“কাস্টমার আগের চেয়ে কমে গেছে, পরিমাণে কম কিনছে। দোকানে তেমন বেচাকেনা নাই, রোজার আগে যেভাবে এতদিন মার্কেট জমে উঠত, সেভাবে আর জমছে না। এবার মাল উঠাতেও ভয় লাগছে,” বললেন একজন বিক্রেতা।
Published : 17 Mar 2023, 03:49 PM
রোজার বাকি আর সপ্তাহখানেক, শুক্রবার ছুটির দিনে মো. নয়ন আর সুমনা আক্তার দম্পতি মিরপুর দুই নম্বর বাজারে এসেছেন ছোলা, ডাল, চিনি, বেসনের মত পণ্য কিনতে, যেগুলো ইফতারি বানাতে লাগে। তাদের দুজনকে মলিন মুখে ঘুরতে দেখা গেল দোকান থেকে দোকানে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সুমনা বললেন, দোকানিদের সাথে দামাদামিতে বনিবনা হচ্ছে না, তাই মেজাজ খারাপ। যতটুকু কিনবেন ভেবে বাসা থেকে বের হয়েছেন, সেটুকু তাদের কেনা হচ্ছে না।
“রোজা এলে ইফতারের জন্য সবসময় এগুলো কিনি, কিন্তু এবার দাম এত বেশি যে মনমতো কিছুই নিতে পারছি না,” বললেন তিনি।
সুমনা জানালেন, আগে যেখানে একেবারে দুই কেজি ছোলা নিতেন, সেখানে এবার নিতে হল আধা কেজি। বেসন, ডাল, এগুলোও কম কম নিতে হল।
আক্ষেপের সুরে বললেন, “আমাদের মত ফিক্সড ইনকামের মধ্যবিত্তের জন্য এই বাজারে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে। খুব হিসেব করে চলতে হচ্ছে।”
পাশে দাঁড়ানো স্বামী নয়ন বললেন, “এই অল্প অল্প জিনিস কিনতেও ৮০০ টাকা লেগে গেল। ছোট ছোট জিনিস কিনতে হচ্ছে, আগে শরবতের পাউডারের বয়াম নিতাম এখন প্যাকেট নিলাম। ৫৫-৬০ টাকার চিনি হয়ে গেছে ১২০ টাকা। এই টাকায় আগে ডাবল বাজার করা যেত।”
তারা যে দোকান থেকে পণ্য নিলেন সে দোকানের মালিক মো. এনায়েতেরও মুখ ভার। তিনি বললেন, “কাস্টমার আগের চেয়ে কমে গেছে, পরিমাণে কম কিনছে। দোকানে তেমন বেচাকেনা নাই, রোজার আগে যেভাবে এতদিন মার্কেট জমে উঠত, সেভাবে আর জমছে না। এবার মাল উঠাতেও ভয় লাগছে।”
বাজার ঘুরে দেখা যায়, অনেক ক্রেতাই দাম-দর জিজ্ঞেস করছেন কিন্তু দাম শুনে ফিরে যাচ্ছেন। তেমনি একজন সাবিনা বেগম।
অন্যের বাড়িতে কাজ করা সাবিনা বললেন, “সব বছরই রোজায় ইফতারে অল্প হইলেও ছেলেমেয়ের জন্যে কিছু বানানের চেষ্টা করতাম। এই বছর সব জিনিসেরই দাম অনেক বেশি, এইবার মনে হয় আর ইফতারি বানানি যাইত না।”
মিরপুর ছয় নম্বর বাজারে আসা আরেক ক্রেতা আসলাম মোল্লা বললেন, “ইফতারে সবাই ভালো খেতে চায়। সামগ্রিক দাম বাড়ার প্রভাব এখন ইফতারের টেবিলে পড়বে, আইটেম কমাতে হবে, তাছাড়া তো উপায় দেখছি না।”
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গত সপ্তাহে ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হওয়া ছোলা কিছুটা কমে ৮৫-৯৫ টাকায় বিক্রি হলেও দেশি ভালো জাতের ছোলা ১০০ টাকা কেজিতেই বিক্রি হচ্ছে। খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২০ টাকায়। ভালো মানের মসুর ডাল ১৫০ টাকা, খেসারি ডাল ৮০-৯০ টাকা, অ্যাংকরের বেসন ৭৫-৮৫ টাকা এবং বুটের বেসন বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকায়।
মুদি দোকানি মোনায়েম খান বলছেন, জিনিসপত্রের দাম ‘অত্যধিক বেশি’ হওয়ায় এবার রোজার আগেও অন্য বছরের তুলনায় মাল কম তুলেছেন ব্যবসায়ীরা।
