কীভাবে অফশোর কোম্পানি কাজ করে এবং নিয়ম ভেঙে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কীভাবে খোলা হয় তা বুঝতে দুই দফা অনুসন্ধান চালান অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর গভর্নেন্স অ্যান্ড পাবলিক পলিসির অধ্যাপক জেসন শারম্যান ও তার দুই সহকর্মী।
নিজেদের জালিয়াত বা সন্ত্রাসী সাজিয়ে শেল কোম্পানি খোলার নাম করে মোস্যাক ফনসেকার মতো বহু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করেন। সেই অনুসন্ধানে যেসব তথ্য তারা পেয়েছেন তা শারম্যান তুলে ধরেছেন ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক নিবন্ধে।
ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের মাইকেল ফিন্ডলে ও ব্রিগহ্যাম ইউং ইউনিভার্সিটির গবেষক ড্যানিয়েল নিয়েলসন এই অনুসন্ধানে অধ্যাপক শারম্যানের সঙ্গে ছিলেন।
আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী ‘তোমার গ্রাহককে জানো’ নামের ফর্মটি পূরণ করা বাধ্যতামূলক। অর্থের উৎস ও লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে গ্রাহকের বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা হয় এই ফর্মের মাধ্যমে। ওই নিয়ম ভেঙে নিজের পরিচয় গোপন রেখে অফশোর কোম্পানিগুলোতে কীভাবে অ্যাকাউন্ট খোলা যায়- তা দেখতে চেয়েছিলেন শারম্যান ও তার সহকর্মীরা।
অফশোর ব্যবসার আইনি সেবা দেয় এরকম মোট ৫৪টি কোম্পানির সঙ্গে ২০০৯ সালে তারা যোগাযোগ করেন। এর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান পানামা ও কেম্যান আইল্যান্ডসের মতো পরিচিত ট্যাক্স হেভেন বা করস্বর্গে ব্যবসা চালায়। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ওইসিডিভুক্ত বিভিন্ন দেশে।
“যে ফলাফল পাওয়া গেল, তা বিস্ময়কর। অফশোর কোনো স্বর্গের চেয়ে আমেরিকার মতো অনশোর দেশে নিজের পরিচয় গোপন রেখে কোম্পানি খোলা ঢের বেশি সহজ,” লিখেছেন অধ্যাপক শারমান।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াইওমিংয়ের একটি কোম্পানির কাছে তারা জানতে পারেন, ওই কোম্পানি যে কেবল বেনামে তাদের জন্য শেল কোম্পানি খুলে দিতে পারে তাই না, লেনদেনের ইতিহাস নিষ্কলঙ্ক রাখতে ওই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মীর সোশাল সিকিউরিটি নম্বরও ব্যবহার করার ব্যবস্থা করে দিতে পারে।
অথচ ‘করস্বর্গ’ হিসেবে পরিচিত নমনীয় কর কাঠামোর এক দ্বীপ দেশের এক ল ফার্ম জানায়, চুক্তি করার আগে শারম্যানের পাসপোর্টের ছবি সম্বলিত পৃষ্ঠার স্ক্যান কপি তাদের কাছে জমা দিতে হবে।
শেল কোম্পানি কী? শেল কোম্পানি হচ্ছে একটি বৈধ ব্যবসার খোলস। মূল অর্থের মালিক কে, তা গোপন রাখার পাশাপাশি ওই অর্থের ব্যবস্থাপনা করাই এ ধরনের কোম্পানির কাজ। সাধারণত আসল মালিকের নাম এসব কোম্পানির কোনো কাগজে থাকে না। শেয়ার মালিকদের মধ্যে থাকেন আইনজীবী ও অ্যাকাউন্টেন্টরা। কখনো কখনো মালিকের অফিসের অফিস সহকারীও এসব শেল কোম্পানির পরিচালক বনে যান। একটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ থাকে এর বেশিরভাগ শেয়ারের মালিকের হাতে। শেল কোম্পানির ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আছে অন্য কোনো কোম্পানি। ওই কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে কোনো আইনজীবী হয়তো শেল কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে এসেছেন, যদিও তিনি নিজে মালিক নন। সেই নিয়ন্ত্রক কোম্পানিও হয়তো এই শেল কোম্পানির মালিক নয়। তারা হয়তো অন্য কোনো কোম্পানির সম্পদ ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে এই শেল কোম্পানিরও দেখভাল করছে। মোস্যাক ফনসেকার মতো অফশোর সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের শেল কোম্পানি খুলতে এবং ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করে। শেল কোম্পানির পরিচালকদের সময় সময় সই করা ছাড়া কার্যত কোনো ক্ষমতা থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে কাগজে কলমে একটি ঠিকানা ছাড়া আর কিছুই থাকে না বলে অনেক সময় শেল কোম্পানিগুলোকে ‘লেটারবক্স’ কোম্পানি নামেও ডাকা হয়। |
