করোনাভাইরাস: খাদ্য সেবার হাল

সিরাজুস সালেকিন চৌধুরী
Published : 18 April 2020, 07:49 PM
Updated : 18 April 2020, 07:49 PM

৮ মার্চ  বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে রোগী শনাক্ত করা হলো প্রথমবারের মতো। ওইদিন দুপুরের পর থেকে দেশের ওষুধের দোকানগুলোতে লম্বা লাইন। পাঁচ টাকার মাস্ক ১৫ টাকা, ২০ টাকার মাস্ক ১০০ টাকা। লাইন ধরে মানুষ কিনেছে। সন্ধ্যার মধ্যে স্টক আউট। সন্ধ্যার পরে রাজধানীর বড় বড় ওষুধের দোকানে আর মাস্ক স্যানিটাইজার পাওয়া যাচ্ছিল না।

এর আরও দুইমাস আগে থেকে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার স্টক করেছে। চীনের উহানে ভাইরাস আক্রমণ করেছে, আর তার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বাজারে। এটাই বোধ হয় বৈশ্বিক অর্থনীতির ধর্ম।

এখনও পাঁচ টাকার মাস্ক ৩০ টাকা। মাস্ক নেই তা নয়, তবে  সরবরাহ করবে কে? জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কে নামবে রাস্তায়? ওষুধের দোকানে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার না পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, তারা গায়ের মূল্যের অতিরিক্ত মূল্য চাইতে পারে না। সরবরাহকারী যারা আছে তারা আবার এই অতিরিক্ত মূল্য ছাড়া ওষুধের দোকানে পণ্য দিবে না। এই সরবরাহকারীরা আবার খুচরা পণ্য বেচবেও না। ফলে এক শ্রেণির অনলাইন ব্যবসায়ী কয়েকগুণ বেশি দামে খুচরা বাজারে পণ্য বিক্রি করছে।

মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বাজার কেন অস্থির তা ব্যবসায়ীরাই আরও বলতে পারবে। কয়েকজন মানবিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হলো। কি করছেন তারা? জানতে চাইলে উত্তর, ভাই বেঁচে থাকলে অনেক ব্যবসা করা যাবে। ব্যবসায়ীরা শুধু শরীরটাকে কোয়ারেন্টিনে নেননি, মনুষ্যত্বকেও কোয়ারেন্টিনে পাঠিয়েছেন।

তবে মাস্ক ও স্যানিটাইজারের চেয়ে এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অভুক্তদের মুখে খাবার পৌঁছে দেওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা গ্রুপ ফুড ব্যাংক তৈরি করেছে। যার কিছু অংশ বিতরণের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। এই ফুড ব্যাংকের লক্ষ্য হচ্ছে, ওই শ্রেণির লোকজনের কাছে খাবার পৌঁছানো যারা রাস্তায় নেমে ত্রাণ সংগ্রহ করতে পারছে না। এটা খুব কঠিন একটা কাজ। এ ধরনের লোকজন সাধারণত মুখে কারও কাছে চাইতে পারে না।

আমার দায়িত্ব ছিল এই গ্রুপের লোকজনকে খুঁজে তাদের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়া। গত এক সপ্তাহ ধরে আমি নিয়মিত মাঠে থেকে কিছু লোকজনকে শনাক্ত করে তাদের বাসায় খাবার পৌঁছানোর চেষ্টা করি।

একদিন কাঁটাবন হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছিলাম। বিপরীত থেকে চার-পাঁচটা রিকশায় ত্রাণ নিয়ে আসছিলেন কিছু লোক। ব্যাটারি চালিত রিকশাগুলোর পেছন পেছন ধাওয়া করছে কিছু নারী-পুরুষ-শিশু। এক পর্যায়ে ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধা রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। সামনে থাকায় আমি তাকে উঠে দাঁড়াতে সহায়তা করি। একটু পর বৃদ্ধার সঙ্গী তার নাতি ও ছেলের বউ এসে হাজির। সপরিবারে ত্রাণের রিকশা ধাওয়া করছে তারা।

বৃদ্ধার ভাষ্য, তিন দিন ধরে ঘরে কোনো খাবার নেই। হাজারীবাগের একটা কোম্পানিতে কাজ করতেন তারা।

ঘটনা শুনে আমার কাছে থাকা একটা খাবারের প্যাকেট তাকে দিলাম। এরপর মূহূর্তের মধ্যে আর পাঁচ-ছয় জন সেখানে হাজির।  ওই মুহূর্তে তাদের চোখ-মুখের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল আমার কাছে ত্রাণ আছে জানতে পারলে আমাকে আটকে ফেলবে।

পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, সরকার থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ যাচ্ছে এলাকাগুলোতে। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। যারা সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার তারাই শুধু ত্রাণ পাচ্ছেন। বাকিদের দেওয়া হচ্ছে না। ফলে ঢাকার বাইরে থেকে আসা শ্রমজীবীরা সরকারের সহায়তা থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে।