বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ ও আত্মত্যাগ এবং আমাদের দায়

মোনেম অপু
Published : 4 Sept 2021, 09:19 PM
Updated : 4 Sept 2021, 09:19 PM

আমি বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ ও আত্মত্যাগ বিষয়ে কিছু কথা লেখার চেষ্টা করব এবং চিহ্নিত করতে চেষ্টা করব তার জীবনাদর্শ ও আত্মত্যাগের সাথে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের জীবনের সম্পর্কটি কোথায়।

আধুনিক বিশ্বে একটি জাতি এবং সে জাতির অন্তর্গত ব্যক্তি মানুষদের পরিচয়, মর্যাদা, জীবন বিকাশের মাত্রা, নিরাপত্তা, সুরক্ষা, স্বাচ্ছন্দ, সুখ-শান্তি, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এসব কিছুর ক্ষেত্র হচ্ছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ আমাদের সেই রাষ্ট্র। সন্তানের সাথে পিতার যে সম্পর্ক, বাংলাদেশের সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কিটি ঠিক তাই। তার নিঃশেষে জীবন-প্রাণ উৎসর্জনের মধ্য দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রের সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধুর কাছে তাই আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ঋণ রয়েছে, তার ত্যাগ ও তিতীক্ষায় ভরা জীবনের ঋণ, তার রক্তের ঋণ।

বঙ্গবন্ধুর সাথে নাগরিক হিসেবে, ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমাদের আরেকটি সম্পর্ক রয়েছে। তিনি নিজের জীবনে একটি উচ্চ আদর্শ রূপায়িত করে আমাদের জন্য জীবনের আলো হয়ে আছেন। অর্থাৎ তিনি আমাদেরকে একটি দেশ দিয়ে গিয়েছেন এবং একই সাথে রেখে গিয়েছেন একটি অনন্য আদর্শ। নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সূর্যসম আর বিকীর্ণ আলোকসম হচ্ছে তার আদর্শটি।

স্কুল জীবনেই তিনি নিজেকে যুক্ত করতে থাকেন নানা রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্রে ও কর্মকাণ্ডে। মোটে ২০ বছর বয়সেই পার্শ্ববর্তী সকলের কাছে তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলী প্রকাশিত হয়েছিল। এ তো গেল সূচনা। তারপর ৫২, ৫৪, ৫৮, ৬৬, ৬৯, ৭০ হয়ে ১৯৭১।

এখানে একটি বিষয় আমাদেরকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রাখতে হবে। স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধটি নয় মাসের হলেও বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই এবং এ সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এখানে আরও একটি বিষয় স্মরণে রাখতে হবে। আমরা কেবল পরাধীন ছিলাম তা নয়, আমরা আত্ম-পরিচয় সংকটেও ভুগছিলাম।

১৯৪৮ সালে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৫৪'র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৮'র সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬৬'র ৬-দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনসহ বাঙালির আত্ম-পরিচয় নির্ধারণে, মুক্তি ও অধিকার আদায়ে পরিচালিত প্রতিটি আন্দোলনে তিনিই নেতৃত্ব দেন। এই সব ধাপ পেরিয়ে ১৯৭১ সালে তিনি আবির্ভূত হন স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের নেতা রূপে।

বাংলার শোষিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ও সমৃদ্ধিই ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য। যে লক্ষ্য অর্জনে তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। বারবার জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। মাত্র ৫৪ বছরের একটি জীবন তিনি পেয়েছিলেন। মোটামুটি ৩০ বছরের মতো তার রাজনৈতিক জীবন। এর মধ্যে ১৩ বছরই তিনি কাটিয়েছেন জেলে। মোট ১৮ বার কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। ২৪টি মামলা তাকে লড়তে হয়েছে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছেন দুইবার। আমার-আপনার, আমাদের পিতৃ-প্রজন্ম এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মুক্তির জন্য জেল-জুলুম-নিপীড়ন তার জীবনে একের পর এক অধ্যায়ের পর অধ্যায় রচনা করেছে।

পাকিস্তানি হানাদাররা যখন তাদের নৃশংস হামলার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি সম্পন্ন করল তখনও তিনি বাংলার মানুষকে একা ফেলে আত্মগোপন করলেন না, অন্যত্র চলে গেলেন না। ফাঁসির সম্পূর্ণ ঝুঁকি নিয়ে তিনি থেকে গেলেন প্রকাশ্যে, তাঁর বাসভবনে, শুভানুধ্যায়ীদের হাজারও পরামর্শ বিকারশূন্য চিত্তে উপেক্ষা করে। তারপর এলো ১৯৭৫ সালের সেই কালোরাত। বঙ্গবন্ধু শহীদ হলেন সপরিবারে।

বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন কাটিয়েছেন অত্যন্ত সাদামাটা ভাবে। বিলাসিতার ধারে কাছেও যাননি তিনি। যখন ক্ষমতার শীর্ষে তখনও তিনি বসবাস করেছেন ৩২ নম্বরের একটি সাধারণ বাসায়। আর একারণেই দারিদ্র্য-পীড়িত গ্রামবাংলার গণমানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা ছিলেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু সর্বোতভাবে মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। রাজনীতিতে জড়িত হয়েছিলেন দেশের মানুষের দুঃখ ঘোচানোর জন্য। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিজীবন বলতে কিছুই ছিলনা। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান, স্বপ্ন-কর্ম সবই ছিল আমাদের মঙ্গলের জন্য। তাঁর পুরো জীবনটাই ছিল বাঙালির জন্য নিবেদিত তাই ফাঁসির মঞ্চকেও কখোনো তিনি ভয় পাননি। ভোগ নয়, রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর বাস্তব জীবন ও আদর্শ— দুটোই রচিত হয়েছে পরার্থপরতা ও ত্যাগের উপর।

মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে ইংরেজ শাসনামলে বাংলা রাজানুকূল্য পায়নি। তারপর পাকিস্তানের শাসকবর্গের কাছ থেকে পেয়েছে ধারাবাহিক প্রতারণা, নিষ্ঠুর শোষণ আর অভাবনীয় বঞ্ছনা। বলা চলে, শত বছরের উপেক্ষিত জাতিকে বিশ্ব-আঙিনায় একটি স্বতন্ত্র সত্ত্বা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে নিরলসভাবে, লক্ষ্যের পানে স্থির দৃষ্টিতে পরিশ্রম করে গেছেন তিনি, লড়ে গেছেন ক্লান্তিহীনভাবে এবং অবশেষে সফল হয়েছেন।

এ থেকে আমারা পেলাম মুজিব জীবনের তিনটে প্রধান বৈশিষ্ট্য: বিলাসমুক্ত জীবন, পরার্থপরতা এবং লক্ষ্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়।

বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠ গুণ হচ্ছে তার লালিত এবং রাজনৈতিক জীবনে রূপায়িত ন্যায়পরায়নতা। এটাকে বলা যায় রাজনৈতিক ন্যায় সচেতনতা। নেতৃত্বের এবং জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত হওয়া, একটি ঐকবদ্ধ জাতিকে মরণপণ-অনুসারী—যাকে বলে ডাই হার্ড ফলোয়ার—রূপে পাওয়া এবং জাতিগত দ্বন্দ্বের জটিলতম ক্ষণে নেতৃত্ব দেয়া একজন রাজনৈতিক নেতার জীবনে এই ন্যায় সচেতনতা যে কতখানি গুরুত্বের সাথে বিবেচ্য এবং আমাদের কালে এমন রাজনৈতিক নেতার অস্তিত্ব বিশ্ব দরবারে যে কতখানি অনন্য, তুলনাহীন তা একটু ব্যাখ্যা করে বলা দরকার।

আমাদের কাল জাতীয়তাবাদের কাল। জাতির স্বার্থে নৈতিক নিয়ম ভঙ্গ করতে একালের বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সাধারণত দ্বিধা করেন না। কিন্তু মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার কালে বঙ্গবন্ধু ন্যায় ভেঙে একটি কথাও বলেননি, একটি প্রস্তাবও দেননি, একটি পদক্ষেপও গ্রহণ করেননি। তিনি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও এই ন্যায় পরায়নতাকে ব্যবহার করেননি। তিনি ন্যায্যতাকে প্রতিপালন করেছেন সকল প্রকার স্বার্থ-ভাবনা নিরপেক্ষভাবে। ন্যায়ের খাতিরেই তিনি ন্যায়নীতি অনুসরণ করেছেন, অনপেক্ষভাবে। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে তিনি গোপনেও কোনো অন্যায় পদক্ষেপ নেননি। কোনো ষড়যন্ত্র করেননি। এই গুণ তাঁর মধ্যে ছিল বলেই তিনি স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে পারতেন, প্রকাশ্যে বীরের মতো রাজনীতি করতেন, কোনোদিন পলায়ন করেননি, আত্মগোপন করেননি।

