“আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি করে তৈরি পোশাক রপ্তানি করব, যাতে বাড়তি শুল্ক আরোপ করতে তারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে।”
Published : 17 Mar 2025, 03:04 PM
তুলা আমদানির উৎস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো হচ্ছে, যাতে তাদের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসে। আরেকটা দিক হচ্ছে, তারা বিভিন্ন দেশের ওপর নতুন করে শুল্ক বসাচ্ছে। বাংলাদেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে আমাদের বিরুদ্ধে সহজে যেন যেতে না পারে, সেজন্য।”
সোমবার রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম, ইআরএফ এর কার্যালয়ে এক সেমিনারে কথা বলছিলেন উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “ট্রাম্প সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্কারোপ করছে। বাংলাদেশ অবশ্য আগে থেকেই শুল্ক দিয়ে রপ্তানি করছে। যদিও বাংলাদেশের ওপর এখনও বাড়তি শুল্ক আরোপ করেনি, তবু একটা সংশয় থেকেই যায়। এ পরিস্থিতিতে আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি করে তৈরি পোশাক রপ্তানি করব, যাতে বাড়তি শুল্ক আরোপ করতে তারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে।”
‘বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে তুলা চাষের গুরুত্ব ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এ সেমিনারে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তুলা আমদানির পাশাপাশি উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, “তুলা আমদানির ওপর রপ্তানি নির্ভর করছে। এজন্য আমদানি যেন সহজ হয়, স্থানীয়ভাবে উৎপাদনও যেন বাড়ে। আমরা উৎপাদনে একশ পার্সেন্টে যেতে পারব না, আমাদের এত জমি নেই। যদি দুই শতাংশ থেকে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ হয়, তাহলেও আমাদের জন্য বড়সর অ্যাচিভমেন্ট হবে।”
যেসব জমিতে তুলনামূলক কম মূল্যমানের অর্থকরি ফসল উৎপাদন হচ্ছে, সেখানে তুলা চাষ জনপ্রিয় হতে পারে বলে মনে করেন উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “তামাক চাষের কারণে জমিরও ক্ষতি হচ্ছে। তামাক উৎপাদনে ব্যবহৃত জমি খুব দ্রুত তুলা উৎপাদনে নিয়ে আসা যায়। ধূমপান সামাজিকভাবে নিরুৎসাহিত করতে হবে। নইলে চাহিদা থাকায় তামাক পণ্য আমদানি বাড়বে। এজন্য তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে।
“অবিলম্বে কৃষি পণ্য হিসেবে তুলাকে স্বীকৃতি দিতে আমি কাউন্সিলে তুলব। আগামী এক দুই মাসের মধ্যে যেন তুলা নিয়ে পজিটিভ সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।”
কৃষি পণ্য হিসবে তুলা প্রণোদনা পাওয়ার যোগ্য মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, “সারা পৃথিবীতে তুলায় সাবসিডি দেওয়া হয়। দেশে তুলা আমদানিতে কোনো শুল্ক নেই। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে তুলা উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে আগাম কর নেওয়া হয়।”
স্থানীয় তুলা উৎপাদনকারীদের ৪ শতাংশ আগাম কর দিতে হয়। এই আগাম কর তুলে নিতে তিনি এনবিআর কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
স্থানীয় পর্যায়ে তুলা চাষ বাড়লে দামও কমে যাবে মন্তব্য করে তৌহিদ হোসেন বলেন, “সাপ্লাই চেইনে কোনোরকম সমস্যা দেখা দিলে যেন অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সেই ঘাটতি পূরণ করা যায়। আমদানির কারণে নিম্ন মানের কটন বেশি দামে কিনতে হয়। কম দামে তুলা আমদানি করতে পারলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে আমাদের পোশাক খাতের।”
বাংলাদেশ টেক্সটাইলস মিলসের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে তুলা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বস্ত্র খাতের বাজার ২০ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য কারখানার সংখ্যা বর্তমানে এক হাজার ৮৪৯টি। এর মধ্যে ৫৫৬টি স্পিনিং মিল।
দেশে তুলার চাহিদা বছরে ৭৩ লাখ বেল (এক বেল ১৮২ কেজি)। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ২ লাখ বেল, যা মোট চাহিদার ২ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
তুলা আমদানিতে প্রতি বছর বাংলাদেশ ৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্বছরের প্রথম চার মাসে কাঁচা তুলা আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১২৫ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। আর ইয়ার্ন আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১২১ কোটি ৮৮ লাখ ডলার।
