বেনারসির বুনন এই ঈদেও বুনছে না আনন্দ

মহামারী ঠেকানোর লকডাউনের মধ্যে রোজার ঈদের আগে রাজধানীর অন্যান্য বিপণিবিতানে জমিয়ে বিক্রি চললেও মিরপুরের বেনারসি পল্লীতে ক্রেতার অভাবে হাহাকার চলছে।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 May 2021, 03:06 AM
Updated : 8 May 2021, 03:18 AM

মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ আর ভারতীয় ভিসা সহজ হওয়ার কারণে কয়েক বছর ধরেই বিক্রি কমে যাওয়ার কথা বলে আসছিলেন এখানকার বিক্রেতারা।

এর মধ্যে গত বছরও মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কারণে ঈদ ভালো যায়নি তাদের। এবার তা পুষিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা সাজালেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সব হিসাব উলটপালট করে দিয়েছে।

ঈদের কেনাকাটায় ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে ওঠার যে আশা দেখছিলেন বিক্রেতারা, ‘তার গুঁড়ে বালি’। উল্টো এখন কি পরিমাণ লোকসান হয় সেই চিন্তায় রয়েছেন তারা।

শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মিরপুরে ১০ নম্বর গোল চত্বর এলাকার পাশে অবস্থিত এই বেনারসি পল্লীতে ঐতিহ্যবাহী বেনারসিসহ সব ধরনের শাড়ির পসরা সাজিয়েছেন বিক্রেতারা।

দোকানের সামনে কর্মীরা হাঁকডাক করলেও ক্রেতা খুবই কম। ফলে অনেক দোকানিই পার করছেন অলস সময়।

বিক্রয়কর্মীরা জানান, বিয়েসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় এক বছর ধরেই তাদের বিক্রি কম। এবার ঈদেও ক্রেতার দেখা মিলছে না।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে এবার উচ্চবিত্ত ক্রেতাদের তারা পাচ্ছেন না। আর আর্থিক সঙ্কটের কারণে মধ্যবিত্তরাও আসছেন কম।

বেনারসি পল্লীর নীল আঁচল শাড়িজ-এর ব্যবস্থাপক মো. মামুন বলেন, অন্যান্য ঈদের তুলনায় এবার বেচাবিক্রি ‘একেবারে নেই’।

“বিক্রি অনেক কম। প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার শাড়িও বিক্রি করতে পারছি না। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে কাস্টমার আসে না। মানুষের মনে তৃপ্তিও নাই। তৃপ্তি নিয়ে যে একটা উৎসব করবে, সে ব্যাপারটা নাই। গত বছর দোকানদারি করতেই পারি নাই। এই বছরও সেরকম অবস্থা।”

পল্লীর মধ্যে বেশ বড় দোকানের এই ব্যবস্থাপক বলেন, “আমাদের মতো বড় দোকানগুলোতে কিছু শাড়ি তাও বিক্রি হচ্ছে, ছোট দোকানগুলোতে বিক্রি একেবারেই নেই।”

এ কারণে ‘সীমিত লাভে’ শাড়ি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানান মামুন।

ক্রেতা খরা নিয়ে হতাশার সুর লাল বউ বেনারসির বিক্রয়কর্মী মহসীন রেজারও।

“রোজায় একেবারেই বিক্রি নাই। একে তো করোনাভাইরাস, তার ওপর লকডাউন। আর সব মিলিয়ে মানুষের হাতে অর্থ নাই, শাড়ি কিনবে কীভাবে?”

এই দোকানের মালিক এফ হেলাল উদ্দীন আহম্মেদ বলেন, “শাড়ি ব্যবসায়ী বা কাপড় ব্যবসায়ীরা সাধারণত ঈদের উপর নির্ভরশীল থাকে। ঈদের সময় একটা ভালো বেচাকেনা হয়, সারা বছর কোনো রকম খেয়ে পরে থাকে। সেই জায়গায় গত বছরের পর এবারও খারাপ অবস্থা।”

বিয়ের অনুষ্ঠান কমে যাওয়ায় তাদের আরও বেশি সঙ্কটে ফেলেছে বলে জানান তিনি।

অনলাইনে বিক্রি বেড়ে যাওয়ার ধাক্কাও বেনারসি পল্লীতে পড়েছে বলে মনে করেন তাওসিফ বেনারসি ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম।

“করোনাভাইরাসের কারণে এখন ভিআইপি কাস্টমাররা বের হচ্ছে না। তারা অনলাইনে বসেই কেনাকাটা করছেন। আবার সাধারণ যারা, তারা বিলাসিতা বাদ দিয়ে খাবারের চিন্তা করছেন।”

মনে রেখ শাড়িজ’র ব্যবস্থাপক মাসুদ কবির লিটনের কাছে বিক্রির হাল জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার ২২ বছরের কর্মজীবনে এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতি আগে দেখেননি।

“এখন আর এগুলা নিয়ে কথাই বলতে ইচ্ছা করে না। মানুষের হাতে তো টাকা নাই। কিনবে কী করে? আগে কাস্টমারের কারণে কথা বলার সুযোগও হত না। আর এখন কাস্টমারের অপেক্ষায় সময় পার করতে হচ্ছে।”

