মহামারীর দিনে ‘সোহরাব সেপেহরি ও অন্যান্য ইরানি কবির কবিতা’ পাঠ

মোরশেদ তালুকদার
Published : 7 August 2020, 06:56 AM
Updated : 7 August 2020, 06:56 AM

বাসায় থাকতে থাকতে কেমন বিরক্ত লাগছিল। তাই সময় কাটানোর জন্য 'বুক সেলফ' থেকে বের করলাম 'সোহরাব সেপেহরি ও অন্যান্য ইরানি কবির কবিতা'। পড়তে গিয়ে কয়েকটি লাইনে আটকে গেলাম; লাইনগুলো ছিল-

"যেখানেই আমি থাকি, সেটা বড় কথা নয়,
আকাশ সর্বদা আমার।
জানলা এবং হাওয়া আমার,
ভালোবাসা এবং আলোক, পৃথিবী এবং জল।
তাই মাঝে-মাঝে চতুর্দিকে নিঃসঙ্গতার পত্রালী
জন্মালে জন্মাক, আমি নিরুদ্বেগ।"

ইরানের কবি সোহরাব সেপেহরি (১৯২৮-১৯৮০) ১৯৬৪ সালে লিখেছিলেন  'সেদয়ি পয়ি অব্' শিরোনামে তার অমর কবিতা। সমালোচকদের ভাষায়, পৃথিবীরই অন্যতম শ্রেষ্ঠ এ কবিতা। দীর্ঘ এ কবিতার অনুবাদ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও কবি মহীবুল আজিজ। তিঁনি কবিতাটির অনূদিত শিরোনাম দিয়েছেন,  'জলের পদধ্বনি'। উপরের অংশটি ( যেখানেই আমি থাকি….. আমি নিরুদ্বেগ) অনূদিত  'জলের পদধ্বনি'  থেকে নেওয়া।

আধুনিক ইরানি কাব্যের পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম সোহরাব সেপেহরি। তার কবিতা ইংরেজি, স্পেনিয়, ফরাসি, জার্মান, সুইডিশ, আরবি, তুর্কি, রুশ এবং ইতালিয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। 'জলের পদধ্বনি' কবিতাটি সোহরাব সেপেহরি'র অন্তর্গত আত্মজীবনী হিসেবে গণ্য।

এ কবিতা নিয়ে কবি মহীবুল আজীজের বিশ্লেষণ হচ্ছে- "প্রকৃতির অসাধারণ মহিমার মধ্যে তিনি (সোহরাব সেপেহরি) সৃষ্টিকর্তার বিরাজমানতকে অবলোকন করেছেন। সহজতা ও সরলতার ঋজু বাকপটুতাও যে কাব্যসাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে সেপেহরির কবিতা তার দৃষ্টান্ত।"

সোহরাব সেপেহরিসহ বত্রিশ জন ইরানি কবির অনূদিত কবিতা নিয়ে গত বইমেলায় মহীবুল আজিজের প্রকাশিত গ্রন্থের নাম  'সোহরাব সেপেহরি ও অন্যান্য ইরানি কবির কবিতা'। অবশ্য এ গ্রন্থটি গৌরবময় ফারসি ভাষা-সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিককালের কবিদের কবিতার অনুবাদ স্থান পেয়েছে। তবে অতি সাম্প্রতিক নয়।

যারা বিশ্বসাহিত্যের খোঁজ-খবর রাখেন তারা নিঃসন্দেহে সর্বকালের সেরা কবি জালালুদ্দিন রুমির উত্তসূরিদের কাব্যপ্রতিভা সম্পর্কে অবগত আছেন। শব্দ, চিত্র, উপমা, দৃশ্য, বাকপ্রতিমা সবকিছুকে এক আশ্চর্য সংবেদনায় জীবনের গভীরে নিয়ে যেতে' সক্ষম হয়েছেন ইরানের কবিরা। তাই  'সোহরাব সেপেহরি ও অন্যান্য ইরানি কবির কবিতা' কাব্যপ্রমীদের মনকে আলেড়িত করবে নিঃসন্দেহে।