দেশের ৩৯টি জেলায় তুলা চাষের প্রাকৃতিক পরিবেশ রয়েছে, সেই তথ্য তুলে ধরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, তুলা চাষ ও গবেষণা বাড়াতে সরকারিভাবে অর্থ দেওয়া প্রয়োজন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন সেমিনারে বলেন, তুলা চাষে এনবিআর সব রকম সহযোগিতা করবে।বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। তুলা আমদানির জন্যও বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা চালু করা যেতে পারে। তুলার ওপর আগাম কর তুলে দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ কটন জিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম সাবের বলেন, সরকারি নীতি সহায়তা পেলে বছরে অন্তত দুই লাখ হেক্টর জমিতে তুলা চাষ করা সম্ভব। এতে তুলা আমদানি ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনা যাবে।
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক ফকরে আলম ইবনে তাবিব বলেন, ধানের জমিতে তুলা চাষ হয় না। তুলা মূলত চরাঞ্চল, বরেন্দ্র এলাকা, দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত ও পাহাড়ি এলাকায় করা যায়। তুলার মধ্যে যে বীজ থাকে, তা দিয়ে ভোজ্য তেল উৎপাদন করা যায়।
তুলার বীজ থেকে উৎপাদিত ভোজ্যতেল প্রদর্শন করা হয় সেমিনারে। বোতলজাত সেই তেল প্রতি লিটার ১৬৫ টাকা দরে বাজারজাত করছে কুষ্টিয়া কটন সিড ওয়েল রিফাইনারি।
বাংলাদেশ সুদান কটন জিনিং ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সুদানে তুলা চাষে প্রবাসী উদ্যোক্তা আবুল খায়ের বলেন, “বাংলাদেশে উচ্চ ফলনশীল তিনটি উন্নত জাতের তুলা বীজ পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করা হয়েছে। এ নতুন জাতের চাষাবাদ শুরু হলে কম জমি থেকে বেশি তুলা উৎপাদন করার সম্ভব।”
বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে
বাংলাদেশ এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে বিভিন্নভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেছেন, “আজকে বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বব্যপী কিছু মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার ভালো কিছু করতে চায়। বিশ্বের সবাই তাকে চেনে, এজন্য তার পক্ষে খারাপ কিছু করা সম্ভব না, এটা তারা জানে।
“মিডিয়া সব সময়ই সত্য তুলে ধরতে পারে। আপনারাই পারেন যে কোনো ঘটনার পরবর্তী ফলোআপ জানাতে। এখন মিডিয়ায় ফলোআপ কমে গেছে। নিউজের ফলোআপ হলে সত্যটা প্রচার পায়।”
সেমিনারে বাংলাদেশের এলডিসি গ্রাজুয়েশন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হওয়ার পক্ষে মত দেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “ট্রেড ডিপ্লোমেসি প্রয়োজন। ব্যবসায়ীরা চাচ্ছেন এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পিছিয়ে দিতে। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাচ্ছি না পেছানো হোক।”
অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও এলডিসি গ্র্যাজ্যুয়েশন চাচ্ছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা ২৬ সালে গ্র্যাজুয়েশন করলেও তিন বছর সময় পাব। এই তিন বছরে অর্থাৎ ২০২৯ সালের মধ্যে ব্যবসায়ীরা তাদের সক্ষমতা বাড়াতে পারবে।”
তৌহিদ হোসেন বলেন, “এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশে তিন বছর শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে। আমি বিশ্বাস করি, তারা ওই সময়ের মধ্যেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারবেন।”
ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার জন্য যা যা করা দরকার তা করা হবে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, “জিএসপি প্লাস পাওয়ার জন্য ইইউ কিছু শর্ত দিয়েছে। আমরা সেগুলো পরিপালন করব।”
কর-জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশ যে নেপালের চেয়েও পিছিয়ে, সে কথা তুলে ধরে উপদেষ্টা বলেন,
“আমরা লজ্জাজনক অবস্থায় আছি, এটা বাড়াতে হবে। এরসঙ্গে কিছু ছাড় থাকবে। এই ছেটো ছোটো ছাড়গুলো অর্থনীতিতে ভালো কিছু নিয়ে আসবে।”
সেমিনার সঞ্চালনা করেন ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার মালা ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।