এই গরমে আইনজীবীদের কোট-গাউনে হাঁসফাঁস আর কতদিন?

হিট স্ট্রোকে এক আইনজীবীর মৃত্যুর পর গ্রীষ্মে আদালতের ‘ড্রেস কোড’ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বৈঠক ডেকেছেন প্রধান বিচারপতি।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 May 2023, 04:10 PM
Updated : 11 May 2023, 04:10 PM

গরমের মধ্যেও কোট-গাউন পরার বাধ্যবাধকতা নিয়ে আইনজীবীদের অসন্তোষ আগে থেকেই ছিল; ‘হিট স্ট্রোকে’ আদালত চত্বরে একজনের মৃত্যুর পর তা আরও জোরাল হচ্ছে।

আইনজীবীরা বলছেন, গ্রীষ্মে জনাকীর্ণ আদালতে তীব্র গরমে তাদের এই কালো পোশাক পরে কাজ করা অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

তার মধ্যে বৃহস্পতিবার ঢাকার আদালত চত্বরে একটি জামিন আবেদনের শুনানি শেষে ‘হিট স্ট্রোকে’ সৈয়দ শফিউল ইসলাম আলাউদ্দিন নামে তরুণ এক আইনজীবী মারা যান।

২০২১ সালে তালিকাভুক্ত এই আইনজীবীর মৃত্যুর পর পোশাকের বাধ্যবাধকতার বিষয়টি ক্ষোভে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর একটি সিদ্ধান্তে আইনজীবীরা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।

আদালতে আইনজীবী ও বিচারকদের ‘ড্রেস কোড’ পরিবর্তনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের আলোচনায় ডেকেছেন প্রধান বিচারপতি।

আগামী শনিবার বেলা ১১টায় এই বৈঠক হবে বলে বৃহস্পতিবার বিকালে আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার সাইফুর রহমান জানিয়েছেন।

গ্রীষ্মের শুরুতেই এবার তাপপাত্রা ৪০ এর আশেপাশে ঘোরাঘুরির সময় মানুষ যেখানে একটু সহনীয় পরিবেশে থাকার চেষ্টা করছে, তখন আইনজীবীদের জন্য আদালত হয়ে গেছে কঠিন এক জায়গা।

সেখানে কালো রঙের মোটা একটি কোট পরতে হয় আইনজীবীদের, তার উপর চাপাতে হয় লম্বা কালো গাউন।

বেশিরভাগ আদালতেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। সেখানে ব্যাপক ভিড়ের মধ্যে ভারী পোশাকে গরম হয়ে ওঠে আরও অসহনীয়।

বছরের পর বছর ধরে এই পোশাকের বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া নিয়ে নানাভাবেই প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন আইনজীবীরা। ‘ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতীক’ এই পোশাক স্বাধীন দেশে চলতে পারে না, এমন যুক্তিও দেখাচ্ছেন কেউ কেউ।

ভারতের হাই কোর্ট তীব্র গরমে আইনজীবীদের কালো পোশাক পরার বাধ্যবাধকতা থেকে ছাড় দিয়েছে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে এক আদেশে আগামী জুন পর্যন্ত এই ছাড় দেওয়ার কথা জানানো হয়।

গরমের মৌসুমে ‘ড্রেস কোড’ পরিবর্তনের জন্য ঢাকা আইনজীবী সমিতি এবং দেশের বিভিন্ন জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতিকে চিঠিও দেওয়া হয়। দুই বছর আগেও এ বিষয়টি নিয়ে কথা উঠেছিল। তবে কোনো নির্দেশনা এখনও আসেনি।

গ্রীষ্মে কালো কোট-গাউনের বিপক্ষে সবাই

আইনজীবীদের মধ্যে নানা দল, নানা মত থাকলেও গ্রীষ্মের মধ্যে কালো কোট-গাউন না পরার পক্ষে সবাই।

আইনজীবী দুলাল মিত্র বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হিট স্ট্রোকে এর আগে একজন রিকশাচালক মারা গেছেন। এর মধ্যে আমাদের পরতে হয় কালো কোট, কালো গাউন! কালো রং উত্তাপ শোষণ করে বেশি। এ যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া।”

উচ্চ আদালতের আইনজীবী পারভেজ হাসেম বলেন, “গরমের দিনে আমি পোশাক শিথিলের

পক্ষে। এ সময় শুধু সাদা শার্ট, আর ব্যান্ড পড়লেই যেন উচ্চ আদালতে শুনানি করা যায়।”

ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী সোহেল আমিন বলেন, “একশ ভাগ আইনজীবীই গরমের দিনে কোট-গাউনের বিরুদ্ধে মত দেবেন।”

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, “মামনীয় প্রধান বিচারপতির কাছে বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, ড্রেস কোড পরির্বতনের বিষয়টি যেন চিন্তা করা হয়।”

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোমতাজ উদ্দিন মেহেদী বলেন, “গ্রীষ্মে কোট, গাউনের বিরোধী আমি। এ বিষয়ে পরিবর্তনে আমি যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”