যেসব ইরানি কবির অনূদিত কবিতা এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তারা হচ্ছেন- নিমা ইউশিয (১৮৯৫-১৯৬৯), ফরিদুন তাবাল্লালি (১৯১৯-১৯৮৫), শাহনাজ আ'লামি (১৯২২-২০০৩), ঝালেহ এস্পাহানি (১৯২১-২০০৭), মনুচেহর শেয়রানি (১৯২৩-১৯৯১), আহমদ শামলু (১৯২৫-২০০০), এসমাইল শাহরুদি (১৯২৫-১৯৮১), সিয়াভাশ কাসরায়ি (১৯২৬-১৯৯৬), মোহাম্মদ যোহরি (১৯২৬-১৯৯৫), নসরৎ রাহমানি (১৯৩০-২০০০), বিযন জালালি (১৯২৭-২০০০), সিমিন বেহবাহানি (১৯২৮-২০১৪), হাসান হোনারমান্দি (১৯২৮-২০০২), হুসাঙ এব্ তেহাজ (জন্ম ১৯২৮), মেহদি আখাভান সালেস (১৯২৮-১৯৯০), নাদের নাদেরপুর (১৯২৯-২০০০), মনুচেহর আতাশি (১৯৩১-২০০৫), ইয়াদোল্লা রাবাবি (জন্ম ১৯৩২), ফররুখ তামিমি (১৯৩৪-২০০৩), বাহমান ফারসি (জন্ম ১৯৩৪), মাহমুদ মশাররফ আজাদ তেহরানি (১৯৩৪-২০০৬), ফরোগ ফরোখজাদ (১৯৩৪-১৯৬৭), মাহমুদ কিয়ানুশ (জন্ম ১৯৩৪), তুরায রাহনামা (জন্ম ১৯৩৭), শাবাব ভ্যা্যদি (জন্ম ১৯৩৭), তাহেরেহ সফরযাদেহ্ (১৯৩৮-২০০৮), এসমায়েল খোয়ি (জন্ম ১৯৩৮), এসমাইল নুরি-আলা  (জন্ম ১৯৪৩), মিনা আসাদি ( জন্ম ১৯৪৩), ঝিলা মোসায়েদ (জন্ম ১৯৪৮) এবং আলি-রেজা নুরিজাদেহ (জন্ম ১৯৪৯)।

'সোহরাব সেপেহরিও ও অন্যান্য ইরানি কবির কবিতা' গ্রন্থে শুধু অনুবাদ করেই দায় সারেননি মহীবুল আজিজ। বত্রিশ জন কবির সংক্ষিপ্ত জীবনীও তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি সতের পৃষ্ঠার ভূমিকায় ইরানি কাব্যরে চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন এবং এর মধ্য দিয়ে ফারসি কবিদের মনোজগৎ এবং কবিতার অন্তর্নিহিত রহস্যের উন্মোচন করেছেন; যা একজন নবীন পাঠকের ভাবনাকে আরো প্রসারিত করতে সহায়তা করবে।

যেমন- আলি-রেজা নুরিজাদেহ-র 'হাসিবা বুল্ মেরকা' শিরোনামের কবিতা সম্পর্কে মহীবুল আজিজ লিখছেন- "আলজেরিয়ার দৌড়বিদ হাসিবা অলিম্পিকে পদক অর্জন করলে সেটির প্রতিক্রিয়ায় ফারসি ভাষার কবি আলি-রেজা কবিতাটি রচনা করেন। কবিতাটিকে বলা যায় পৃথিবীর নারী-স্বাধীনতা এবং প্রগতির সপক্ষে একটি অনন্যসাধারণ সৃজনশীল সৃষ্টি। গোঁড়া-রক্ষণশীল হাসিবা'র দৌড়ময় পায়ের চিত্রকল্পকে তিনি এঁকে দেন চিরন্তনতার প্রেক্ষাপটে-

"এখন ইতিহাসের সবচাইতে সুন্দর পরীটি
তার পা দিয়ে
রাত্রি কাঁচের ওপর এঁকে দেয়
স্বাধীনতার প্রভাতের ছবি।"

মহীবুল আজিজের জন্ম ১৯৬২ সালের ১৯ এপ্রিল। তিঁনি গত চারদশক ধরে লেখালেখি করছেন। গল্প, উপন্যাস, কাব্য, প্রবন্ধ, গবেষণা, গীতি কবিতা ও অনুবাদ ইত্যাদি মিলিয়ে তার অর্ধশতাধিকেরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তিঁনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সভাপতি ছিলেন।