“আগে একদিনে একজন কাস্টমারের কাছে যে বিক্রি হত, এখন সারাদিনে সেই বিক্রি হচ্ছে। আগের তুলনায় ২৫ শতাংশও বিক্রি হচ্ছে না,” হিসাব দেখান তিনি।

বোনাস অনিশ্চিত, চলছে ছাঁটাই

দোকানে বিক্রি কমে যাওয়ায় কর্মী ছাঁটাই চলছে। আর যেসব কর্মচারী রয়েছেন, তাদের ঈদ বোনাস পাওয়াও অনিশ্চিত।

তাওসিফ বেনারসি ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম জানান, নিজেদের ১৮ জন কর্মীর মধ্যে ৯ জনকে মহামারীর মধ্যে ছাঁটাই করতে হয়েছে।

“একেবারেই বিক্রি নাই। বিক্রি না হলে মালিক বেতন দেবে কীভাবে? বিক্রির উপর নির্ভর করে বেতনটা। আর বোনাস দিতে পারবে কি না, জানি না। অন্যান্য দোকানেও একই অবস্থা।”

করোনাভাইরাস সঙ্কটের কারণে দোকানকর্মীদের অনেকে অন্য পেশায় চলে গেছেন বলেও জানান খোরশেদ।

বিক্রি কমে যাওয়ায় নিজেদের ৪ জন কর্মীকে ছাঁটাই করতে হয়েছে বলে জানান মনে রেখ শাড়িজ’র ম্যানেজার মাসুদ কবির লিটন।

কর্মীদের বেতন-বোনাস দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে জানিয়ে লাল বউ বেনারসির মালিক এফ হেলাল উদ্দীন আহম্মেদ বলেন, “ব্যবসা কম, তাই কর্মীদের বেতন-বোনাস দিতে চিন্তায় আছি। দোকান ভাড়া আছে। অন্যান্য খরচ আছে। আমাদের সমস্যাই হচ্ছে।”

দিয়া শাড়িজ’র মালিক মোহাম্মদ কাশেম বলেন, অনেক মালিকই এবার কর্মীদের বেতন-বোনাস নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছে।

“গত বছর যখন সবকিছু বন্ধ ছিল, আমরা তখন ৫০ ভাগ বেতন দিয়েছি। বোনাস তো দূরের কথা। তারপর আস্তে আস্তে যখন স্বাভাবিক হল, তখন ১০০ ভাগ বেতন দিয়েছি আমরা। এবার আমরা বেতন-বোনাস দুটোই দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একে তো লকডাউন আবার ভ্যাটের কারণে আমাদের বিপর্যয় নেমেছে।”

ভ্যাটও ‘দায়ী’, সরকারের নজর প্রত্যাশা

বেনারসি পল্লীর দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ কাশেমের দাবি, ভ্যাট আতঙ্কেও অনেক ক্রেতা বেনারসি পল্লীতে আসছেন না।

তিনি বলেন, “গাউছিয়া, নিউ মার্কেট, বসুন্ধরা সিটিতে অনেক ভিড়। সেখানে কি করোনা নাই? আমাদের এখানে তাহলে কাস্টমার নাই কেন? ভ্যাটের কারণেই কাস্টমাররা বেনারসি পল্লী বিমুখ হয়েছে।”

তাওসিফ বেনারসি ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম বলেন, “আজকে (ঈদের আগে) শেষ শুক্রবার, সেই অনুযায়ী বিক্রিটা বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই অনুপাতে তেমন বিক্রি হয় নাই। অথচ এটা এত বড় মার্কেট, এখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাকাটা করা সহজ। তারপরও এখানে কাস্টমার নাই।”

দ্রুত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে কাশেম বলেন, “দেশীয় শাড়িতে ভ্যাট না নিলে ক্রেতা ও তাঁতিরা উৎসাহ পাবে। দেশে উৎপাদিত পণ্য বেশি বিক্রি হবে।”

“আমাদের ৫০ বছরের বেনারসি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকার কি কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? ভারতে বেনারসি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে তো তাদের সরকার অনেক কিছু করছে,” বলেন তিনি।

লাল বউ বেনারসির মালিক হেলাল উদ্দীন বলেন, গত এক বছরে অনেক ব্যবসায়ী ‘পথে বসে গেছেন’।

“যারা স্বল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করেন, তাদের অনেকের ব্যবসাই বন্ধ হয়ে গেছে। আর আমরা কোন রকম আছি। এ অবস্থা যদি চলতে থাকে, আমরাও সমস্যায় পড়ে যাব।”

সরকারের সুদৃষ্টি চেয়ে তিনি বলেন, “আমাদের দিকে সরকার যদি সদয় দৃষ্টি দিতেন।

“অনেক ব্যবসায়ীদেরই তো সরকার সুবিধা দিয়েছে। লোনের মাধ্যমে হোক বা যে কোনোভাবে সহযোগিতা করলে ব্যবসায়ীদের উপকার হত।”