এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হবে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে প্রকৃত ভাতাভোগী বাছাই কার্যক্রমের মত কার্যকরী উদ্যোগে সরকারি সেবাকে প্রান্তিক জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে বাঙালির জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পরিকল্পনা হাতে নেয় সমাজসেবা অধিদপ্তর।
কুষ্টিয়ার কালেক্টরেট চত্বরে উন্মুক্ত ভাতা বাছাই। ছবি: কাজী শামীম আহমেদ
জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের মাহমুদা খাতুনের জন্মসাল ১৯১০। শতবর্ষী বৃদ্ধ-বিধবা, সহায় সম্বলহীন বাস্তুচ্যুত এ মানুষটি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন সরকারের সামাজিক নিরাপত্তার ভাতার কার্ড পাওয়ার আশায়।
মাহমুদা খাতুন সরকারের দেওয়া প্রবীণ নাগরিকদের জন্য ভাতা প্রাপ্তির একাধিক শর্ত পূরণ করেছেন বহু আগেই। প্রতি বছর নতুন বরাদ্দ এলেই ধরনা দিয়ে দিয়ে হতাশায় ন্যূজ এই বৃদ্ধা এবার বেজায় খুশি; কারণ এ বছর তিনি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বয়স্ক ভাতার জন্য বিবেচিত হয়েছেন।
মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংকে একাউন্ট খুলে অপেক্ষায় আছেন মুজিববর্ষের ক্ষণে বুঝে পাবেন কাঙ্ক্ষিত সেই বয়স্ক ভাতার কার্ড; যেটি আমৃত্যু তাকে মাসিক হারে সরকার নির্ধারিত টাকা পৌঁছে দেবে।
মাহমুদা এসেছিলেন বাড়ির পাশের স্কুলের মাঠে। আগের দিন সেখানে মাইকে ঘোষণা এলো, সরকার এবার উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ভাতাভোগী বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই ঘোষণা শুনে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে মাঠে আসতেই হাতে হাতে ফল পেলেন। এবার আর খালি হাতে ফিরতে হয়নি তাকে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজে তাকে ভাতার জন্য নির্বাচিত করেছেন। মুজিববর্ষের ঊষালগ্নে এমন প্রাপ্তির গল্প এবার দেশ জুড়ে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মানিকছড়ি উপজেলায় প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের কাজ। ছবি: আইনুল হোসেন জিলানী
মাহমুদা খাতুনের মত অসংখ্য প্রবীণ, বিধবা, প্রতিবন্ধী (সুবর্ণ) নাগরিক সারা দেশব্যাপী, সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত উন্মুক্ত যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা সুবর্ণ নাগরিক কার্ড দেখিয়ে সরেজমিনে স্বচ্ছ ও পক্ষপাতহীন ভাবে বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ডের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সাথে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদও এক্ষেত্রে রেখেছে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে।
ভাতাভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বর্তমানে সরকারি নীতিমালায় রয়েছে একাধিক কমিটি। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে রয়েছে ইউনিয়ন বাছাই কমিটি। প্রাথমিক তালিকায় নির্বাচিতদের মধ্য থেকেই উপজেলা কমিটির সিদ্ধান্তে চূড়ান্তভাবে কেউ বিবেচিত হন এবং ভাতা পেয়ে থাকেন।
নরসিংদীর বেলাব উপজেলার বাজনাব ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে উন্মুক্ত বাছাই। ছবি: অনিক রায়
'মুজিব বর্ষের চেতনায়, সমাজসেবা দোরগোড়ায়' প্রতিপাদ্যে গত ডিসেম্বর মাসে সমাজসেবা অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা এবং অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা কার্যক্রমে 'উন্মুক্ত বাছাইয়ের' মাধ্যমে ২০১৯-২০ অর্থ বছরের নতুন উপকারভোগী নির্বাচনের নির্দেশনা প্রদান করেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেশব্যাপী ৬৪ জেলার ৪৯২টি উপজেলা ও ৮০টি শহর সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে, স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদের সার্বিক সহযোগিতায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও মাইকিং করে উন্মুক্ত খোলা মাঠে, ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে স্বচ্ছতা ও নিরপক্ষতা বজায় রেখে প্রকৃত উপকারভোগী নির্বাচন করা হয়।
জনসম্মুখে সেবা প্রত্যাশী জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বয়স, স্বাস্থ্যগত অবস্থা, ভূমির মালিকানা ইত্যাদি মানদণ্ড বিবেচনায় সামাজিকভাবে সর্বাধিক অরক্ষিত ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তালিকা প্রণয়ন করা হয়।
