দেশে এখন পেঁয়াজের মজুদ যথেষ্ট আছে বলেও দাবি করেছেন তাদের কেউ কেউ; অন্য দিকে মজুদের ঘাটতিই যে সঙ্কটের কারণ, সেই কথাও এসেছে।
পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে রোববার নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর আয়োজনে এক বৈঠকে এক হন সংশ্লিষ্ট সবাই।
ঢাকার মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনে এই বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার, ট্যারিফ কমিশনের সদস্য আবু রায়হান আলবেরুনী ও এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া।
এফসিসিআই যেদিন এই বৈঠকটি করছিল, সেদিন ঢাকার বিভিন্ন বাজারে গিয়ে দোকানগুলোতে পেঁয়াজের মজুদ দেখা গেছে কম। দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল প্রতি কেজি ২০০ টাকার বেশি, আমদানি করা পেঁয়াজ ছিল ১৪০ টাকার আশপাশে।
বৈঠকে ট্যারিফ কমিশনের সদস্য আবু রায়হান ও এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ দুজনই দাবি করেন, পেঁয়াজের মজুদ যথেষ্ট আছে।
আবু রায়হান আলবেরুনী বলেন, সারা বছর পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন, রমজানে অতিরিক্ত দুই লাখ টন মিলিয়ে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ লাখ টন।
গত ৭ সাত বছরের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। যার ৯৭ থেকে ৯৮ শতাংশ আসে ভারত থেকে।
গত অর্থবছরের সঙ্গে এই অর্থবছররের চলতি সময় যোগ করে মোট ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির তথ্য দিয়ে ট্যারিফ কমিশনের এই সদস্য বলেন, “আমাদের মজুদ-আমদানি পর্যাপ্ত অবস্থায় রয়েছে।”
এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন বলেন, “বাজারে কোনো দ্রব্যের সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। পেঁয়াজের কথাই বলেন, আর যা বলেন। পেঁয়াজ বাজারে পর্যাপ্ত আছে তো।”
পেঁয়াজ না পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কারসাজির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “বাজারে কী আমদানি হয়েছে, কোথায় বিক্রি হয়েছে, এগুলোর তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে।
“আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছি। সোজা মেসেজ দেওয়া হয়েছে। যদি কেউ মজুদ করে, অহেতুক চাপ বৃদ্ধি করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে এই কর্মকর্তাদের বক্তব্যের সঙ্গে ঢাকার খুচরা দোকান ও আড়তগুলোর চিত্রের মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মিরপুর শাহ আলী মার্কেটে পেঁয়াজের পাইকারি দোকান সততা বাণিজ্যালয়ের পরিচালক আব্দুল লতিফ মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত দুদিন ধরে তার আড়তে কোনো পেঁয়াজের জোগান নেই।
তিনি বলেন, এর আগের সপ্তাহে কিছু পেঁয়াজ ছিল। কিন্তু সেগুলো বিক্রি হয়েছে প্রতিদিন এক বস্তা কিংবা দুই বস্তা করে, যদিও আগে প্রতিদিন ৫০ বস্তা থেকে ১০০ বস্তা পর্যন্ত পেঁয়াজ বিক্রি হত।
এবার গত সপ্তাহে বাধ্য হয়ে কেনা দামের চেয়ে ৪০ টাকা ছাড় দিয়ে পেঁয়াজ বিক্রি করেন বলে দাবি করেন রতিফ মোল্লা।
শাহ আলী মার্কেটে কিছঠু দোকানে মিশর-তুরস্কের পেঁয়াজ ছিল, যা বিক্রি হচ্ছিল প্রতিকেজি ১২০ টাকা দরে।
এছাড়া অনেক দোকানে পেঁয়াজ বিক্রির স্থানটি শূন্য পড়ে আছে। কিছু কিছু দোকানে মিশর-তুরস্কের বড় আকারের পেঁয়াজ রয়েছে। দাম চাওয়া হচ্ছে প্রতিকেজি ১৩০ টাকা থেকে ১৪০ টাকা।
ঢাকায় পেঁয়াজের প্রধান পাইকারি কেন্দ্র শ্যামবাজারের আমানত ভাণ্ডারের বিক্রেতা আব্দুর রাজ্জাক খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত কয়েকদিন ধরে তার আড়তেও পেঁয়াজের জোগান নেই।
“গ্রামের হাঁটগুলোতে প্রতি মণ পেঁয়াজের দাম চাওয়া হচ্ছে ৮ হাজার টাকা থেকে ৯ হাজার টাকার মধ্যে। প্রতিদিনই দাম বাড়ছে।”
রোববারই পাবনা ও রাজবাড়ির একাধিক হাট থেকে প্রতিকেজি ২৩০ টাকা দরে পেঁয়াজ কেনার কথা জানান লতিফ মোল্লা।
তিনি বলেন, “হাটে একজন কৃষক এক বস্তা পেঁয়াজ নিয়ে আসলে তাকে ৮/১০ জন ব্যাপারী ঘিরে ধরে। তাহলে দাম না বাড়িয়ে উপায় কী?”
এফবিসিসিআইর বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও সরকারি দুই কর্মকর্তার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে বলেন, জোগানে ঘাটতিই পেঁয়াজ সঙ্কটের কারণ।
তিনি বলেন, গত ৭ বছরে দেখা গেছে মওসুমের শেষ দিকে এসে এক লাখ টনেরও বেশি পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। এর ৯৫ হাজার টন ভারত থেকে আসত, আর ৫ হাজার টন অন্য দেশ থেকে আসত।
“ভারত বন্ধ হওয়ার পর এই মাসে ২৫ হাজার টন পেঁয়াজ এসেছে। তার মানে প্রায় ৭৫ হাজার টন আমাদের ঘাটতি ছিল।”
গত সেপ্টেম্বরে ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম এক লাফে একশ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
এরপর সরকারের নানা উদ্যোগে সামান্য কমলেও ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পর পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে দুদিনের মধ্যে দেড়শ থেকে ১৮০ টাকায় উঠে যায়। এরপর সপ্তাহ পার না হতেই আড়াইশ টাকায় উঠে যায় পেঁয়াজের কেজি।
বাজার সামাল দিতে মিয়ানমার, চীন, তুরস্ক, মিশর থেকে পেঁয়াজ আমদানির পর শুরুতে দাম কমলেও পরে আবার বেড়ে যায়। আশা করা হচ্ছে, সপ্তাহ খানেকের মধ্যে দেশের ফলন উঠলে দাম কমে আসবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, “আমাদের চাহিদা হচ্ছে ২৪ থেকে ২৫ লাখ টন। সেই হিসাবে ৭/৮ লাখ টন পেঁয়াজের ঘাটতি আছে। আমরা যদি ক্যালকুলেশনের জন্য ২৪ লাখ টন ধরে নিই, তাহলে প্রতিমাসে কনজাম্পশন (ভোক্তা চাহিদা) হচ্ছে দুই লাখ টন। প্রতিমাসে গড়ে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টন আমদানি করতে হয়। এই আমদানিটা বেড়ে যায় বছরের শেষের দিকে যখন আমাদের পেঁয়াজ মাঠে থাকে।
২০১৮ সালের হিসাব দেখিয়ে তিনি বলেন, গত বছর সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর মাসে গড়ে এক লাখ টন করে আমদানি হয়েছিল, আবার দেশি পেঁয়াজ ক্ষেত থেকে তোলার পর আমদানি ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টনে নেমে আসে।
এবারের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে টিপু মুনশি বলেন, “দাম বাড়ার বিষয়ে বলি, ভারতের কাছ থেকে প্রায় ৯০ ভাগ পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। সেই ভারত বন্ধ করে দিল। তার পরদিনই দাম বাড়তে শুরু করে।”
তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী টিপু মুনশি এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের দায় না দিলেও বলেন, “অসাধুও বলতে চাই না, কারসাজিও বলতে চাইনা। তবে যেদিন তারা (ভারত) বন্ধ করল, তার পরের দিনই দামটা বাড়ল কেন? যারা বাড়িয়েছে, তারা ঠিক কাজ করেনি।”
তখন বাজারে অভিযান চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালানোর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “বেশ কয়েকজনকে জেলও দিয়েছি। সব দিকেই চিন্তা করতে হয়েছে। যত বেশি চাপ দেব, তাতে যদি উল্টা রিয়েকেশন হয়, সেদিকেও নজর রাখতে হয়েছে।”
ভারত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে রপ্তানি বন্ধ করলেও অক্টোবরের শেষ দিকে আবার খুলে দেবে বলে আশায় ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী; কিন্তু তার আশা ফলেনি। তখন অন্য দেশের দিকে নজর ফেরাতে হয়েছে, ততদিনে দাম আড়াইশ টাকায় উঠে গেছে।
টিপু মুনশি বলেন, “আমরা নতুন বাজার থেকে আনার চেষ্টা করেছি। কারণ কেবল মিয়ানমার দিয়ে আমাদের হচ্ছিল না। সিটি গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপের মতো বড় ব্যবসায়ীদের বললাম, আপনারা যে দেশ থেকেই হোক পেঁয়াজ নিয়ে আসেন।”
মিশরে ও তুরস্ক থেকে জাহাজে পেঁয়াজ আনতে দেরি হবে বলে বিমানে আনার ব্যবস্থা করা হয় বলে জানান তিনি।
“আমার ধারণা ছিল না যে জাহাজ আসতে এত দেরি হবে। তারপর যখন দেখলাম সময় লাগছে, তখন আমি ছিলাম অস্ট্রেলিয়াতে। আমি ওখান থেকে বললাম, তাহলে উড়োজাহাজে যেন পেঁয়াজ আনার ব্যবস্থা করা হয়। তাহলে অন্তত ঢাকা ও আশপাশের জেলা কাভার হয়ে যাবে।”
উড়োজাহাজে ইতোমধ্যে ৩/৪শ টন পেঁয়াজ চলে এসেছে জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আগামী ২৯ নভেম্বর মিশর থেকেও জাহাজে পেঁয়াজ চলে আসবে।
আর সীমান্ত এলাকায় যে কোনোভাবেই হোক ভারত থেকে কিছু পেঁয়াজ আসবে বলে ধরে নিচ্ছেন তিনি।
সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে টিপু মুনশি ভারতের রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়াকে প্রধান কারণ হিসেকবে দেখিয়ে বলেন, “সত্যি কথা বলতে আমাদের যা লাগবে, তার সবই আমাদের স্টকে আছে, সেটা বললে ঠিক বলা হবে না।। তাহলে এই স্ট্যাটিসটিকস কেন দিলাম।”