“টাকাওয়ালা লোকের কেনাকাটা কমে নাই, কমছে শ্রমিকের, কম ইনকামের মানুষের। ডাইলের কেজি দেড়শ, ৩৫ টাকার সাবান হইয়া গেছে ৭০ ট্যাকা, খেজুর যেটা আছিল ৭০০ সেইটা এইবার হাজার টাকা দাম। যাদের ইনকাম কম তাদের কিনার কোনো উপায় নাই। মানুষ এখন না পাইরা কিনে, এক কেজি লাগলে আধা কেজি নেয়।”
এমনিতে রোজার আগের শুক্রবারে ভিড় জমত মাছ-মাংসের দোকানেও, সেই ভিড়ও কমেছে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে। মিরপুর ২ ও ৬ নম্বরের কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, খাসির মাংসের দাম ১১০০ থেকে দোকানভেদে ৫০-১০০ টাকা বাড়তি, বেড়ে গেছে হাড় ছাড়া গরুর মাংসের দাম।
২ নম্বর কাঁচাবাজারের মায়ের দোয়া গোস্ত বিতানের মালিক জসিম উদ্দিনকে পাওয়া গেল চালানের শেষ মাংসের টুকরা কাটাকাটিতে। তিনি বললেন, “হাড্ডি ছাড়া গরুর মাংস হাজার টাকা কেজি, হাড্ডিসহ ৭৫০ টাকা। সামনে রমজান, আরও বাড়বে। গরুর দাম অনেক বেশি, বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমরা এখন কাস্টমার পাই না, গরু কাটি কম। আজকে যা কাটছি সব শেষ হয়ে গেছে।”
দুই বাজারেই মুরগির দাম আরও বেড়েছে। আগের সপ্তাহের ২৫০ টাকার ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৫৫-২৬০ টাকা কেজিতে। ৩৫০ টাকার সোনালি মুরগির দাম হয়ে গেছে ৩৬০ টাকা, আর ১০ টাকা বেড়ে লেয়ার মুরগির দাম হয়েছে ৩১০ টাকা।
বাজারে কমেনি কোনো মাছের দাম। বরং দেশি নদ-নদীর মাছে কেজিতে ২০-৩০ টাকা দাম বেড়েছে।
এই প্রভাব পড়েছে ফ্রিল্যান্স লেখক সরওয়ারের রমজানের আমিষ কেনাকাটায়। তিনি বলেন, “মাছ মাংসের দাম একদম নাগালের বাইরে। আগে রোজা এলে চারটা পাঁচটা মুরগি কিনতাম, এবার দুইটা নিলাম। মাছের দামও বেশি, মনমতো কিনতে পারি নাই। গরু-খাসির চিন্তা আগেই বাদ দিয়েছি।”
মাছ-মাংসের মত রোজার আগে বেড়ে গেছে সবজির দামও। ক্রেতা-বিক্রেতারা বলছেন, সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি সবজিতে অন্তত ১০-২০ টাকা বেড়েছে। নতুন সবজির দাম বেড়েছে বেশি।
মিরপুর ৬ নম্বর কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা সুমন মিয়া বলেন, “নতুন সবজির বাজার বাড়তি। সজনে, বরবটি, কচুর লতির দাম বাড়ছে, শীতের সবজি কইমা যাওয়ায় এইগুলারও দাম বাড়তি।”
এ বাজারে আসা ক্রেতা সালাউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, “৬০ টাকার নিচে কোনো সবজি নাই, নতুন সবজি নিতে গেলে ১০০ টাকা কেজির নিচে নাই, বাজারে আইসা যা ধরবেন তারই দাম বেশি। এক কেজি সজনার দাম ১৮০ টাকা, বরবটি, কচুরলতিও ১০০ টাকার উপরে। সংসার চালানোই কঠিন। রোজা শুরু হইলে বেগুন, শসা, লেবু এগুলার দামও বাড়াইয়া দিবে।”
সবজির বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি করলা ৭০-৮০ টাকা, শিম ৫০-৬০ টাকা, পটল ৬০-৮০ টাকা, টমেটো ৪০-৫০ টাকা, বেগুন ৬০-৯০ টাকা, চিচিংগা ৬০-৮০ টাকা ও ঝিঙ্গা ৬০-৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। একটি লাউয়ের দাম ৫০-৮০ টাকা, আকারভেদে লেবুর হালি বিক্রি হচ্ছে ৪০- ৬০ টাকায়।