বুধবার সকালে হোটেল টোকিওর নিউ অটানিতে বাংলাদেশ-জাপান বিজনেস ফোরামের (বিজেবিএফ) বৈঠকে তিনি দুই দেশের মধ্যকার সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য সম্পর্ককে উচ্চতর পর্যায়ে নেওয়ার আহ্বান জানান।
একইসঙ্গে জাপানের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের নতুন নতুন খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। জাপানের ব্যবসায়ীরা শেখ হাসিনার নেতত্বে বাংলাদেশের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির উচ্চ প্রশংসা করেন এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে নেওয়া বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করেন।
তিন বছর আগে ২০১৬ সালে জাপান সফরের সময় জাপানের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এরপর থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বেড়েছে এবং জাপানের অনেক ব্যবসায়ী বাংলাদেশে ব্যবসায় আগ্রহী হয়েছে।
“এসব কোম্পানিগুলো বাণিজ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নেও যুক্ত হয়েছে। এশিয়ার মধ্যে জাপান এখন বাংলাদেশের কাছে সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার।”
শেখ হাসিনা জানান, তার সরকারের নেওয়া সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক ব্যবস্থাপনা, বেসরকারি খাতের জন্য স্থিতিশীল নীতি সহায়তা এবং অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ বাংলাদেশের সফলতায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
“এসব কারণেই নমিনাল জিডিপির ভিত্তিতে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় এবং বিশ্বের ৪১তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। এবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। আর এভাবে যদি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি শিগগিরই দুই অংকের ঘরে পৌঁছবে বলে আমাদের আত্মবিশ্বাসী।”
বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ নিরীক্ষা সংস্থা প্রাইসওয়াটারহাউজকুপারসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালে অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের ৩২টি বৃহত্তম ও শক্তিশালী দেশের কাতারে থাকবে বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনা বলেন, ব্যাপক শিল্প বিস্তারের ফলে পাঁচ বছরের মধ্যে রপ্তানি দ্বিগুণ হয়ে ৩৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। দ্য ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশকে দ্রুত বর্ধনশীল সোর্সিং কান্ট্রি, পণ্য উৎপাদন ও বিতরণ হাব এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি হওয়া অর্থনীতির দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
জাপান এক্সাটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় জানিয়েছে, ভবিষ্যতে জাপানি কোম্পানিগুলো যেসব অঞ্চলে ব্যবসার সম্প্রসারণ করবে তার মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
বেসরকারি খাতকে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান শক্তি উল্লেখ প্রধানমন্ত্রী বলেন, উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং দেশি, বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপানি বিনিয়োগের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে।
মহেশখালী-মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি হাব তৈরির লক্ষ্যে ‘ইনটিগ্রেটেড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ ফর লজিস্টিক হাব’ এ জাপান হয়তো সহায়তা করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
দুটি সফটওয়্যার পার্কে কাজ শুরু হয়েছে এবং ২৬টি হাইটেক পার্ক তৈরির কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ার আমাদের রয়েছে অন্যতম উদার বিদেশি বিনিয়োগের ব্যবস্থা।”
আইন করে বিদেশি বিনিয়োগের সুরক্ষার ব্যবস্থা, কর সুবিধা, যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক সুবিধা, শতভাগ বিদেশি ইক্যুইটির সুবিধা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডার মতো বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকারের সুবিধার কথা তুলে ধরেন তিনি।
তিনি বলেন, ব্যবসার খরচ, মানবসম্পদ, অভ্যন্তরীণ বাজারের আকার, বিশ্ব বাজারে পণ্যের প্রবেশাধিকার, বাণিজ্য সুবিধা, বিনিয়োগ সুরক্ষা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিচারে বিশ্বের অন্যতম প্রতিযোগী বিনিয়োগ গন্তব্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।
“তৈরি পোশাক খাতে আমাদের সফলতা বিশ্ববাসীর জানা আছে। আমরা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশ থেকে জাপানে রপ্তানি পণ্যের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে তৈরি পোশাক। আমরা রপ্তানি পণ্যের বহুমূখীকরণ করছি। এজন্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিযোগ্য নতুন খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছি।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের আরেকটি প্রতিশ্রুতিশীল খাত হলো সফটওয়্যার। দেশের ৮০০ আইটি ও সফটওয়্যার কোম্পানির মধ্যে ১৫০টির বেশি কোম্পানি বিদেশি গ্রাহকদের সেবা দিচ্ছে। ২০ হাজারে বেশি বাংলাদেশি আইটি পেশাদার বিশ্বের নামকরা কোম্পানি যেমন – মাইক্রোসফট, ইনটেল, আইবিএমে কাজ করছে।”
এছাড়া বাংলাদেশের তৈরি চামড়াজাত পণ্য, কৃষিভিত্তিক পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য এবং ইলেকট্রনিক গ্যাজেটও বিশ্ব বাজারের নজরে রয়েছে। পরিবেশবান্ধব পাটপণ্যের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর জাপানের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেন।
অনুষ্ঠানে জাপানের নয়জন ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী বক্তব্য দেন। এদের মধ্যে ছিলেন- জাপান বাংলাদেশ কমিটি ফর কমার্সিয়াল অ্যান্ড কোপারেশনের চেয়ারম্যান টেরাও আসাদা, জাইকার এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, জেত্রোর প্রেসিডেন্ট, সুমিহিতো করপোরেশনের প্রেসিডেন্ট ও সিইও, মিৎসুই অ্যান্ড কোং লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, সোজিৎস করপোরেশনের সিনিয়র ম্যানেজিং এক্সিকিউটিভ অফিসার, মিৎসুবিসি মটরসের ভাইস প্রেসিডেন্ট, হোন্ডা মটরসের ম্যানেজিং অফিসার এবং মারুহিসা করপোরেশনের প্রেসিডেন্ট।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে বক্তব্য দেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক, এমসিসিআইয়ের সভাপতি নিহাদ কবির।
অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তাফা কামাল, প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব নজিবুর রহমান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
জাপানের বাংলাদেশ দুতাবাসের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ জাপানি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। অনূদিত বই অনুষ্ঠানে বিতরণ করা হয়।
সামিট গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি
বাংলাদেশের সামিট গ্রুপ এবং জাপানস এনার্জি ফর নিউ এরার মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
বুধবার টোকিওতে হোটেল নিউ অটানিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এ সমঝোতা স্মারক সই হয়।
সামিট গ্রুপের ফয়সাল করিম খান এবং নিউ এরার পক্ষে তোশিরো কোডোমা সমঝোতা স্মারকে সই করেন।
জাপান-বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট তার সংগঠন এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মধ্যে সই হওয়া চুক্তিপত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করেন।
শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিকে সহায়তার বিষয়ে এই চুক্তি সই হয়েছিল।