ৮৫ লাখ সোনালি মুরগি।
Published : 13 Mar 2024, 12:47 AM
মহাখালী কাঁচা বাজার এলাকার একটি মুরগির দোকানে নাখালপাড়ার সেলিনা বেগম এসে বললেন, “পাকিস্তানি কক কত করে?”
দোকানির জবাব, “৩২০ টাকা কেজি।”
বাংলাদেশের বাজারে বহুল প্রচলিত নাম এই ‘পাকিস্তানি কক মুরগি’। কিন্তু আদতে এটি পাকিস্তানি জাত নয়। এটি বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞানীর উদ্ভাবন। এর নাম সোনালি।
দেশি মুরগির সংখ্যা কমে আসার পর দামে লাফ এবং ব্রয়লার মুরগির স্বাদ নিয়ে অনেকের নাক সিটকানোর মধ্যে মাঝামাঝি অবস্থানে এই সোনালি।
এর দাম ব্রয়লারের চেয়ে ৫০ শতাংশের মত বেশি, কিন্তু দেশি মুরগির প্রায় অর্ধেক। স্বাদে খানিকরা দেশি মুরগির মত। ঝোল করে রান্না করা যায়, আবার বিরিয়ানি, কাবাবেও জুড়ি নেই।
শুরুতে বাজার পেতে কয়েক বছর লেগে গেলেও এখন সোনালির আলাদা ভোক্তা শ্রেণি তৈরি হয়েছে। অতিথি আপ্যায়নেও এই মুরগির ব্যবহার বেড়েছে।
উদ্ভাবন যেভাবে
এই অঞ্চলে বিদেশি মুরগির জাত জনপ্রিয় করতে চেষ্টা শুরু হয় পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে। মুক্তিযুদ্ধের পরেও চলে সেই চেষ্টা।
দুটি জাত তৈরি করার চেষ্টা হয় বাংলাদেশে। ইতালির হোয়াইট লেগ মুরগির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ড রেড বা আরআইআর মোরগের সংকর করা শুরু হয়। নতুন জাতের নামকরণ দেওয়া হয় ককরেল।
উদ্ভাবন হয় সোনালি নামের মুরগিও।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সাজেদুল করিম সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা আসলে মিশরীয় ফাহমি এবং আরআইআর জাতের ক্রস বিডিং করে উৎপাদিত সংকর জাত।”
‘সোনালি জাতের মুরগির উদ্ভাবন ও অগ্রযাত্রার সাড়ে তিন দশক’ বইয়েও একই তথ্য দিয়েছেন পোল্ট্রি জেনেটিস্ট ড. বিবেক চন্দ্র রায়।
তিনি লিখেছেন, ১৯৮৬ সালে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মিরপুরের কেন্দ্রীয় সরকারি খামারে সে সময়ের উপ-পরিচালক মো আব্দুল জলিল আম্বরের নেতৃত্বে গবেষণায় মোট ২২টি জাতের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো হয়। এর মধ্যে সফল হয় ফাহমি ও আরআইআরএর সংকর জাতটি।
তখনো ব্রয়লার মুরগির বাজার একেবারেই ছোট। আশির দশকে এই মুরগি দেশে এলেও চাহিদা ছিল বেশ কম। তখনো দেশি মুরগিই মেটাত চাহিদা। কিন্তু জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে সেই চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
সোনালির উদ্ভাবনে কাজ করা আব্দুল জলিল আম্বর ২০০৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মারা যান বলে জানিয়েছেন তার ছেলে বদরুল আহসান।
পরে এই জাতের উন্নয়নে কাজ করেন কৃষিবিদ শাহ জামাল। তিনি জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ সরকারি ফার্মের সহকারী পরিচালক ছিলেন, ছিলেন পার্টিসিপেটরি লাইভস্টক ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (পিএলডিপি) নামে একটি প্রকল্পের গবেষক। নিজেও এখন খামার গড়ে তুলেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, মিরপুরের সরকারি ফার্মে প্রথম এই ক্রস বিডিং ট্রায়ালের পর এটা সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল। এটাকে ভোক্তা পর্যায়ে পুরোপুরি নিয়ে যাওয়া হয়নি।
কেন নেওয়া হয়নি- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “ক্রস বিডিং করার পর মোরগ হয় মিশরের জাতের রঙের, আর মুরগিটা হয়ে যায় সোনালি রঙের। তখন এর নাম দেওয়া হয় সোনালি মুরগি। এটা বাজারে চলেনি। না চলার কারণে এটার ট্রায়াল বন্ধ হয়ে যায়।”
এরপর ১৯৯৪ সালে পার্টিসিপেটরি লাইভস্টক ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (পিএলডিপি) নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়, যার প্রধান কার্যালয় ছিল রংপুর। রাজশাহী বিভাগের ১৬টি জেলায় এর কার্যক্রম চলে।
সে সময় এই প্রকল্পে কয়েকজন বিদেশি বিশেষজ্ঞ বিদেশি ১০টি এনজিওর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করেন। সে দলে ছিলেন শাহ জামালও।
তিনি বলেন, ২০০০ সালের দিকে মুরগির রঙ পুরোপুরি সোনালি হয়। তখন এই জাত জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ধীরে-ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে যায়।
কেন পাকিস্তানি কক বলা হয়?
