হুট করে বান্দরবানে

আশরাফ তিতাস
Published : 6 Feb 2020, 01:40 PM
Updated : 6 Feb 2020, 01:40 PM

হঠাৎ করেই মাথায় এলো পাহাড় দেখতে যাব। স্ত্রীর সাথে শলা-পরামর্শের মাঝেই বন্ধু আরিফের ফোন।

বললো, "দোস্ত, আমরা সবাই ভাবছি কক্সবাজার ঘুরতে যাব, তুই যাবি?"

আরিফের কল আমার জন্যে একেবারে সোনায় সোহাগা হয়ে দেখা দিল। ওদেরকে বলে-কয়ে অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়ে ফেললাম কক্সবাজার ভ্রমণ বাতিল করে বান্দরবান যাওয়ার। ওদের বোঝাতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে তবুও হাল ছাড়িনি কারণ অন্তত একটা বিষয় আমার জানা ছিল যে গ্রুপ ছাড়া পাহাড়ে যাওয়া হবে বোকামি। একা একা ভ্রমণ অনেক ব্যয়বহুল। আবার পাহাড়ে ট্র্যাকিং করার বিষয় থাকে বলে গ্রুপে যাওয়াটাই সুবিধা।

আমরা এই ভ্রমণে ১০টি জায়গায় ঘুরেছি;  স্বর্ণ মন্দির, মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র, রুপালী ঝরনা, নীলাচল, শৈলপ্রপাত, চিম্বুক পাহাড়, নীলগিরি, থানচি, সাঙ্গু নদী আর রেমাক্রি জলপ্রপাত। আর এতে আমাদের জনপ্রতি খরচ হয়েছিল সাড়ে ৬ হাজার টাকা।

ভ্রমণে আমরা ১০ জন ছিলাম। তবে ১৪ জনের গ্রুপ হলে তাকে নিখুঁত গ্রুপ বলা যায়, কারণ একটা চান্দের গাড়িতে বসার সিট থাকে ১৪টি। রেমাক্রি যাওয়ার জন্য যখন নৌকা নিতে হয় তখন সাথে করে একজন গাইড নিতে হয় কিন্তু একটি নৌকায় পাঁচ জনের বেশি ওঠা যায় না তাই পাঁচ জন করে দুই নৌকা আর গাইডসহ পাঁচজনের জন্য আরেকটা নৌকা নেওয়া যায়।

ঢাকা থেকে ২৭ নভেম্বর (২০১৯) রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে ফকিরাপুল থেকে সৌদিয়া পরিবহনের নন-এসি বাসে যাত্রা শুরু হয় আমাদের। বান্দরবান যাওয়ার জন্য আরো কিছু বাস রয়েছে যার মধ্যে অন্যতম সেন্ট মার্টিন পরিবহন (এসি/নন এসি), শ্যামলী পরিবহন, হানিফ পরিবহন, ইউনিক পরিবহন। এসব বাসে নন-এসির জন্য ভাড়া পড়বে ৬২০ থেকে ৭০০ টাকা আর এসি বাসের জন্য ৯০০ টাকা।

বান্দরবানে আমরা উঠেছিলাম বাসস্ট্যান্ডের একদম কাছেই হোটেল হিল ভিউতে। খুবই গোছানো আর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন একটি হোটেল। খাওয়ার জন্য যে রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থা রয়েছে তার মানও দারুণ। এখানে ১২০০ টাকা থেকে শুরু করে ২৫০০ টাকা ভাড়ার মধ্যেই ভালো রুম পেয়ে যাবেন। তবে পর্যটকদের চাপ থাকা মৌসুমে খরচ এর দ্বিগুণও হতে পারে।

আমরা তিন দিনের জন্য ১৪ হাজার টাকায় একটি চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করি ঢাকা থাকতেই। আপনারা চাইলে বান্দরবান পৌঁছে বাসস্ট্যান্ডের পাশেই চান্দের গাড়ির কাউন্টার থেকে গাড়ি ভাড়া নিতে পারেন। তবে বুকিং দিয়ে যাওয়াই ভালো।

২৮ নভেম্বর ভোর ৬টায় আমরা বান্দরবান পৌঁছাই। হোটেলে চেক ইন করে ফ্রেশ হয়ে সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত  রুমেই বিশ্রাম করি। তারপর হোটেলের রেস্টুরেন্টে নাস্তা সেরে সকাল ৯টার দিকে স্বর্ণ মন্দিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। স্বর্ণ মন্দিরে প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ৫০ টাকা এবং অবশ্যই পায়ের গোড়ালি ঢাকা জামা পরিধান করে খালি পায়ে প্রবেশ করতে হবে।

স্বর্ণ মন্দির পরিদর্শন শেষে আমরা যাই মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র ঘুরে দেখতে। এটি মূলত জেলা প্রশাসনের অধীনে পরিচালিত একটি পর্যটন কেন্দ্র। সুবিশাল এলাকা নিয়ে প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে উঠা এই পর্যটন কেন্দ্রকে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে কিছুটা আধুনিকতার ছোঁয়া দেওয়া হয়েছে। এখানে প্রবেশ করতে  জনপ্রতি ৫০ টাকা প্রবেশ মূল্য দিতে হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখার পাশাপাশি  চাইলে এখানে জনপ্রতি ৪০ টাকার বিনিময়ে কেবল কারে উঠার সুযোগও মিলবে।

ঝরনা দেখা শেষে পরিদর্শন শেষে আমরা হোটেলে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করি।  আমাদের এরপরের গন্তব্যস্থল নীলাচল, যার সৌন্দর্য উপভোগ করার আদর্শ সময় হলো বিকাল বেলা। নীলাচল থেকে সূর্যাস্ত দেখার স্মৃতি কখনো ভোলার মত না। নীলাচল মূলত জেলা প্রশাসনের অধীনে পরিচালিত একটি প্রাকৃতিক পর্যটন কেন্দ্র। এখানে প্রবেশ করতে জনপ্রতি ৫০ টাকা প্রবেশ মূল্য পরিশোধ করতে হলো আমাদের। নীলাচলে সূর্যাস্ত দেখে আমরা  সন্ধ্যায় বান্দরবান শহরে ফিরে এসে স্থানীয় বার্মিজ মার্কেট থেকে কেনাকাটা করি।

প্রথম দিনের ঘোরাঘুরি শেষে রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর চাইলে শহরে হেঁটে আসা যায়। আমরা অবশ্য রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি কারণ পরদিন খুব ভোরবেলা উঠে নীলগিরির উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে।

২৯ নভেম্বর। ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠে আমরা ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়ে ঠিক ভোর সাড়ে ৬টায় নীলগিরির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। যত তাড়াতাড়ি নীলগিরি যাওয়া যাবে তত কাছে থেকে মেঘ দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে।  সকাল ৯টারেআগেই নীলগিরি পৌঁছাতে পারলে আরো ভালো। সকাল ৯-১০টার পর আর মেঘের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

আমরা পৌঁছে যাই সকাল সাড়ে ৮টায়। আমাদের ভাগ্যও ভালোই বলা যায়, খুব কাছে থেকেই মেঘের দেখা পেয়েছি আমরা। আকাশ পরিস্কার থাকায় মেঘের সৌন্দর্য  বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল।

নীলগিরি ঘোরা শেষে আমরা রওনা হই থানচির পথে। থানচি থেকেই আমরা নৌকায় করে সাঙ্গু নদী হয়ে যাবো রেমাক্রি পর্যন্ত। থানচি পৌঁছে আমরা আমাদের আগে থেকেই কনফার্ম করে রাখা গাইডের দেখা পাই।

আমরা থানচি থানা থেকে অনুমতি নিয়ে বিজিবি ক্যাম্পে তা দেখিয়ে নৌকায় চড়ি। একটি নৌকায় ৫ জনের বেশি ওঠায় বিজিবির নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আমরা দুটো নৌকার ভাড়া আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম; প্রতিটি চার হাজার করে দুটো নৌকায় আট হাজার টাকা। আর রেমাক্রি পর্যন্ত গাইডের জন্য পনেরশ টাকা। সাঙ্গু নদী হয়ে ছোট নৌকায় চড়ে আমরা যখন রেমাক্রি পৌঁছি তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।

রেমাক্রি পৌছে আমরা মেলোডি গেস্ট হাউসে রাতে থাকি। এখানে থাকার জন্য মাথাপিছু দিতে হয়েছে দেড়শ টাকা করে। এখানে থাকতে হয় ঢালাই বিছানা করে। খাওয়ার জন্য সাদা ভাত, আলু ভর্তা, ডাল ও ডিম ভাজি অথবা সাদা ভাত, আলু ভর্তা, ডাল ও মুরগির মাংস মিলবে দেড়শ টাকায়। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত জেনারেটরের সুবিধা পাওয়া যাবে। এরপর  রয়েছে সৌর বিদ্যুতের সুবিধা।

৩০ নভেম্বর। আমরা সকাল ৯টায় নাস্তা সেরে নেই।। যারা রেমাক্রি থেকে নাফাখুম যেতে ইচ্ছুক তাদের ভোর ৬টায় রেমাক্রি থেকে নাফাখুমের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করতে হবে। এজন্য একজন গাইড নিতে হয়; রেমাক্রি থেকে নাফাখুম পর্যন্ত যার খরচ পরবে পাঁচশ টাকা। আমরা রেমাক্রি জলপ্রপাত দেখে ১০টায় থানচির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। দুপুর ২টায় চিম্বুক পৌঁছে দুপুরের খাবার খাই। চিম্বুক পাহাড় দেখার পর কিছুটা সময় শৈলপ্রপাত দেখে বিকালে বান্দরবান শহরে পৌঁছি।

যেহেতু আমাদের বাস ছাড়ার কথা রাতে সাড়ে ৮টায়, আমরা সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত হোটেলে বিশ্রাম করে রাতের খাবার খেয়ে বাসে উঠি। পরদিন ১ ডিসেম্বর ভোর সাড়ে ৫টায় আমরা ঢাকায় (ফকিরাপুল) এসে পৌঁছাই।