‘প্যানিক প্রাইস হাইক’ চলছে ভোগ্যপণ্য বাজারে

সাকিব জামাল
Published : 19 Jan 2020, 03:54 PM
Updated : 19 Jan 2020, 03:54 PM

গত কয়েকমাস ধরে আমাদের দেশের ভোগ্যপণ্য বাজারে চলছে প্যানিক প্রাইস হাইক বা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আতঙ্ক। হঠাৎ করে লবণের দাম বাড়তে পারে এমন গুজবে বা চিন্তায় যখন বেশি দামে লোকজন এটি কেনার জন্য হুড়মুড় খেয়ে পড়ে তখন এই বিষয়টি সঙ্গত কারণে সামনে চলে আসে।

প্যানিক বায়িং বা প্যানিক সেলিং সাধারণত পুঁজিবাজারে দেখা যায়; বিশেষ করে অস্থিতিশীল পুঁজিবাজরে। পুঁজিবাজারে যারা বিনিয়োগ করেন তারা যখন কোনো সিকিউরিটিজের বা শেয়ারের দাম হঠাৎ বাড়তে দেখেন তখন এর পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনা না করে, এটির দাম আরো বাড়বে নাকি কমে যাবে তা না ভেবে বা কতোটা সময় ধরে এই ট্রেন্ড চলতে পারে তার বাজার বিশ্লেষণ না করেই বেশি লাভের আশায় ঐ সিকিউরিটিজটি বা শেয়ারটি  কিনতে থাকেন। এটি হলো প্যানিক বায়িং।

ঠিক তেমনই বিনিয়োগকারীরা যখন কোনো সিকিউরিটিজের দাম পড়ে যেতে দেখেন তখন ভবিষ্যতে ঐ সিকিউরিটিজ বা শেয়ারের বাজার কেমন হবে তা বিশ্লেষণে না যেয়ে বরং হুজুগে সিকিউরিটিজ বা শেয়ারগুলো বিক্রি করে দেন। এটি হলো প্যানিক সেলিং।

পুঁজিবাজারে সাধারণত গুজব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক পরিবর্তন, কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক উত্থান বা পতন এবং অনেক সময় বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটিপূর্ণ মনিটরিং এর কারণে প্যানিক বায়িং বা সেলিং ঘটে থাকে।

কিন্তু ভোগ্যপণ্য বাজারে এই ধরনের ঘটনা খুবই কম ঘটে। কারণ পুঁজিবাজারে সবাই বিনিয়োগকারী এবং বাজার নিয়ে নিজের বা প্রতিষ্ঠানের লাভের জন্য বা ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্নভাবে বাজারে ধনাত্মক বা ঋণাত্মক প্রভাব বিস্তার করেন; সহজভাবে বললে বাজার নিয়ে খেলা করেন। কিন্তু ভোগ্যপণ্য বাজারে বেশি থাকেন ভোক্তারা বেশি থাকেন বিনিয়োগকারী বা ব্যবসায়িকেরা কম থাকে। তাছাড়া এটি শুধু ব্যবসাকেন্দ্রিক নয়, এর সেবা কেন্দ্রিকতাও আছে। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগকারী বা পাইকারি ব্যবসায়ী ছাড়া মধ্যসত্বভোগী খুচরা বিক্রেতা থাকেন যারা ভোক্তাদের পরিচিত- তাই এখানে প্যানিক বা আতংক অনেকটা প্রশমিত হয়ে যায়। তৃতীয়ত, এই বাজারের সাথে জনমতের বিষয় জড়িত থাকে এবং সেজন্য সরকারও সতর্ক থাকেন মনিটরিং করতে। এসব কারণেই প্যানিক বায়িং বা সেলিং এখানে কম ক্রিয়াশীল।

তবে ইদানিং আজকাল আমাদের ভোগ্যপণ্য বাজারেও প্যানিক প্রাইস হাইক চলছে। এর আগেও  নীরবে এটি ঘটে ছিল। সম্ভবত চালের কারণে একবার এটি ঘটেছিলো। এবারে এটি স্পষ্ট হয়েছে বেশি। গত কয়েকদিন ধরে পেঁয়াজের দাম অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে চলায় জনগণের মনে এই আতংক সৃষ্টি হয়েছে। ভোক্তাবাজারে একটি পণ্যের দাম বাড়ার সাথে অন্যান্য পণ্যের দামের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তাই জনসাধারণ যখন বেশ কিছুদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত বাজার পর্যবেক্ষণ করে থাকে তখন তার ফলাফল হিসেব তাদের মনে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ভয় জায়গা করে নেয় এবং তারা তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যগুলো বেশি পরিমাণে কিনতে শুরু করে।

এর পেছনের অন্যতম একটি কারণ হলো সাধারণত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাসিক খরচের একটি নির্দিষ্ট বাজেট থাকে;  সেই বাজেটে মাস চলতে যাতে তাদের সমস্যা না হয় তাই তারা দৈনিক বাজার করার পরিবর্তে এককালীন মাসিক বাজার শুরু করে দেন। এটি বাজারে পণ্যের চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। ফলে চাহিদা এবং যোগানের সূত্রানুসারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।

এটি স্পষ্ট যে প্যানিক প্রাইস হাইকের কারণ আর কিছু না; প্যানিক বা আতংক। এর আন্ডারলাইন কারণ 'অনিয়ন্ত্রিত বাজার'। এই অনিয়ন্ত্রিত বাজারে প্যানিক প্রাইস হাইকের নির্মমতার প্রধান শিকার হয়ে থাকেন দিন এনে দিন খাওয়া মানুষেরা, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এই শ্রেণি ভীষণভাবে আর্থিক সমস্যায় পড়তে পারেন। তাদের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। তাই এই প্যানিকটি দূর করা জরুরি।

প্যানিক প্রাইস হাইক দূর করতে মূল কাজটি হলো দক্ষতার সাথে বাজার ব্যবস্থাপনা করা। অর্থাৎ অনিয়ন্ত্রিত বাজারের লাগাম টেনে ধরা। কী কী কারণ এবং কোন কোন ব্যবসায়ী, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের কারণে বাজার অস্থিতিশীল হতে পারে তা চিহ্নিত করা এবং এসব অনাকাঙিক্ষত প্রভাবকসমূহ নিয়ন্ত্রণ করা, প্রশমন করা এবং পূর্ব পদক্ষেপ হিসেবে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা।

একইসঙ্গে ভোক্তা বাজারের সাথে জড়িত বিষয় যেমন- পণ্য বা সেবার কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি যাতে না হয় সেজন্য সজাগ থাকতে হবে। অযৌক্তিকভাবে অতিরিক্ত মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ীদের যথাসময়ে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। নিয়মিতভাবে ভোক্তাবাজারে নোটিশবোর্ড স্থাপন করে সেখানে সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশের মাধ্যমে জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করতে ভোক্তা অধিকার আইনের দ্রুত প্রয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে।

সব মিলিয়ে মানুষের মনে বাজার ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।  কারণ আস্থা রাখতে না পারলে জনগণ প্যানিক বায়িং বা সেলিং চালিয়ে যাবে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন থাকবে।