যদি বন্ধু হই, আসুন ব্যবসা বাড়াই: ভুটানের প্রধানমন্ত্রী

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ভুটানের সঙ্গে ব্যবসা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং, যিনি হিমালয় কোলের ওই স্থলবেষ্টিত দেশে ব্যক্তি খাতের বিকাশ ঘটাতে চান।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 April 2019, 03:27 PM
Updated : 14 April 2019, 10:23 AM

তার বিশ্বাস, বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভুটান সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সাবেক ছাত্র ডা. শেরিংয়ের হৃদয়ে একটি বিশেষ জায়গা জুড়ে আছে বাংলাদেশ।

গতবছর ৭ নভেম্বর নিজের দেশে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমবার বাংলাদেশ সফরে এসে শুক্রবার বিকালে তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন এ দেশের ব্যবসায়ীদের।

ঢাকার একটি হোটেলে ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমার দেশ স্থলবেষ্টিত, তা সত্যি। কিন্তু বন্ধুরা, আমাদের হৃদয় বন্ধ নয়। ব্যবসার জন্য আমাদের দুয়ার উন্মুক্ত।”

বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নেতাদের উদ্দেশে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশ যদি মনে করে যে ভুটানিরা তাদের কাছের মানুষ, আমার মনে হয়, আপনাদের এগিয়ে আসা উচিৎ।”

৩০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে শুক্রবার সকালে ঢাকা পৌঁছান ভুটানের প্রধানমন্ত্রী।

গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর এটিই বিদেশি কোনো সরকারপ্রধানের প্রথম বাংলাদেশ সফর।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর সবার আগে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল ভুটান। সে কারণে দুই দেশের সব সময়ই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। 

কিন্তু ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, “এটা যথেষ্ট নয়”।

“আমাদের মধ্যে বাণিজ্য বৈষম্য এত বেশি কেন? আমি শুনেছি আপনাদের রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু ভুটানে আপনারা রপ্তানি করেন মাত্র ৩ মিলিয়ন ডলারের।  

“আমরা যদি সত্যিই ঘনিষ্ঠ হই, আমার মনে হয় আমাদের ব্যবসাটা বাড়ানো উচিৎ। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এখন যেটা আছে তা যথেষ্ট নয়।”

বাংলাদেশের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের এই আয়োজনে এই অনুষ্ঠানে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মূল বক্তা। 

অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, এফবিসিসিআই সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, সহ-সভাপতি মো. মুনতাকিম আশরাফ, ভুটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট ফুব জাম এ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।

আগামী দিনগুলোতে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে এ অনুষ্ঠানে দুই দেশের শিল্প ও বণিক সমিতির মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়।

লোটে শেরিং মনে করেন, সমঝোতার পর যদি কোনো উদ্যোগ না থাকে, আন্তরিকতা যদি না থাকে, তাহলে ওই সমঝোতা স্মারকও কোনো অর্থ বহন করবে না।

“ভুটান সরকারের তরফ থেকে বলব, এই সমঝোতার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ যাতে নেওয়া হয়, আমাদের দিক থেকে আমরা তা নিশ্চিত করব। আমরা যা বলছি, তা যেন কাজের রূপ পায়, তা আমি দেখব।” 

এ বিষয়ে মনে কোনো দ্বিধা নিয়ে কারও যাতে ফিরতে না হয়, সেজন্য অনির্ধারিতভাবেই তিনি নিজের বক্তৃতার পর প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য আলোচনা উন্মুক্ত করে দেন।

প্রধানমন্ত্রী শেরিং বলেন, “আপনাদের আমি বাণিজ্য বাড়াতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাব। সবার আগে আমাদের মনকে উন্মুক্ত করতে হবে; নিশ্চিত করতে হবে, মনে যাতে কোনো দ্বিধা না থাকে।

“যদি খোলা মন নিয়ে এগিয়ে আসতে পারি, আমার বিশ্বাস, কোনো বাধাই আর বাধা হবে না। নানাভাবে আমরা বাণিজ্যটা বাড়িয়ে নিতে পারব।”

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষ এখন ব্যবসার পিপিপি মডেল নিয়ে কথা বলে। এর মানে হল ‘পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ’ (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব)।

“কিন্তু আমার কাছে এর মানে হল, পজিটিভ পিপল টু পিপল কন্টাক্ট (মানুষে মানুষে ইতিবাচক যোগাযোগ)।… চলুন, আমরা আগে সেই যোগাযোগটাই বাস্তবে পরিণত করি। তখন আমরা বলতে পারব যে আমরা বন্ধু দেশ, আমাদের জনগণও পরস্পরের বন্ধু।” 

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা সব পক্ষের ব্যবসার জন্য অনুকূল একটি পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছি। আপনারা যদি একমত হন, এটা যদি আপনাদের পছন্দ হয়, আমার মনে হয়, আমাদের তা কাজে দেখানো উচিৎ।” 

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অষ্টাদশ ব্যাচের ছাত্র ডা. লোটে শেরিং এমবিবিএস পাস করার পর বাংলাদেশেই সার্জারিতে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। দেশে ফিরে যোগ দেন চিকিৎসকের পেশায়।

সরকারি চাকরি ছেড়ে ২০১৩ সালে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যেই তার দল ডিএনটি চমক সৃষ্টি করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ডিএনটি জয়ী হলে ডা. শেরিং হন ভুটানের নতুন প্রধানমন্ত্রী। 

তিনি বলেন, সরকার গঠনের পর থেকেই তারা ‘আসল কাজে’ হাত দেওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

ভুটানের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী টান্ডি দর্জিও ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন জানিয়ে লোটে শেরিং বলেন, হোস্টেলে তারা থাকতেন একই কক্ষে।

