Published : 28 Oct 2015, 07:16 PM
সনাতনী পুলিশিং দর্শনে অপরাধকে কোন সমস্যা হিসেবে দেখা হয় না। মনে করা হয়, এটা একটা মনুষ্য উপদ্রুব। তাই এখানে সমস্যার সমাধান নয়, অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। মাদক সমস্যাকে গোড়া থেকে না দেখে দেখা হয় এর আগা থেকে। উপর থেকে গাছের ডাল-পালা ছেঁটে গাছকে আকারে ছোট করা হয়। কিন্তু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কয়েক দিন পর আবার গাছ তার ডাল-পালা বিস্তার করে। এখানে পুরাতন গাছের যেমন মূলোৎপাটন করা হয় না, তেমনি নতুন গাছের অংকরোদ্গম বা বিস্তার রোধেরও কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। মাদক দ্রবের অবৈধ ব্যবহার রোধের ক্ষেত্রে আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সমূদয় পদক্ষেপ ঠিক কম বেশি এ রকমই।
মাদক দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, অপব্যবহার রোধ, চোরাচালান ঠেকানো ইত্যাদির সাথে জড়িত বিভাগগুলো সাংগঠনিক অদূরদর্শিতায় জর্জরিত। সনাতনী পুলিশিং দর্শনে এরা এতটাই নিমজ্জিত যে এদের অকার্যকর সনাতনী বৃত্তের বাইরে বের হবার কোন ইচ্ছাও নেই, পদক্ষেপও নেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এক অবান্ধা নদী সেঁচ দেয়ার প্রচেষ্টায় আমরা আমাদের জাতীয় সম্পদের অপচয় করছি দেদারছে।
আমরা নতুন নতুন বিভাগ খুলছি, বিদ্যমান বিভাগগুলোর লোকবল, অর্থবল, গাড়িবল, বাডিবল সবই বাড়াচ্ছি। কিন্তু এসব কিছুর বিনিময়ে আমরা এসব বিভাগের কাছ থেকে যা প্রত্যাশা করছি আর বাস্তবে যা পাচ্ছি তার তফাৎ আমাদের আঁৎকে ওঠার মতো প্রতিকূলে। কিন্তু হাস্যকর কিছু মুনাফার লোভে আমরা এই অদক্ষ বিভাগগুলোতে বারংবার বিনিয়োগ করেই যাচ্ছি।
হাস্যকর কিভাবে? মাদক দ্রবের অপব্যবহার রোধে যারা কাজ করছে তাদের কার্যক্রমের মূল্যায়ন কি ভাবে করি আমরা? দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ও বাৎসরিক ভিত্তিতে তারা কতটি মামলা রুজু করল, কতজন ব্যক্তি বা কথিত মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করল, কত পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার হল — এই বৃত্তের মধ্যেই তাদের মূল্যায়ন চলে।
মামলা সংখ্যা যত বেশি হবে, যত বেশি পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার হবে, যত বেশি অপরাধীকে গ্রেফতার করা হবে, আমাদের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কর্যাক্রম তত বেশি সন্তুষজনক বলে মনে করা হবে। অধিক উদ্ধার, অধিক গ্রেফতার ও অধিক মামলার জন্য প্রতি বছর অফিসারদের পুরস্কৃত করা হয়। আর কম গ্রেফতার, কম উদ্ধার ও কম মামলার জন্য অফিসারদের তিরস্কৃত করা হয়। এর ফলে সংশ্লিষ্টরা অধিক উদ্ধার, অধিক গ্রেফতার বা অধিক মামলাদানের জন্য প্রকারান্তরে অবৈধ মাদকের সার্কুলেশনকে উৎসাহিত করেন। দক্ষতা মূল্যায়নের মাপকাঠিই যখন মাদক দ্রব্যের সার্কুলেশনকে উৎসাহিত করে, তখন মাদক দ্রব্যের ব্যবহার কমবে কি করে ?