ঢাকা বারের আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো এই ‘ড্রেস কোড’কে দেখেন ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতীক হিসেবে।

তিনি বলেন, “এই ড্রেস ব্রিটিশ শাসনের নিষ্ঠুর অমানবিকতার স্বাক্ষর বহন করে। স্বাধীন দেশে দাসত্বমুক্ত ড্রেস কোড চাই। আমাদের দেশের আবহাওয়া ইংল্যান্ডের মতো শীতল নয়। এখানে সাদা শার্ট, কালো টাই অথবা ব্যান্ডই যথেষ্ট। কালো কোট, গাউনের দরকার নেই।”

আইনজীবী খন্দকার হাফিজুর রহমান নেহাল অবশ্য ‘ড্রেস কোড’ স্থায়ীভাবে পাল্টানো নিয়ে সন্দিহান। তিনি বলেন, “হয়ত কিছু দিনের জন্য ড্রেস কোড পরিবর্তন হবে। কিন্তু এটা স্থায়ী হবে কি না, সন্দেহ রয়েছে।”

পোশাক পরিবর্তনে আইনজীবীদের নানা চেষ্টা

গরমের দিন এই কালো পোশাক পাল্টানো নিয়ে আইনজীবীদের এই দাবি নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরেই তারা গ্রীষ্মে কালো কোট ও গাউন পরার বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে কথা বলে আসছেন।

পোশাক পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন জেলা আদালত ছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনেও হাতে হাত ধরে মানববন্ধন করেছেন তারা।

সম্প্রতি আইনজীবী ও বিচারকদের জন্য গ্রীষ্ম ও শীতকালীন আলাদা পোশাক নির্ধারণের জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ হুমায়ন কবির, মো. কাউছার ও বায়েজীদ হোসাইন।

এতে বলা হয়, “আইনজীবীরা প্রতি বছরের মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত উচ্চমাত্রার গরমের কারণে নিদারুণ, অসহনীয়, অবর্ণনীয়, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট সহ্য করে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে লাখো লাখো বিচারপ্রার্থীকে আইনি সেবা দিয়ে আসছেন। একই সঙ্গে নিম্ন ও উচ্চ আদালতের বিচারকরা একই ধরনের পোশাক পরিধান করায় অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছেন।“

অতিরিক্ত গরমে কালো কোট, গাউন, কলার, ব্যান্ড/টাই পরার কারণে প্রতি বছর বহু আইনজীবী ‘হিট স্ট্রোকে’ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন এবং অনেক আইনজীবী অসুস্থ হয়ে পড়েন বলেও উল্লেখ করা হয় আবেদনে।

করোনা ভাইরাস মহামারীর সময়ে ‘ড্রেস কোড’ পরিবর্তনে বিচারকাজ বা আইনজীবীদের কোনো অসুবিধা হয়নি বলেও তিন আইনজীবী তাদের আবেদনে উল্লেখ করেন।

কীভাবে এই পোশাক এল?

বাংলাদেশের আদালতের কার্যক্রম সংক্রান্ত অন্তত তিনটি বিধান বা আচরণবিধিতে এই ‘ড্রেস কোড’র কথা বলা আছে। ফলে এটি নিছক প্রথা নয়।

১৬৮৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের মৃত্যুতে শোক প্রকাশের জন্য আদালতে আইনজীবী ও বিচারকেরা কালো কোট ও গাউন পরা শুরু করেন। এরপর থেকে শোকের এই পোশাক হয়ে যায় আইনজীবী ও বিচারকদের স্থায়ী পরিধেয়।

ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতেও চালু হয় এই প্রথা। ব্রিটিশ শাসন অবসান হলেও কমনওয়েলথভুক্ত প্রায় সব দেশেই এই রীতি রয়ে গেছে।

তবে কানাডার দেশে আইনজীবীরা লাল ও সাদা ইউনিফর্ম পরেন। ইউরোপের দেশগুলোতে ঐতিহ্যগতভাবেই কালো বা নেভি ব্লু কোট এবং সাদা শার্ট পরা হয়।

ভারতীয় উপমহাদেশের সব দেশেই এই ড্রেস কোড মানার বাধ্যবাধকতা আছে। বিভিন্ন আইন ও রীতিনীতি যুগের প্রয়োজনে নানাভাবে সংশোধন হলেও আইনজীবী ও বিচারকদের পোশাকের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।

বাংলাদেশের বিধি-বিধানে একজন আইনজীবীকে কালো কোট ও সাদা রঙের গলাবন্ধনী পরার কথা বলা হয়েছে।

এ আইনগুলো হচ্ছে: দ্য সুপ্রিম কোর্ট অফ বাংলাদেশ (অ্যাপিলেট ডিভিশন) রুলস, দ্য সুপ্রিম কোর্ট অফ বাংলাদেশ (হাই কোর্ট ডিভিশন), সিভিল রুলস অ্যান্ড অর্ডারস এবং দ্য ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডারস (প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রসিডিউর অফ সাবঅর্ডিনেট কোর্টস)।