আর সেই সম্পর্ককে বাংলাদেশ ভুটান সম্পর্কের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি বলেন, “আমরা প্রায় একই সময়ে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে ওঠার পরীক্ষায় পাস করতে যাচ্ছি। আর তা যখন হবে, আমরা আর বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে পরব না। ব্যবসা কী করে করতে হয়, সেটা আমাদের শিখতেই হবে।

“অনুদানের অংককে এখন আমাদের পরিণত করতে হবে বাণিজ্যে। দাতারা এতদিন আমাদের যেভাবে সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে আসছিল, সেখান থেকে তারা এখন সরে যাবে। কাজেই, চলুন, ব্যবসাটা আমরা একসঙ্গে করি।”

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ভুটানে বিনিয়োগ করার উৎসাহ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেরিং বলেন, তাদের ব্যক্তি খাত ভালো করার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করছে। সরকারও বেসরকারি খাতের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

“আমরা আমাদের বিদেশি বিনিয়োগ নেওয়ার নীতিমালা পর্যালোচনা করছি। সেই সঙ্গে আমরা এসএমই নীতিমালাও পর্যালোচনা করছি, কারণ বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা আমাদের সঙ্গে কাজ করতে যেন স্বস্তি বোধ করেন, সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।” 

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা যখন প্রতিবেশী দেশগুলোতে ব্যবসা করতে স্বস্তি বোধ করবেন, তখনই আমরা বলতে পারব- আমরা সত্যিই ভালো বন্ধু। দেশ হিসেবে আমরা নিতান্তই ক্ষুদ্র, আমরা স্থলবেষ্টিত, কিন্তু আমাদের মন খোলা।”

ডা. শেরিংয়ের মতে, বাংলাদেশ ও ভুটান অনেক ক্ষেত্রেই এ্কসঙ্গে কাজ করতে পারে। এখনও অনেক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র আছে, যেগুলো যাচাই করে দেখা হয়নি।

ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ভুটানে রয়েছে ৩০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা। এর মধ্যে মাত্র পাঁচ হাজার মেগাওয়াট এখন উৎপাদন করা হচ্ছে।

এ খাতের উন্নয়নে তহবিল যোগানোর পাশাপাশি কারিগরিভাবে সহযোগিতা দিচ্ছে পাশের বড় দেশ ভারত। ভুটানের জলবিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।

সেক্ষেত্রে ভুটানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরবরাহের বিষয়ে এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেরিং বলেন, তার দেশের দিক থেকে এ নিয়ে কোনো আইনি জটিলতা নেই। কিন্তু তা করতে ভারতকে সঙ্গে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করতে হবে, কেননা, তার ভাষায়, বিদ্যুৎ ‘উড়ে যেতে’ পারবে না, ভারতের ওপর দিয়েই সরবরাহ লাইন টানতে হবে।

ভুটান সরকারের একজন কর্মকর্তা এ সময় বলেন, ভারতকে আগে এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করতে হবে, যাতে তাদের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে বিদ্যুতের সরবরাহ লাইন নেওয়া যায়।

আর মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেরিং বলেন, এটা নিয়ে ভুটানের দিক থেকে কোনো আপত্তি নেই। বরং তারা আগ্রহী।

পর্যটকদের যাওয়া আসা নিয়েও ভুটানের কোনো আপত্তি নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে আমাদের পরিবেশ আর সংস্কৃতির ওপর এর প্রভাবটা যেন যথাসম্ভব কম হয়।”

ভুটান বিশ্বের একমাত্র ‘কার্বন নেগেটিভ’ দেশ। যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড ভুটান নির্গমন করে, তার প্রায় তিনগুণ শোষণ করে৷ কিন্তু এই ধারা বজায় রাখা কঠিন হয়ে যাওয়ায় পর্যটনের কারণে পরিবেশ দূষণ নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ রয়েছে ভুটানিদের মধ্যে।

সে কারণে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে (বিবিআইএন) সরাসরি মোটর যোগাযোগের চুক্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হলে ভুটানের পার্লামেন্ট পরিবেশ রক্ষার কারণ দেখিয়ে তা আটকে দিয়েছিল।

এফবিসিসিআইয়ের এই অনুষ্ঠানের আগে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টালে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করে এসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, নিয়ন্ত্রিতভাবে হলেও যাতে ওই চুক্তিতে ভুটান আসে, সেই অনুরোধ তিনি রেখেছেন। 

“আমি উনাদের বলেছি, নিয়ন্ত্রিতভাবে পরিবেশকে বাঁচিয়েই এটা আমরা শুরু করতে পারি কি না। আমার প্রস্তাবে তাদের বেশ ইতিবাচক মনে হয়েছে।” 

শনিবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসবেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং। তখন দুই দেশের মধ্যে স্বাস্থ্য, কৃষি, নৌ পরিবহন, পর্যটন খাতে সহযোগিতা এবং জনপ্রশাসন খাতে প্রশিক্ষণের বিষয়ে পাঁচটি সমঝোতা স্মারকে সই হওয়ার কথা রয়েছে।

রোববার পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কথা রয়েছে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর। ভোরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সুরের ধারার আয়োজনে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকবেন। পরে যাবেন নিজের পুরনো শিক্ষায়তন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। সেখানে বর্তমান শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হবেন তিনি। 

বিমসটেকের সদস্য দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঢাকায় এ জোটের সচিবালয়েও যাবেন লোটে শেরিং। চার দিনের সফর শেষ করে ১৫ এপ্রিল তার ঢাকা ত্যাগ করার কথা রয়েছে।