জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিতে ‘সমর্থন নেই’ ব্যবসায়ীদের

হঠাৎ করে ‘এত বেশি’ মূল্য বৃদ্ধিকে সমর্থন করেন না বলে জানিয়েছেন দেশের প্রধান ব্যবসায়ী নেতারা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 August 2022, 02:58 PM
Updated : 6 August 2022, 02:58 PM

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে একবারে ‘এত বেশি’ মূল্য বৃদ্ধিকে সমর্থন করছেন না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমতে শুরু করলেও কেন দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হল সেই প্রশ্নও তুলেছেন তারা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দাম কম ছিল তখন সরকার বেশি দামে বিক্রি করে যে লাভ করেছে, সেখান থেকে তেলের দাম সমন্বয় করা যেতে পারে।

দাম বাড়ালেও অতিরিক্ত কেন বাড়ানো হল সে প্রশ্ন তুলে হঠাৎ করে ‘এত বেশি’ মূল্য বৃদ্ধিকে সমর্থন করেন না বলে জানিয়েছেন দেশের প্রধান ব্যবসায়ী নেতারা।

শনিবার থেকে জ্বালানি তেলের দাম সর্বোচ্চ ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে নতুন মূল্য কার্যকরের প্রজ্ঞাপন দিয়েছে সরকার।

এতে বাস-ট্রাকের জ্বালানি ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বেড়ে ১১৪ টাকা হয়েছে। গাড়ি ও মোটর বাইকের জ্বালানি পেট্রোলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে।

Also Read: ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এক ধাক্কায় ৪২.৫%; অকটেন ও পেট্রোলে ৫১% বাড়ল

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসীম উদ্দিন বলেন, “সরকার যখন কোনো পণ্য সরবরাহ করে সেই পণ্য বিক্রিতে লোকসান হলে দাম বাড়ানো সমর্থন করা উচিত। আমরাও সমর্থন করি।

“কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমতে শুরু করেছে, তখন এত বেশি মূল্য বৃদ্ধি আমরা সমর্থন করছি না।”

এর আগের তিন বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সম্প্রতি বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পেলেও তা সমন্বয় করা যেত।

“দেশের মানুষ যখন মূল্যস্ফীতির চাপে তখন এভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ওপর এত মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।”

ডিজেলের দামের ওপর মূল্যস্ফীতি নির্ভর করে উল্লেখ করে দাম পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।

সম্প্রতি গ্যাসের মূল্য ১৫ শতাংশ বৃদ্ধিকে ব্যবসায়ীরা সমর্থন দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশেও বাড়ানো স্বাভাবিক বলে উল্লেখ করেন তিনি।

“কিন্তু একসঙ্গে এত বেশি বৃদ্ধি করবেন এটা হতে পারে না,”- যোগ করেন জসীম উদ্দিন।

এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বৈঠক হবে এবং সেখানে বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে বলে জানান এফবিসিসিআই সভাপতি।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম বাড়ানো হয়েছে মানলাম। কিন্তু একবারে কি আপনি ১০০ শতাংশ বাড়িয়ে দিবেন?”

তিনি বলেন, “আমরা ব্যবসায়ীরা এটা সমর্থন করছি না। কারণ আমার পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় কার্যক্রমে এটা ধরি নাই। যার কারণে আমরা হিমশিম খেয়ে যাব।”

Also Read: ‘গরিব মানুষের বেঁচে থাকা আরও কঠিন হয়ে গেল’

জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রভাব সম্পর্কে বলেন, “এখন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। তাই কৃষি খাতে অবশ্যই সরকারকে ভর্তুকি বা যে কোনোভাবে সহায়তা দিতে হবে।

“নগদ সহায়তা বা জ্বালানি বা সারে বিশেষ ছাড় দিতে হবে।”

নইলে মূল্যস্ফীতি আরও ‘ভয়াবহ’ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আপনাকে কৃষি খাতকে কোনোভাবে সহযোগিতা করতে হবে। একদিকে দাম বাড়ালে অন্যদিকে আপনাকে সাশ্রয় দিতে হবে। যদি আপনি সাশ্রয় না দিতে পারেন তাহলে লংটার্মে গিয়ে আপনি ধরা খেয়ে যাবেন।

“আমরা মনে করি, সরকার যদি কোনো খাতে ভর্তুকি বা সহায়তা কমিয়ে দেয় তাহলে একসঙ্গে এত বড় আকারে না বাড়িয়ে কয়েক মাসে আস্তে আস্তে এটা করতে পারত।”

যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় এরকম সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, “কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমাদের স্বল্প মেয়াদে জরুরি ছিল। কিন্তু এটা কি ১৫ বছরের জন্য জরুরি ছিল না?”

তিনি বলেন, “১৫ বছর আগে আমাদের প্রয়োজনে কুইক রেন্টাল করা হল, এরপর যদি গ্যাসকূপ আবিস্কার করে গ্যাস নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে পারতাম, তাহলে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আরও কমে যেত।”

এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, সরকারের সকল খাতকে বহুমাত্রিক করতে হবে। অর্থাৎ তেল, গ্যাস, এলএনজি সবকিছুর সমন্বয়ে জ্বালানি ব্যবহার করা উচিত।

“তাহলে একটা খাতে সমস্যা হলে অন্য খাত দিয়ে আপানি সমন্বয় করতে পারবেন,” বলেন রিজওয়ান রহমান।

প্রধান রপ্তানিখাত পোশাক শিল্প মালিকরাও এত বেশি হারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিকে নজিরবিহীন বলছেন।

বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো ধরনের আলাপ, আলোচনা ছাড়া এভাবে নজিরবিহীন পরিমাণে তেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় এখন আমরা চোখে অন্ধকার দেখছি।

“ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এখন নিজস্ব জেনারেটর চালানোর যেই ব্যবস্থা ছিল সেটাও অনেক ব্যয়বহুল হয়ে গেল। এখন সময়মতো শিপমেন্ট পাঠানো যাবে না।”

ঢাকার আশপাশের কারখানা এলাকায় এখনও ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে বলে জানান শহিদুল্লাহ।

“উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক অর্ডার ক্যানসেল করতে হবে। কেবল উৎপাদন খরচ নয়, পরিবহন খরচও বাড়বে সমান্তরালে। সব মিলিয়ে রপ্তানি খাতে নতুন করে ব্যয়ের চাপ ১৫ শতাংশ বেড়ে যাবে বলে আমাদের ধারণা।”

হঠাৎ দাম বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, “যখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম ছিল তখন সরকার দাম কমায়নি। জরুরি মুহূর্তের জন্য মজুদও করে রাখেনি। এখন দাম যখন বেড়ে গেল, হুট করে এভাবে দামটা বাড়িয়ে দেওয়া হল।

“এভাবে তো মেনে নেওয়া যায় না। কাল আমরা জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করব।”