‘১০ দিনের মধ্যে’ কমছে তেলের দাম

আগামী সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে অকটেন, কেরোসিন, পেট্রোল ও ডিজেলের দাম কমিয়ে পরিপত্র জারি করা হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 April 2016, 08:21 AM
Updated : 24 April 2016, 11:15 AM

বুধবার সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “তেলের দাম ধীরে ধীরে আমরা সাশ্রয়ীভাবে দেখতে যাচ্ছি। তেলের মূল্যটাকে আমরা একটা যৌক্তিক রেটে নিয়ে যেতে চাচ্ছি।”

প্রথমে ‘সাত দিনের মধ্যে’ পরিপত্র দেওয়ার চেষ্টা করবেন বলে উল্লেখ করলেও পরে ‘সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে’ তেলের দাম কমানোর ঘোষণা দেন তিনি।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, “সেখানে (পরিপত্রে) অকটেন, কেরোসিন, পেট্রোল ও ডিজেল থাকবে। আমরা ইতোমধ্যে ফার্নেস অয়েলের দাম কমিয়েছি। এতে বেশ কিছু জায়গায় সাশ্রয় হচ্ছে। সে বিষয়গুলো সরাসরি আমাদের জনগণের পর্যায়ে পৌঁছছে।”

দাম কতোটা কমছে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমি আগেও বলেছি, ১০ টাকা থেকে কিছুটা কম-বেশি থাকবে। এর মধ্যে আনার চেষ্টা করছি। দুই থেকে তিন ধাপে তেলটাকে আমরা সমন্বয় করব। সব তেলের ক্ষেত্রে নয়। সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে সমন্বয় হবে। প্রথমটা হয়তো ১০ দিনের মধ্যে, তার থেকে ছয়-সাত মাস পর আরেকটি ধাপ। তার ছয়-সাত মাস পর আরেকটি ধাপ।

“প্রথম ধাপে কিছুটা বর্ধিত মূল্য কমাব। অন্য সেক্টরেও আমরা আবেদন করতে যাচ্ছি। গ্যাস ও বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও একটা চলমান প্রক্রিয়া আমরা রাখতে চাই। যেখানে দামের একটা সমন্বয়ের আরও প্রয়োজন আছে।”

নসরুল হামিদ তেলের সঙ্গে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয়ের কথা বলেন এবং ভেজাল পেট্রোল বিক্রি বন্ধে পাম্পে পাম্পে অভিযান চালানোর ঘোষণা দেন।

“কেউ যদি ভেজাল করে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে লাইসেন্স বাতিল করা হবে। আগামীকাল থেকে তা শুরু হবে। আমাদের কাছে রিপোর্ট চলে আসছে। ১২শ’ পেট্রোল পাম্পের মধ্যে কোন কোন পাম্প ভেজাল করছে, আমরা ধীরে ধীরে তাদের লাইসেন্স বাতিলের দিকে যাব। এখন আর জরিমানা না, সরাসরি লাইসেন্স বাতিলের দিকে যাব।”

সর্বশেষ ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মূল্য সমন্বয়ের সময় বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সেই হারে বর্তমানে প্রতি লিটার অকটেন ৯৯ টাকা, পেট্রোল ৯৬ টাকা, কেরোসিন ও ডিজেল ৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

তখন প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলের দাম ৬০ টাকা স্থির হয়েছিল, যা গত ৩১ মার্চ কমিয়ে ৪২ টাকা করা হয়েছে।

বাংলাদেশে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও যানবাহন বৃদ্ধির কারণে গত কয়েক বছর ধরে ৫০ লাখ মেট্রিক টনের বেশি জ্বালানি তেলের চাহিদা তৈরি হয়েছে; যার মধ্যে প্রায় সবই আমদানি করতে হয়। বিশ্ব বাজারে গত দেড় বছর ধরে তেলের দরপতন চলার কারণে দেশের বাজারে সব ধরনের জ্বালানির দাম কমানোর দাবি ওঠে।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জ্বালানি তেলের দাম কমানোর পক্ষে মত দেন। তবে ভর্তুকির লোকসান থেকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে তুলতে দাম অপরিবর্তিত রাখে সরকার।

সরকার সে অবস্থান থেকে সরে এসে ফার্নেস অয়েলের দাম কমানোর পর গত ৪ এপ্রিল জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ডিজেল-পেট্রোলের দামও কমানোর ইংগিত দেন।

 ‘পেট্রোল অকটেন আমদানি নয়, উৎপাদন’

নসরুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশ এখন এমন পর্যায়ে এসেছে, যেখানে পেট্রোল আমদানি করতে হয় না। সরকার অকটেনও আর আমদানি করতে চায় না।

“আমাদের পেট্রোল ও অকটেন আমরা নিজেদের দেশেই উৎপাদন (পরিশোধন) করব এবং সেটিই আমরা মার্কেট করব। এতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিকভাবে বিশাল সাশ্রয় হবে।”

‘আবাসিকে গ্যাস নয়, ব্যক্তিগত সিএনজি নয়’

নসরুল হামিদ বলেন, সরকার ‘যত্রতত্র’ গ্যাস ব্যবহার বন্ধ করতে চাইছে। ইতোমধ্যে গ্যাস ব্যবহারের বিষয়ে একটি ‘মহাপরিকল্পনা’ তৈরি করা হয়েছে। সরকার এখন সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছে।

“আমারা মূলত আবাসিক খাত থেকে গ্যাস সরিয়ে এলপিজিতে যাওয়ার ওপর জোর দিচ্ছি।... সিএনজি থেকে আমরা আস্তে আস্তে সরে আসতে পারি কি-না, তবে গণপরিবহনে হয়তো সিএনজি কিছুটা থাকবে। আর গ্যাসের একটা মূল্য সমন্বয় আমরা চাচ্ছি।”

বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয়েরও পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “বিদ্যুতে ট্রান্সমিশনে এবং ডিস্টিবিউশনে আমাদের প্রচুর বিনিয়োগ হচ্ছে। সেইখানে বিতরণে এখনও আমরা লস দিয়ে যাচ্ছি। এই জায়গায় দাম সমন্বয় করতে হবে।”

তেলের দামের পাশাপাশি গণপরিবহনের ভাড়া কমাতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা হবে কি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ভাড়ার বিষয়টা আমার না। ভাড়ার বিষয়টা যোগাযোগের। আমার বিষয়টা তেল। আমি তেল নিয়েই থাকতে চাই।

“আমি আপনাদের মাধ্যমে অনুরোধ করতে পারি, যেহেতু এখানে দামের ক্ষেত্রে একটু কমফোর্ট হবে, অবশ্য তাদের ভাড়ার ব্যাপারটাও সমন্বয় হওয়া উচিত।

তেলের দাম কমানোয় তিন ধাপ অনুসরণের কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) দেনার প্রসঙ্গ তুলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমরা একটা ইফেক্ট দেখতে চাচ্ছি। প্রথম ধাপে কমানোর পর কী অবস্থা হয়? বিপিসির কিন্তু দেনা রয়েই যাচ্ছে।

“বিপিসি পুরো দেনা শোধ করতে পারছে না। সেখান থেকে কিছু কিছু হলেও দেনা শোধ করতে হবে। এ কারণে আমরা একটু সময় নিয়ে এই জায়গাটা করতে চাচ্ছি।

‘বিচ্ছিন্ন হবে আবাসিকে বাণিজ্যিক সংযোগ’

নসরুল হামিদ বলেন, “আরেকটা বিষয় বলে দেই, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন যে, আগামী ছয় মাসের ভেতরে অবৈধ অনুনোমোদিত ভবনের ক্ষেত্রে আবাসিক জায়গা থেকে বাণিজ্যিক স্থাপনা সরাবেন। সেখানে আমার প্রতিও নির্দেশনা আছে যে, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন বিচ্ছিন্ন করা।

“যারা অবৈধভাবে ভবনে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন, অকুপেন্সি সনদ নিচ্ছেন না এবং যারা রাজউক আওতাধীন এলাকায় আবাসিকভাবে প্ল্যান পাস করিয়েছেন, কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করছেন, সেই বিদ্যুৎ এবং গ্যাস আমরা বিচ্ছিন্ন করতে যাচ্ছি।”

কবে নাগাদ অভিযান শুরু হবে- এমন প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “ইতোমধ্যে নোটিশ ইস্যু হয়েছে, ছয় হাজারের বেশি নোটিশ ইস্যু হয়ে গেছে। আমিতো শুরু করেছি, জানুয়ারি থেকে।”

আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, “ফার্নেস অয়েলের দাম ১৮ টাকা কমার কারণে আমাদের সেক্টরে প্রতি মাসে প্রায় ২০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। এখানে একটা বড় সাশ্রয় হবে। এই টাকাটাও আমরা বিনিয়োগ করতে যাচ্ছি। এটাও আমাদের বিনিয়োগ পরিকল্পনায় আছে।”

ফার্নেস অয়েলের দাম কমার পরও কেন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা- এমন প্রশ্নে নসরুল হামিদ বলেন, “কারণ হলো বিদ্যুতের দামতো খালি উৎপাদনের উপর নির্ভর করে না। বিদ্যুৎ ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশনের উপরও নির্ভর করে, ওই জায়গায়তো আমরা এখনও লসে আছি।

“এত বড় বড় পাওয়ার প্ল্যান্ট আসতেছে। দেড় বিলিয়ন, ‍দুই বিলিয়ন, টাকাগুলোতো আমাদেরকে শোধ করতে হবে। মানুষের আয় বাড়তেছে। মুদ্রাস্ফীতি এখনও কম আছে। মানুষ শুড বি কমফোর্টেবল।”

তাই বিদ্যুতের দাম ‘ধীরে ধীরে সমন্বয় করে বাড়ানো হবে বলে জানান তিনি।

‘গ্রাহক পাওয়া যাচ্ছে না’

বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতার বিপরীতে দেশে পর্যাপ্ত গ্রাহক পাওয়া যাচ্ছে না বলেও সাংবাদিকদের জানান প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

তিনি বলেন, বিদ্যুৎ যা ব্যবহার হয় ঢাকা শহরে, সাড়ে তিন হাজার। আর সারা বাংলাদেশে ব্যবহার হয় তিন হাজার মেগাওয়াট।

সব শিল্পতো ঢাকাতেই- এক সাংবাদিকের এমন বক্তব্যের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “না, আমাদের এখানে ভোক্তা বেশি এয়ারকন্ডিশনে। ঢাকা শহরে এখন দিনের বেলা ও রাতের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার সমান হয়ে যাচ্ছে। আগে রাতের বেলা বেশি ছিল। দিনের বেলাও এখন সমান হয়ে যাচ্ছে। এই যে এখন বৃষ্টি কমে যাচ্ছে, এখন ৫ হাজার- ৬ হাজারে চলে আসবে।

“আরেকটা জিনিস আছে, আমি বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াচ্ছি। কিন্তু বিক্রি করতে পারছি না। আমার ক্ষমতা এখন ৯ হাজার; সাড়ে ৯ হাজার দেওয়ার কথা। এখন যদি ৫ হাজার চলে, বাকিটা কিন্তু আমার পয়সা দিতে হচ্ছে। এতে আমার লস না? সেটাওতো মূল্যের সাথে সমন্বয় হচ্ছে।”

‘দুইটা বাতির বেশি জ্বালায় না’

নসরুল হামিদ বলেন, “খালি বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াইলেইতো হবে না। ভোক্তাকে কিনতে হবে। আমি বিদ্যুতের সংযোগ সারা বাংলাদেশে দিয়ে দিলাম, ওরা নেয় না। দুইটা বাতির বেশি জ্বালায় না। এতে কিন্তু আমার লস।”

এজন্য জনগণের সক্ষমতা বাড়ানোয় গুরুত্বারোপ করেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী।

“ওর সক্ষমতাটা বাড়াতে হবে, ও যেন দুইটা বাতির বেশি জ্বালাতে পারে, ওর যেন ক্ষমতা হয় যে, আরও বেশি আমার বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। ৩৬৫ কিলোওয়াট পার পারসন ব্যবহার করে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে যেতে পারব না। আমাদেরকে মিনিমাম সাড়ে ৬০০ কিলোওয়াট ব্যবহার করতে হবে।

“যখনই এভারেজে সাড়ে ৬০০ কিলোওয়াট হবে, তখনই বুঝতে পারবেন যে, আমাদের সক্ষমতা দাড়িয়ে গেছে মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়ার। এটা কিন্তু দ্বিগুণ রয়ে গেছে।”

২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যের প্রসঙ্গ তুলে তিনি আরও বলেন, “তার মানে আমাকে ডেভেলপ করতে হবে ২১ সালে, ধরেন তিন-চার বছরে। এই চার বছরের মধ্যে আমাকে সাড়ে ৬০০ কিলোওয়াট আপনার জায়গাটা বাড়াতে হবে।

“নয়তো শহরে-গ্রামে ডিফারেন্স থেকে যাচ্ছে। এইরকম ব্যবধান থেকে গেলে মধ্যম আয়ের দেশের সুফলটা সমভাবে হবে না।”