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওর এক সাংবাদিক ২০১২ সালে অফশোর কোম্পানির বিষয়ে একই ধরনের অনুসন্ধান চালান।
মধ্য আমেরিকার ‘করস্বর্গ’ বেলিজ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়ারে বেনামে দুটো কোম্পানি খোলার চেষ্টা করেন তিনি। ফল সেই একই। বেলিজের কোম্পানি যেখানে সেই সাংবাদিককে ‘নো ইওর কাস্টমার’ ফর্ম ধরিয়ে দিয়েছিল, সেখানে ডেলাওয়ারে তিনি পেয়েছিলেন বিনাপ্রশ্নে শেল কোম্পানি খোলার সুযোগ।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোম্পানি কেমন করে পানামা বা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের মতো জায়গার চেয়ে সহজে কর ফাঁকির ব্যবস্থা করে দিচ্ছে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শারম্যান ও তার দুই সহকর্মী এরপর বড় পরিসরে অনুসন্ধান শুরু করেন। তারা একটি কাল্পনিক প্রকল্প হাতে নেন, যার নাম দেওয়া হয় ‘গ্লোবাল শেল গেইমস’।
ইমেইলে জানতে চাওয়া হলো- ওই ধরনের শেল কোম্পানি ও অ্যাকাউন্ট খুলতে তাদের আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী তাদের পরিচয়ের প্রমাণ দিতে হবে কি না। এর মধ্য দিয়ে তারা প্রশ্নের তিনটি উত্তর পেলেন, যা শারম্যানের ভাষায় খুবই উদ্বেগজনক।
যেসব প্রতিষ্ঠান উত্তর পাঠালো, তাদের মোটামুটি অর্ধেক আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে মক্কেলের পরিচয় এবং তার সপক্ষে প্রমাণ চাইল। এক চতুর্থাংশ পরিচয় নিয়ে মাথাই ঘামালো না।
দ্বিতীয়ত কম ঝুঁকির মতো বেশি ঝুঁকির মক্কেলের ক্ষেত্রেও সেবা দিতে এসব ইনকরপোরেশন প্রতিষ্ঠানের তেমন কোনো আপত্তি দেখা গেল না।
তৃতীয়ত, আবারও সেই পুরনো বিষয়টির প্রমাণ পেলেন তিন গবেষক। দেখতে পেলেন, ট্যাক্স হেভেনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র বা ওইসিডিভুক্ত দেশের তুলনায় অনেক বেশি নিয়ম মানা হয়।
‘করস্বর্গ’ যেসব দেশ বা এলাকায় কোম্পানি নিবন্ধন করে ব্যবসা করার জন্য কর দিতে হয় খুবই কম, সরকার টাকার উৎস জানতে চায় না, কোম্পানির আসল মালিক কে তা নিয়ে মাথা ঘামায় না, ব্যাংকের তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করে উদারভাবে- সেসব দেশকেই ‘করস্বর্গ’ বা ট্যাক্স হেভেন বলা হচ্ছে। সাধারণত শেল কোম্পানি খুলে বেনামে ব্যবসা করার জন্য এ ধরনের কোনো দেশকেই বেছে নেওয়া হয়। ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, ম্যাকাও, বাহামা ও পানামার মতো দেশ ও দ্বীপদেশগুলো এ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ‘স্বর্গরাজ্য’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। অবশ্য অফশোর অর্থনীতিতে আসা সব অর্থের উৎসই অবৈধ- এমন নয়। লুট হওয়া ঠেকাতে, কঠোর কর আইন বা হেনস্তা এড়াতে এবং উত্তরাধিকার ও এস্টেট পরিকল্পনার জন্যও অনেকে অফশোরে আসেন। |
অধ্যাপক শেরম্যান তার নিবন্ধে প্রশ্ন করছেন, “তাহলে কী মোস্যাক ফনসেকার মতো কোম্পানিকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই?”
এরপর তিনিই উত্তর দিচ্ছেন, “তারা যদি কোনো অপরাধে সহযোগিতা দিয়ে থাকে, সেজন্য অবশ্যই তাদের শাস্তি পাওয়া উচিৎ।
“তবে মনে রাখতে হবে, পানামা পেপার্সে যদি দুই লাখ অফশোর কোম্পানির তথ্য এসে থাকে, আরও অন্তত দেড় লাখ কোম্পানির তথ্য আমাদের অজানা থেকে গেছে যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত। ”
আমেরিকার এরকমই একটি কোম্পানির বিজ্ঞাপনের বক্তব্য দিয়ে শারম্যান তার লেখা শেষ করেছেন।
“একটি করপোরেশন হলো একজন বিধিসম্মত ব্যক্তি, যাকে রাষ্ট্রীয় নিয়ম মেনে তৈরি করা হয়েছে, যাকে ব্যবহার করা যাবে বন্ধুর মতো, ভৃত্যের মতো, বলির পাঁঠার মতো অথবা পুতুলের মতো। সে হবে এমন একজন ব্যক্তি, যার নিয়ন্ত্রণ থাকবে আপনার হাতে, অথচ কোনো কাজের জন্য তাকে দায়ী করা যাবে না। সম্ভাবনাগুলো একবার ভাবুন!”