পাহাড়িয়া গল্পকথন

রবিউন নাহার তমা
Published : 9 Feb 2020, 07:23 PM
Updated : 9 Feb 2020, 07:23 PM

আমি বাসে সাধারণত ঘুমাই না। এমনকি এসি বাসে কম্বল মুড়ি দিয়েও। এবার যাত্রাপথে সারারাত চোখ বন্ধ করে থাকার পর শেষ রাতের দিকে একটু ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। রাতভোর সময়ে যখন ধড়মড়িয়ে উঠে বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম দেখি সারি সারি পাহাড়। বান্দরবান … অবশেষে চলেই এলাম।

অনেকদিন আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল কোথাও ঘুরতে যাবো। কিন্তু হয়ে উঠছিল না । শেষে একদম হুট করেই টিকিট কাটা হয়ে গেল। তারপর রাত ১২টার সেন্টমার্টিন হুন্দাইয়ে (আমার অভিজ্ঞতায় বান্দরবানে যাওয়ার সেরা পরিবহন) চড়ে গন্তব্যে পাড়ি জমালাম ।

সকাল ৬টা ২০ মিনিটে পৌঁছলাম। এবারে হোটেল খোঁজার পালা। ঢাকায় বসেই বুকিং দিতে চেয়েছিলাম । তাতে খরচ অনেকটাই বেশি । পরে ফেইসবুকের ট্রাভেল গ্রুপগুলোতে গিয়ে দেখি যে অনেকেই লিখেছেন খুব বিলাসী ভাবে যদি থাকতে না চান তবে অগ্রিম বুকিং না দিয়ে একটু খুঁজলেই ভালো হোটেল পাওয়া যায়। আমরা পেয়েও গেলাম । শহরের একদম মূল সড়কটির পাশেই হোটেল হিল কুইন। বাসস্ট্যান্ড থেকে ১৫-২০ টাকা রিকশা ভাড়া। চাইলে হেঁটেও যাওয়া যায়।

হোটেলে জিনিসপত্র রেখেই আমরা দ্রুত সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। তারপর ট্যুর প্লান অনুযায়ী বগা লেকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমাদের প্রথম গন্তব্য রুমা বাজার। আমরা একটা সিএনজি নিলাম। আপনার দল ভারী থাকলে চাঁদের গাড়ি নিতে পারেন। এতে খরচ কম পড়বে আর দুপাশের মোহিনী সৌন্দর্যও দেখতে পারবেন মন ভরে দেখতে পারবেন।

রুমা বাজারে যাওয়ার পথে বুঝলাম বান্দরবান কতটা দুর্গম এলাকা। পথের সৌন্দর্য যেমন মুগ্ধ করছিলো তেমনি বেশ ভয়ও লাগছিলো। আমরা তিনটা মেয়ে আর সাথে মাত্র একজন ছেলে, সুতরাং ভয়টা একটু বেশি লাগারই কথা।

যেতে যেতে পাহাড়ি বাসিন্দাদের সাথে দেখা হল। পাহাড়ি বাচ্চারা খুব প্রাণোচ্ছল । ওরা নতুন মানুষ দেখলে হাত নেড়ে স্বাগত জানায়। আমাদেরও জানাচ্ছিল। চলতি পথে বেশ কয়েকটা ছোট বাজার পড়ল। সেখানে দেখলাম কেউ বা কতগুলো বরবটি, কেউ বেগুন, কেউ মূলা বিক্রি করছে। সব বাজারেই দুটা তরকারি দেখা গেল- কলা আর পেঁপে। পাহাড়ি কলা আর পেঁপের স্বাদ অতুলনীয়। বান্দরবান গেলে এই দুটা জিনিস অবশ্যই মিস করা যাবে  না।  কলা চাষ পাহাড়িদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। রুমা বাজারে যাওয়ার পথে দুই পাশে যে পাহাড়গুলো দেখা যায় তার প্রায় সবগুলোতেই রয়েছে কলাগাছের সারি।

সিএনজি থেকে বার বার বাইরে তাকাচ্ছিলাম; একটা হাতির দেখা যদি যদি পাই। হাতির দেখা না পেলেও গহীন বনে পাহাড়িদের ঘরগুলো দেখে মিশ্র অনুভুতির জন্ম নিল। একবার মনে হচ্ছিল ওরা কি অমানবিক কষ্ট করে জীবন নির্বাহ করে। প্রতিদিন কলা, ফল, সবজি, লাকড়ি ঝুড়ি বোঝাই করে মাথায় বা পিঠে চাপিয়ে নিয়ে মাইলের পর মাইল দুর্গম পথ পাড়ি দেয়।  আবার মনে হচ্ছিল, ওরা অনেকেই শহরে যায়নি,  তাতে কী? ওদের প্রয়োজনও পড়েনি। দিব্যি হেসে খেলে জীবন কাটাচ্ছে।

সবকিছু ছাপিয়ে যে অনুভূতিটা জেঁকে বসেছিল তা হল সংসারের মায়া ত্যাগ করা। বিশাল বিশাল পাহাড়ের নিস্তব্ধতা যেন দুহাত বাড়িয়ে ডাকছিল। চুম্বকের মত আকর্ষণ করছিল। মনে হচ্ছিল সব কিছু ছেড়ে দিয়ে এই পাহাড়ের চুড়ায় গিয়ে বাস করি।  অথবা মিশে যাই ওই সহজ-সরল হাসি মাখা মুখের পাহাড়িদের ভিড়ে। পাহাড়ের নিস্তব্ধতার আছে এক সম্মোহনী শক্তি। এটা বলে বোঝাবার মত নয়, শুধু অনুভব করা যায়।

অবশেষে আমরা রুমা বাজারে পৌঁছলাম।এখানে তুলনামূলক ঘন বসতি। বান্দরবান সদরের পর সম্ভবত এই জায়গাটাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ বসবাস করে। রুমা বাজারে দেখলাম নানা জিনিসের পসরা। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বার্মিজ স্টল সব রয়েছে সেখানে। দুপুরে ওখানেই একটা হোটেলে ভাত খেলাম সাঙ্গু নদীর ছোট মাছ দিয়ে। আহা! একেই বুঝি বলে অমৃত।
রুমা আসার পথে সাঙ্গু নদী দেখতে থেমেছিলাম । সাপের মত এঁকেবেঁকে চলা নদীটা যেন আরেক সম্মোহনী সৌন্দর্যের আধার। মুগ্ধ হয়েছিলাম সেই সৌন্দর্য দেখে। এবারে চাঁদের গাড়িতে করে বগা লেক যাওয়ার পালা। এবার আমরা চারজনের একটা ট্রাভেলার গ্রুপ পেলাম। ওরা বেশ মজার। আমাদের সাথে একজন গাইডও ছিল । রুমা বাজারের চেকপয়েন্টে সাইন করে সবাই গাড়িতে চেপে বসলাম। একটু দূর এগোতেই পেলাম ঝুলন্ত সেতু । সেখানে কিছুক্ষণ ফটোসেশন চলল। খেয়াল করলাম মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা এখন এদিক দিয়ে কম যায় না।

বগা লেক যাওয়ার রাস্তাটা যেমন সুন্দর তেমন ভয়ংকরও বটে। খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওঠা আবার নামা; উঠতে গেলে মনে হয় এই বুঝি পিছলে নিচে পড়ে গেলাম। আবার নামতে গেলে মনে হয় এই বুঝি ব্রেক ফেল হয়ে গেলো। তবে সবাই মিলে তারস্বরে চিৎকার করলে অবশ্য অতটা ভয় লাগে না। ঠিক রোলার কোস্টারে চড়ার মত। সবচেয়ে বড় ঢালটা ৮০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলের তো হবেই। এখান দিয়ে ওঠার সময় গাড়ির হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরে ফেলতে হবে। যদি শক্ত হার্টের না হলে চোখ বন্ধ করে ফেলতে হবে।

বগা লেকে যাওয়ার সময় রোদ ঝলমল করছিল। চকচকে সবুজে ভরা প্রকৃতি আর সাদা মেঘ উড়ে বেড়ানো নীল আকাশ মনকে আনন্দে ভরে দিচ্ছিল । আমাদের সময় বেঁধে দেওয়া হল আড়াইটা পর্যন্ত। কারণ ৫টার আগেই চেকপয়েন্টে হাজিরা দিয়ে বের হতে হবে যদি রাতে না থাকি। সুতরাং আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। গাড়ি থেকে নেমে সরাসরি বগা লেকের পাড়ে গেলাম। নীল শাপলা চোখে পড়ল। ওপর থেকে বোঝার উপায় নেই যে, পাহাড়ের গহীনে এই সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। চারপাশের গাছগুলো লেকটাকে যেন গুপ্তধনের মত লুকাতে চাইছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকা যায় ওই শান্ত মৃদু ঢেউ খেলানো পানির দিকে । কেউ কেউ দেখলাম জামা কাপড় নিয়ে গোসলের জন্য তৈরি হয়ে আছে ।

এখান থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা ট্র্যাকিং করলে কেওক্রাডং। আমাদের ওখানে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল না। তবে আমরা ওই পথেই অনেক দূর ট্র্যাকিং করলাম। নিচে পিচ ঢালা রাস্তা আর ওপরে সবুজ গাছের ফাঁকে নীল আকাশ, রাস্তার দু'পাশে নানা রকমের বুনো ফুলের ঝোপঝাড় । বগা লেকের আশেপাশে পাহাড়িদের বেশ কিছু দোকান, হোটেল ইত্যাদি রয়েছে।এখানে চাইলে রাতে থাকা যায়। রাতের বেলা চাঁদের আলোয় না কি লেকের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।

এবারে ফেরার পালা। রুমা বাজার পার হয়ে সদরে যাওয়ার রাস্তাটাকে এখন আর অত ভয়ংকর মনে হল না । বরং কেমন যেন একটা অনুভূতি পেয়ে বসছিল। বার বার মনে হচ্ছিল কী যেন রেখে যাচ্ছি। মন খারাপ করে দেওয়া একটা অনুভূতি। পাহাড়ের আকর্ষণ, পাহাড়ের সম্মোহন  বার বার পিছু ডাকে।

দূর থেকে আলোকছটা চোখে পড়ছে … হ্যা, আমরা পৌঁছে গেছি সদরে।