ধরা যাক, কোন এক থানার অফিসারইনচার্জ মাদক দ্রব্যের অপব্যবহার নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন। তিনি তার এলাকায় বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে মাদক উদ্ধার ও অপরাধী গ্রেফতারের জন্য সর্বদাই তৎপর। তার অভিযানের প্রথম মাসে ধরা পড়ল ১০০ বোতল ফেন্সিডিল, পরের মাসে ২০০ বোতল ফেন্সিডিল, তার পরের মাসে ৫০০ বোতল। এভাবে তিনি প্রতি মাসেই উদ্ধারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছেন এবং প্রতি মাসেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রসংশিত ও পুরস্কৃত হচ্ছেন।
এভাবে উক্ত অফিসার-ইন-চার্জের অধীক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই ফেন্সিডিলের উদ্ধার বাড়তে থাকল। তিনি ০২ বছর পর উক্ত থানা থেকে বিদায় নেয়ার প্রাক্কালে ১০,০০০ হাজার বোতল ফেন্সিডিলের একটি চালান আটক করলেন। এক্ষেত্রে তিনি বিদায়ের প্রক্কালে আরও বেশি পুরস্কৃত হলেন। তার ক্যারিয়ারের মুকুটে যুক্ত হবে আরও একটি সাফল্যের পালক। তিনি পুলিশ বিভাগের একজন সফল অফিসার হিসেবে হয়তো একদিন সর্বোচ্চ পদকে ভূষিত হবেন।
এর বিপরীত দিকে, আমরা অন্য একজন অফিসার ইনচার্জের কথা উল্লেখ করব। এই পুলিশ কর্মকর্তা সমস্যার সমাধানে বিশ্বাসী। তিনি মনে করেন, যদি মাদক সমস্যাটির সমাধান করা যায়, তাহলে কোন এক সময় তার অধীক্ষেত্রে কোন প্রকার মাদক বিক্রয় হবে না, মাদক ব্যবসায়ী থাকবে না, থাকবে না কোন মাদকের আড্ডা। এমন কি থাকবে না কোন মাদকসেবী মাতালও।
এই পুলিশ অফিসার তিনিটি উপাদান নিয়ে কাজ শুরু করলেন। তিনি অপরাধী, অপরাধীর শিকার ব্যক্তিগণ ও যেসব স্থানে মাদক বিক্রয় হয়, সেইসব স্থানের উন্নয়নের জন্য কাজ করলেন। তিনি এক দিকে সনাতনী কায়দায় অভিযান চালাতে থাকেন। কিন্তু প্রথম দিকে তেমন সাফল্য পান না। কিন্তু তিনি মানুষকে নিয়ে কাজ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ক্রমেই মানুষ পুলিশকে সহযোগিতা করা শুরু করে। সেই অফিসার ইনচার্জ তার কার্যকালের প্রথম মাসে ১০০ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার করেন। ২য় মাসে ৪০০ বোতল এভাবে তার মাদক উদ্ধারের পরিমাণ বেড়ে কোন এক মাসে হয়তো ২০০০ হাজার বোতলে উর্ত্তীণ হল। কিন্তু এর পর মাদক উদ্ধার দ্রুত কমতে থাকল। ধীরে ধীরে অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, তার অধীক্ষেত্রে কালে-ভদ্রে মাদক বেচাকেনা হয়।
কিন্তু কি করে ছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা ? তিনি প্রথমেই অপরাধীদের উপর কঠোর হন। উদ্ধার গ্রেফতার বিচারের মাধ্যমে মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যবসাকে তিনি অলাভজনক করে তোলেন। গ্রেফতারের ভয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা পালিয়ে বেড়াতে লাগল । অধিকাংশই ধরা পড়ল। কেউ কেউ স্থায়ীভাবে এলাকা ছাড়া হল। অনেককে মাদক ব্যবসায়ী অন্যকোন সম্মানজনক পেশায় ফিরে গেলো। সাধারণ মানুষ ও সরকারি সহায়তায় অনেককে পুর্নবাসন করা হলো। যারা মাদকসেবী তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেয়া হল। মাদকের ঝুঁকিতে থাকা যুবকদের নিয়ে, তাদের পরিবার অবিভাবকদের নিয়ে মিটিং-মিছিল, সেমিনার করা হল। স্কুল-কলেজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলল প্রচারণা। মানুষ মাদক দ্রব্যের কুফল সম্পর্কে শুধু সচেতনই হল না, তারা নিজেরাই মাদক ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধ করতে লাগল। এভাবে এক সময় মাদকের সমস্যাটি এমনভাবে অপসারিত হল যে, এই থানা অধীক্ষেত্রে আর মাদক উদ্ধার হচ্ছে না, হচ্ছে না মাদকের মামলা।
কিন্তু এই কাজ করার ফলে আমাদের আলোচিত অফিসার ইনচার্জ তার বিভাগীয় ব্যবস্থায় পড়লেন। তিনি মাদক উদ্ধার ও মাদকের মামলা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রথম দিক থেকেই ছিলেন অত্যন্ত অসফল। তার কর্মকালের শেষ দিকে তিনি সাফল্যেও মাপকাঠিতে এতটাই নিচে নেমে গিয়েছিলেন যে, তার থানায় পর পর ছয় মাস কোন মাদকদ্রব্য উদ্ধার হয় নি; হয়নি এ সম্পর্কিত কোন মামলাও। অথচ উপরের নির্দেশ ছিল প্রত্যেক থানা মাদক উদ্ধার করে প্রতি মাসে কমপক্ষে তিনটি করে মামলা দিবে। এর মাঝে দুইটি বিশেষ অভিযান সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এইসব অভিযানে আমাদের আলোচিত অফিসার ইনচার্জ কোন সাফল্য দেখাতে পারেননি। সবকিছু মিলে এই অফিসার একজন অসফল অফিসার ইনচার্জ হিসেবে থানা থেকে বিদায় নিলেন।
এবার ভাবুন, আমাদের দক্ষতা মূল্যায়নের মাপকাঠিগুলোর কথা ? যে অফিসার যত বেশি মাদক উদ্ধার করবে, তিনি যত বেশি মামলা দিবেন, তিনি তত বেশি সাফল্য তৈরি করতে পারবেন। তিনি ততো সফল অফিসার। অথচ যার অধীক্ষেত্র থেকে মাদক দূর হবে, তিনি উদ্ধার, গ্রেফতার ও মামলাদানের নির্দিষ্ট কোটা পুরণে ব্যর্থ হয়ে লঞ্ছিত হবেন।
সৃষ্টির শুরু থেকেই এ উপমহাদেশের আমলাতন্ত্র ঘটনা-তাড়িত। পুলিশ একটি উত্তম শ্রেণির আমলা তদন্ত্র । শাসন ব্যবস্থায় আদিকাল থেকেই আমলাতন্ত্র পরিবর্তনে অনাগ্রহী। আমাদের পুলিশ প্রশাসন যে দর্শন বিশ্বাসী তা সমস্যাকে জিইয়ে রাখার কৌশল প্রয়োগে অধিক আগ্রহী। তাই আধুনিক পুলিশিং এর তুলনায় শুধু নয়, আমাদের পুলিশিং দর্শন স্বভাবগতভাবেই সম্পূর্ণ ভুল না হলেও বহুলাংশে ত্রুটিটিপূর্ণ। এখানে সমস্যার সমাধান নয়, সমস্যার উপস্থিতি কাম্য। স্বীকার করুন বা নাই করুন, অন্তত মাদক দ্রব্যের অপব্যবহার রোধের ক্ষেত্রে, আমাদের প্রচলিত পুলিশিং দর্শন চূড়ান্ত বিচারে শতভাগ ভুল। তাই এ দর্শন যত দ্রুতই পরিত্যাগ করে একটি শুদ্ধ দর্শনে পুলিশকে পরিচালিত করা যায় ততোই মঙ্গল।
কিন্তু কি সেই নতুন ও শুদ্ধ দর্শন? নিঃসন্দেহে সেটা কমিউনিটি পুলিশিং। কারণ, কমিউনিটি পুলিশিং এর মূল কথা হল, অপরাধ সমস্যার সমাধান করা ও তা করতে গিয়ে অপারের কারণ খুঁজে বের করে তা দূর করা। (২৭ অক্টোবর, ২০১৫)