লালচে বাদামি রঙের ও মাঝারি আকারের হয় এই মুরগি। প্রাপ্তবয়স্ক মুরগির গড় ওজন দেড় থেকে সোয়া দুই কেজি পর্যন্ত। নিবিড় পালন পদ্ধতিতে এই মুরগি বছরে ১৯০ থেকে ২০০টি ডিম দেয়। সহজে কুঁচে বা ব্রুডি হয় না।
সাধারণত ২০ থেকে ২১ সপ্তাহ বয়সে প্রথম ডিম পাড়া শুরু হয় এবং সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৩৪ সপ্তাহ পর্যন্ত ডিম দেয়।
কেন এই মুরগিকে পাকিস্তানি কক বলা হয় এই প্রশ্নে শাহ জামাল বলেন, “ট্রায়ালের এক পর্যায়ে মিশর থেকে না এনে মুরগির বাচ্চা পাকিস্তান থেকে আনা হয়েছিল। মিশরের জাত হলেও পাকিস্তান থেকে আনার জন্য তখন থেকে এটাকে অনেকেই পাকিস্তানি কক বলা শুরু করে।”
চাহিদা কেমন?
বেসরকারি খামার মালিকদের সমিতির হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি সপ্তাহে গড়ে উৎপাদন ও বিক্রি হচ্ছে ৮৫ লাখ সোনালি মুরগি।
প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রতিদিন অন্তত ৯ লাখ সোনালি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের বিক্রেতা ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, “দেখতে এবং স্বাদেও দেশি মুরগির মত হওয়ায় বাজারে সোনালি বেশি চলে। ক্রেতারা বলে এই মুরগির স্বাদ বেশি।”
একই বাজারে মুরগি কিনতে আসা জাফরুল হাসান বলেন, “বাসায় মেহমান আসবে। ব্রয়লার মুরগির তো টিপিক্যাল স্বাদ, পছন্দ করবেন না উনারা। সোনালি মুরগির স্বাদটা তুলনামূলক একটু ভালো। এজন্য এই মুরগি কিনলাম। এই মাংস দেশি মুরগির মত কিছুটা শক্ত এবং খেতেও দেশি মুরগির কাছাকাছি।”
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (উৎপাদন) এ বি এম খালেদুজ্জামান বলেন, “২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি মুরগির খামারে ৩৮ লাখ ৬৬ হাজার সোনালি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করে বিতরণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ২০ লাখ ৬৫ হাজার বাচ্চা উৎপাদন করা হয়েছে। বাকি ৬ মাসে আরও ২০ লাখ বাচ্চা উৎপাদন হতে পারে।”
সোনালি মুরগির স্বাদ বা পুষ্টিগুণ বেশি হওয়াই কি এর জনপ্রিয়তার কারণ?- এই প্রশ্নে খালেদুজ্জামান বলেন, “এটা আসলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। কিছুটা অভ্যাস। এর সঙ্গে একেবারে সরাসরি পুষ্টিগুণের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে। বাজারে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত সব মুরগির পুষ্টিগুণ প্রায় একই।
“বাড়তি কিছু (স্বাদ, পুষ্টিগুণ) হয়ত কেউ-কেউ পেতে পারেন। খাদ্য ব্যবস্থাপনার ফলে মাংসের ফ্যাট ডেভেলপমেন্ট ঠিকঠাকভাবে হয়। আর বাংলাদেশে রঙিন মুরগির প্রতি আকর্ষণ থাকে মানুষের। সে জায়গা থেকেও সোনালির চাহিদা বেড়েছে।”