অহিংসা, মমতা ও ন্যায়—মানবজীবনের এই তিন প্রধান নৈতিক সূত্রে বঙ্গবন্ধুর জীবন ছিল ভাস্বর। মিত্র বা শত্রু কারও সঙ্গেই প্রতারণা না করা, কপটতা না করা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি না দেওয়া, আঘাত না করা ছিল তাঁর জীবনের ভিতগত আদর্শ। ভালোবাসায় সকলকে কাছে টানা ছিল তাঁর অন্যতম বিশিষ্টতা। তাঁর কণ্ঠস্বর ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ ছিল শাশ্বত ন্যায়ের পথে পরিচালিত। সততা, নীতিপরায়ণতা, যত্নশীলতা, অধ্যবসায়, সাহস, মানুষের উপর আস্থাশীলতা, স্পষ্টবাদিতা, লক্ষ্যের প্রতি অবিচল দৃষ্টি ইত্যাদি তাঁর অন্যান্য বহুবিধ নৈতিক গুণের অন্যতম।

আমি দুটো বিষয়কে আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করছি। এক- বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগের বিশালতা; দুই- বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ। প্রথমটি অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ আবার আরেকটি বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত। সেটি হচ্ছে আমার-আপনার আত্ম-পরিচয় ও স্বাধীন আবাস; যে দুটিকে একত্রিত করে বলা যায়: বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবন উৎসর্জনের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত আত্ম-পরিচয় ও স্বাধীন দেশ। তাহলে বঙ্গবন্ধুর সাথে আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কী দাঁড়াচ্ছে? এখন আমাদের করণীয় কী হচ্ছে?

আমার-আপনার জীবনে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ অবদানটি হচ্ছে স্বাধীনতা। আর এই স্বাধীনতার জন্য জীবনভর ধারাবাহিকভাবে তিনি ত্যাগ স্বীকার করে গিয়েছেন, সহ্য করে গিয়েছেন যাতনা এবং সবশেষে শাহাদত বরণ করেছেন, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, তাদের স্ত্রী-স্বামী, শিশুপত্র রাসেল, আত্মীয়-বর্গসহ। এ হচ্ছে আমার-আপনার জগতের সব বিষ পান করে আমাদের জন্য বিষমুক্ত জগত রেখে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তাই আমরা প্রত্যেকে বঙ্গবন্ধুর জীবনের যাতনা, ত্যাগ ও রক্তের ঋণে আবদ্ধ। এই ঋণের বিশালতাকে আন্তরিকভাবে অনুভব করা আমাদের নৈতিক ও নাগরিক দায়, যা ছাড়া একজন নৈতিক মানুষ ও সুনাগরিক হওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব।

স্বাধীনতার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার আদর্শ, যার সাথে সম্পর্কিত আমাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা। তার জীবনাদর্শ বিষয়ে আমাদের করণীয় হচ্ছে, সেটিকে মর্মে মর্মে অনুধাবন করা এবং জীবনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অঙ্গনে সে আদর্শ আন্তরিকতা ও আগ্রহের সাথে রূপায়িত করা। এটা ঋণ স্বীকৃতির চেয়ে বেশী কিছু। অনেক অনেক বেশি কিছু। এটা সাধনার, এটা কষ্টের। আর এই সাধনার মধ্যে সুপ্ত আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ, আমাদের অনাগত প্রজন্মের মুখের হাসি।

মোট কথা, বিশ শতকের বাঙালি জাতির নবজাগরণের প্রাণ-পুরুষ হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বাংলার জনগণের পরিচয়-সংকট মোচনে ত্রাণ-পুরুষ। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কেন্দ্র-পুরুষ। প্রত্যেক জাতির শ্রেষ্ঠ পুরুষ থাকে। আমাদের শ্রেষ্ঠ পুরুষ বঙ্গবন্ধু। বাঙালির চেতনায়, মননে ও জীবনে বঙ্গবন্ধু সদা-প্রত্যাবর্তনশীল এক বীর, অনির্বান শিখা। ওরা তাকে হত্যা করতে পারেনি।

বঙ্গবন্ধুকে জানলে আমরা আমাদের চেতনাকে নতুন করে শানিত করতে পারবো। নতুন অঙ্গীকারে নিজেদেরকে উজ্জীবিত করতে পারবো। শোক হয়ে উঠবে শক্তি।