কুষ্টিয়ার কালেক্টরেট চত্বরে উন্মুক্ত ভাতা বাছাই উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেন ছবি: কাজী শামীম আহমেদ
সমাজসেবা অধিদফতরের বর্তমান মহাপরিচালক শেখ রফিকুল ইসলাম আগামী ১৫ মার্চের মধ্যেই সব ইউনিট অফিসকে উন্মুক্ত পন্থায় ভাতাভোগী নির্বাচনের কার্যক্রম সম্পন্ন করবার নির্দেশনা দিয়ে পত্রজারি করেছেন; যাতে করে ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর দিন নবনির্বাচিত উপকারভোগীদের হাতে ভাতার কার্ড পৌঁছে দেওয়া যায়।
গত জানুয়ারিতে ই-ফাইলিং এ ব্যবহারে সরকারি ৩৫৩টি দপ্তরের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জনকারী এবং প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার কাছ থেকে 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' সম্মাননা পুরষ্কার পাওয়া সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবিড় উদ্যোগে পরিচালিত দেশব্যাপী উন্মুক্ত বাছাই কার্যাক্রমে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অতিরিক্ত কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয়নি। বাড়তি কোনো খরচ ছাড়াই সেবাকে জনগণের দুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার এটি এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ১নং ডাংধরা ইউনিয়নে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ভাতাভোগী বাছাই। ছবি: স্বর্ণা সাহা
জনগণের শাসনতন্ত্র কায়েমে স্বাধীনতার মাত্র একবছরেই বঙ্গবন্ধু সংবিধান প্রণয়ন করেন। বাংলার আপামর অসহায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বৈষম্যমুক্ত সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠায় আজীবন সংগ্রাম করা রাষ্ট্রনায়ক বাহাত্তর সালেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদে যুক্ত করেন সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতাহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার।
পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার পাচপীঢ় ইউনিয়নে উন্মুক্তভাবে ভাতাভোগী বাছাই। ছবি: তৌকির আহমেদ
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি যেটি জাতির পিতা সাংবিধানিক অঙ্গীকার হিসেবেলিপিবদ্ধ করেন সেটির বাস্তবায়ন শুরু হয় তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পরে।
দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ দুস্থ ও স্বল্প উপার্জনক্ষম অথবা উপার্জনে অক্ষম বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে, পরিবার ও সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯৭-৯৮ অর্থ বছরে 'বয়স্কভাতা' কর্মসূচি চালু করা হয়। প্রাথমিকভাবে দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫ জন পুরুষ ও ৫ জন মহিলাসহ ১০ জন দরিদ্র বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে প্রতিমাসে ১০০ টাকা হারে ভাতা প্রদানের আওতায় আনা হয়। পরে দেশের সব পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন এই কর্মসূচির আওতায় আসে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৪ লাখ বয়স্ক ব্যক্তিকে জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হয়। চলতি অর্থ বছরে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ২৬৪০ কোটি টাকা। বর্তমান সরকারের উদ্যোগে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। করছে। এ কর্মসূচির আওতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৭ লাখ ভাতাভোগীর জন্য জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে মোট ১০২০ কোটি টাকা বরাদ্দের সংস্থান রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫,১৭,২০ এবং ২৯ অনুচ্ছেদে অন্যান্য নাগরিকদের সাথে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমসুযোগ ও অধিকার প্রদান করা হয়েছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৫ লাখ ৪৫ হাজার প্রতিবন্ধীর প্রতি ব্যক্তিকে মাসিক ৭৫০ টাকা হিসাবে দেওয়া হচ্ছে।
জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে সত্যিকারের এক মানবিক ও কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের আওতায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিরলস পরিশ্রমে গত চার বছরে বয়স্কভাতা বিতরণ সরকারের একটি ইতিবাচক সাফল্য।
মুজিববর্ষের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার এই কর্মসূচি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে।