পিএইচডি সমাচার

সৌমেন রুদ্র
Published : 28 August 2020, 10:52 AM
Updated : 28 August 2020, 10:52 AM

কাছের কিংবা দূরের কেউ জিজ্ঞাসা করলেই হল- আমার উত্তর প্রস্তুত; সুযোগ থাকলে এইবার পিএইচডি করেই ফেলুন। আসলে সুশিক্ষিত জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গঠনে উচ্চতর শিক্ষা ব্যবস্থায় পিএইচডি ডিগ্রির প্রচলন অনেক বেশি অবদান রাখবে। গবেষণা ও আবিষ্কারের মত শব্দ আমাদের শিক্ষার সাথে সংযুক্ত করেতে হবে। আর তাতেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উচ্চতর শিক্ষা ও পিএইচডি করায় উৎসাহ জেগে উঠবে।

পিএইচডির অর্থ হল ডক্টর অফ ফিলোসফি। পিএইচডি একটি উচ্চতর শিক্ষাগত ডিগ্রি। বিজ্ঞান ও কলার বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা জন্য স্নাতক উত্তীর্ণ গবেষককে এই ডিগ্রি দেওয়া হয়।সাধারণত একজন গবেষককে গবেষণার বিষয়ে অভিজ্ঞ কোনো অধ্যাপকের অধীনে গবেষণা করতে হয়। ডক্টর অফ ফিলোসফি ডিগ্রি অর্জন করেছেন এমন কেউ সাধারণত তাদের নামের আগে 'ড.' বসাতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদ পেতে হলে অবশ্যই এই ডিগ্রি অর্জন করতে হয়।

কোনো কোনো গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গড়ে বিশ্বের ২৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সের যে সব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, তাদের মধ্যে মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ পিএইচডি করেছেন। এতে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক যে পিএইচডি বেশ বিরল। বাংলাদেশেও সেই সংখ্যা অনেক অনেক কম হবে। বাস্তবতা হচ্ছে আমি বাংলাদেশের জন্য কোনো পরিসংখ্যান খুঁজে পাইনি।

তবে অন্য দেশের কিছু পরিসংখ্যান খুঁজে পেয়েছি। ২০১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৬৭ হাজার ৪৪৯ জন ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করে। তারপরে রয়েছে জার্মানি; ২৮ হাজার ১৪৭ জন।  যুক্তরাজ্যে পিএইচডি ধারী রয়েছে ২৫ হাজার ২০ জন।

বাংলাদেশের পাশের দেশ ভারত রয়েছে চতুর্থ স্থানে; ২৪ হাজার ৭০০ জন ভারতীয়র এই ডিগ্রি নিয়েছেন। যেহেতু এইসব দেশে জনসংখ্যা বেশি, তাই পিএইচডি ডিগ্রির সংখ্যা বেশি হওয়াটাও স্বাভাবিক। এজন্য তথ্যটি শতাংশের হিসেবে দিলে বাস্তবতা বুঝতে সুবিধা হবে।

২৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সের মধ্যে স্লোভেনিয়া এবং সুইজারল্যান্ডের জনসংখ্যার ৩.৮ শতাংশ এবং ৩.২ শতাংশ ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছেন। শিক্ষা এবং ডিজিটাইলেশনের দিক থেকে স্লোভেনিয়া যে গত এক দশকে বেশ এগিয়ে গিয়েছে এই পরিসংখ্যান তারই প্রতিফলন।

কেন পিএইচডি করতে হবে? 
পিএইচডি করতে গিয়ে মানুষ শুধু একাডেমিক কিছু আবিষ্কার করে কিংবা ভালো কোনো সাইন্টিফিক আর্টিকেল লিখতে পারে শুধু তা না, নিজেকে নিয়েও অনেক কিছু শিখতে পারে। পিএইচডি করার সময়টা হল নিজের কিছু সুপ্ত বৈশিষ্ট্য বিকাশ করার উত্তম সময়। কোনো কিছু নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা কিংবা গবেষণা করার ধারনাটা আমি পিএইচডি করতে গিয়েই পেয়েছিলাম। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ কীভাবে শেষ করতে হবে অর্থ্যাৎ টাইম ম্যানেজমেন্ট বিষয়টাও পিএইচডি চলার সময় বেশ কার্যকরী শিক্ষা।

গবেষণার তৃষ্ণা বা ক্ষুধা থাকলে পিএইচডি করুন:

অনেকের স্বপ্নই থাকে কিছু নিয়ে গবেষণা করার। কিংবা আপনি শখ হিসাবে অসংখ্য ছোট 'গবেষণা প্রকল্প' করছেন। এমনও হতে পারে, আপনার মধ্যে জ্ঞানের স্বাভাবিক একটা তৃষ্ণা আছে। অথবা কোনো নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে বই পড়ার জন্য অতৃপ্ত ক্ষুধা থাকতে পারে; এরকম কিছু লক্ষণ থাকলে গবেষনার দিকে যাওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, গবেষনার বিষয় কিন্তু নিজের পছন্দ হতে হবে।

লক্ষণীয় কিছু অর্জন করতে চাইলে পিএইচডি করুন:

যাদের অর্থ উপার্জনের লক্ষ্য রয়েছে তাদের উচিৎ উদ্যোক্তা হওয়া। তবে যদি নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান বা একটি কঠিন লক্ষ্য অর্জন করতে চান সেক্ষেত্রে ডক্টরেট ডিগ্রিটা বিশেষ কাজে দেবে।

নতুন কিছু আবিষ্কার ও শিখতে পিএইচডি করুন:

যাদের মধ্যে মৌলিক কিছু আবিষ্কার নিয়ে কৌতূহল থাকে, তাদের উচিত পিএইচডির দিকে যাওয়া। যদি আপনি নিজের ভেতর কোনো চালিকা শক্তি অনুভব করেন যা আপনাকে নতুন কিছু জিনিসের অনুসন্ধান দিতে পারে তবে আপনি গবেষণা পছন্দ করতে পারেন এবং ডক্টরেট ডিগ্রি আপনার জন্য উপযুক্ত।

নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করতে হলে পিএইচডি করুন:

কেউ যদি বেতন বৃদ্ধির খাতিরে পিএইচডি করতে চায়, তা নিশ্চয়ই বেমানান হবে। তবে আপনি যদি কোনো সমস্যা বোঝার এবং সমাধান করার জন্য নিজের দক্ষতা উন্নত করতে চান। সেক্ষেত্রে পিএইচডি করে আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারেন।

পিএইচডি করার উপরের সব কারণগুলোই বৃথা যাবে যদি না আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সময়োপযোগী করতে পারি। আমার মতে উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে যে সকল পরিবর্তন আনা দরকার, তা হচ্ছে,  উচ্চশিক্ষার জন্য বাজেট বাড়ানো ও পিএইচডির জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা; বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের সক্ষমতা অর্জন করা; গবেষণা ভিত্তিক এবং প্রজেক্ট ভিত্তিক শিক্ষার প্রচলন করা; বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে ন্যূনতম ডক্টরেট ডিগ্রির প্রচলন করা; বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য শিক্ষাবিজ্ঞানগত শিক্ষার (pedagogical education) ব্যবস্থা করা; ইন্ডাস্ট্রিয়াল পিএইচডির (শিল্প-কারখানা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ পরিচালনায়) প্রচলন করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা পরিষদে গবেষনায় অভিজ্ঞ ও পারদর্শী অধ্যাপকের নিয়োগ দেওয়া।

যারা শিক্ষকতা পেশায় আছেন, তাদের উচিত ডক্টরেট ডিগ্রির পথে এগোনো। পৃথিবীর অনেক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি ছাড়া শিক্ষকতায় যাওয়া যায় না। বাংলাদেশে এখনো সম্ভব কিন্তু ভবিষ্যতে অনেক পিএইচডি ডিগ্রিধারী ব্যক্তি থাকবে, তখন হয়ত আর সম্ভব হবে না। তাই এখন থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভালো।

বাংলাদেশে মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থায় গবেষণা খুবই উপেক্ষিত। গবেষণার চেয়ে বিসিএস দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে সবার নজর। কিছু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি চালুর মাধ্যমে মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থায় গবেষণাকে জনপ্রিয় করে তোলা সম্ভব বলে আমার ধারণা।

পিএইচডি করলেই যে একজন ব্যক্তিকে শিক্ষকতা করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এখন অনেক বড় বড় কোম্পানি আছে, যারা চাকরির ক্ষেত্রে পিএইচডি খোঁজে। আরেকটা তথ্য না দিলেই নয়, পিএইচডি ডিগ্রির পর ভালো চাকরি পাওয়ার পরিসংখ্যানটা অনেক বেশি। আর তাই যারা মাস্টার্সের পর সিন্ধান্তহীনতায় ভুগছেন, তারা এবার পিএইচডির জন্য আবেদন শুরু করতে পারেন।

তথ্যসূত্র:
১। OECD (2019), Education at a Glance 2019: OECD Indicators, OECD Publishing, Paris, https://doi.org/10.1787/f8d7880d-en.
২। https://www.weforum.org/agenda/2019/10/doctoral-graduates-phd-tertiary-education/