“উন্নয়নের পেছনেও যে কান্না থাকে, আমাদের উন্নয়নের পেছনের কান্না এসব বঞ্চিত শিশু,” আক্ষেপ পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমের।
Published : 10 Apr 2023, 09:43 PM
ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পথশিশুদের ৬৪ শতাংশই পরিবারে ফিরতে চায় না; কারণ হিসেবে পারিবারিক অশান্তি এবং পরিবার গ্রহণ না করা ও জায়গা না থাকার বিষয়গুলো উঠে এসেছে এক জরিপে।
দেশের এসব শিশুদের প্রায় ৩৮ শতাংশই দরিদ্র্যতার কারণে পথশিশু হওয়ার তথ্যও দিচ্ছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত এ জরিপ।
এতে অংশ নেওয়া শিশুদের ৭৯ শতাংশের বেশি স্বাধীনতা না থাকার কারণে পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকতে চান না বলে জানিয়েছেন।
অপরদিকে একটি অংশের পরিবার না থাকাও তাদের পথে পথে থাকার কারণ বলে তারা জানিয়েছে।
সোমবার ঢাকার আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবন মিলনায়তনে ‘পথশিশু জরিপ ২০২২’ এর এসব ফলাফল তুলে ধরা হয়।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল- ইউনিসেফ এর সহযোগিতায় ঢাকার দুটিসহ নয় সিটি করপোরেশনে এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। ২০২২ সালের ৪ থেকে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিটি নগরীতে ৭২০ জন পথশিশুর কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম, বাংলাদেশে ইউনিসেফ এর প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট উপস্থিত ছিলেন।
বিবিএস এর ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেল্থ উইংয়ের পরিচালক মাসুদ আলম জানান, যথাযথ জরিপ পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রথম পর্যায়ে ০ থেকে ১৭ বছর বয়সী পথশিশুদের উপর কুইক কাউন্ট পরিচালনার মাধ্যমে স্যাম্পলিং ফ্রেম প্রণয়ন করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী পথশিশুদের উপর জরিপ পরিচালিত হয়।
এর ফলাফল তুলে ধরে তিনি জানান, দেশের মোট পথশিশুর ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ দরিদ্রতার কারণে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পথেই আশ্রয় নিয়েছে। ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ বাবা-মা শহরে আসার কারণে এবং ১২ দশমিক ১ শতাংশ কাজের সন্ধানে বাড়ি ছেড়ে শহরে এসে পথেই ঠাঁই পেয়েছে।
তিনি জানান, জরিপে এসব পথশিশু আবার বাড়িতে ফিরতে চান কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে ৬৪ শতাংশ বলেছেন, তারা আবার বাড়ি ফিরে যেতে চান না। কেন বাড়ি ফিরতে চান না এমন প্রশ্নের উত্তরে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ পথশিশু বলেছে, পরিবারে শান্তি না থাকায় তারা বাড়ি ফিরতে চান না।
অপরদিকে ২১ দশমিক ৩ শতাংশ বলেছে পিতা-মাতা গ্রহণ করবে না; ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ বলেছেন তাদের কোনও পরিবার নেই; ১২ দশমিক ৭ শতাংশ বলেছে পরিবারের অসহযোগিতা এবং ১১ দশমিক ৯ শতাংশ বলেছে তারা পরিবারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারছে না।
এছাড়া ১১ দশমিক ৪ শতাংশ শাস্তির ভয় এবং ১১ শতাংশ পথশিশু বাড়িতে অতিরিক্ত কাজ করতে হয় বলে আর পরিবারের কাছে ফিরতে চান না।
তবে দেশে এখন মোট কত পথশিশু সেই সংখ্যা ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে জানানো হয়নি।
এ বিষয়ে বিবিএস মহাপরিচালক মো. মতিয়ার রহমান বলেন, “এটা শুমারি ছিল না। তাই তাদের গণনায় আনা সম্ভব হয়নি।
পরে অনুষ্ঠানের শেষে জরিপ পরিচালনায় সহায়তাকারী ইউনিসেফ এর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সবমিলে ১০ লাখের বেশি পথশিশু রয়েছে।
জরিপের অন্যান্য তথ্য তুলে ধরে বিবিএস পরিচালক মাসুদ আলম বলেন, প্রতি পাঁচ পথশিশুর দুইজনই একা একা শহরে এসেছে। ১০ জন পথশিশুর তিনজন কখনই স্কুলে ভর্তি হয়নি। শুধু ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ পঞ্চম শ্রেণি পাস করেছে আর খুবই কম সংখ্যক নিম্ন ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশুনা করেছে।
জরিপে প্রায় চার ভাগের একভাগ পথশিশু ধূমপান করে এবং ১২ শতাংশ মাদকের নেশায় আসক্ত বলে ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়।
তথ্যে দেখা যায়, পথশিশুদের সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৪ শতাংশ চট্টগ্রাম বিভাগ এবং সর্বনিম্ন ৪ দশমিক ৯ শতাংশ সিলেট বিভাগ থেকে এসেছে।
বতর্মানের পথশিশুদের মধ্যে ৮২ শতাংশ ছেলে এবং ১৮ শতাংশ মেয়ে শিশু রয়েছে। ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী পথশিশু রয়েছে ৫৪ শতাংশ।
দেশের মোট পথ শিশুর মধ্যে একজন মেয়ের বিপরীতে চারজন ছেলে শিশু। এদের গড় বয়স ১২ দশমিক ৩ বছর।
জরিপের ফলাফলে বলা হয়, ঢাকা বিভাগে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ পথশিশু রয়েছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান জরিপের ফলাফলে পথ শিশুদের মোট সংখ্যা জানতে না পারার সমালোচনা করে আগামীতে তা তুলে আনার নির্দেশনা দেন।
দেশের সব নাগরিক সমান সুবিধা ভোগ করবে এমন আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমাদের উন্নয়নে এসব শিশুদের অভিগম্যতা পাওনা কিন্তু তারা পাচ্ছে না, এটা আমরা স্বীকার করছি।”
পথশিশুদের ন্যায় বিচার না পাওয়ার উদাহরণ টেনে মান্নান বলেন, “এই জরিপে যেসব পথশিশুর কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে তাদেরকে সম্মানী দেওয়া হয়নি।
“অথচ সম্মানী ব্যক্তিদের কাছ থেকে এরকম সময় নিলে অবশ্যই তাদেরকে সম্মানী দেওয়া হত।”
এসব পথশিশুর উন্নয়নের মূলস্রোতে আনতে প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, উন্নয়নের পেছনেও যে কান্না থাকে- আমাদের উন্নয়নের পেছনের কান্না এসব বঞ্চিত শিশু।
“দেশে কাউকে পেছনে না রাখার দর্শন নিয়ে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন হচ্ছে, অথচ সেই উন্নয়ন পরিকল্পনায় এসব পথশিশু নেই।”
আগামী বছর থেকে নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন শুরু হবে জানিয়ে তিনি সেই পরিকল্পনায় এসব পথশিশুর উন্নয়ন অন্তর্ভূক্তির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ইউনিসেফ এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব পথশিশুকে প্রশিক্ষণ দিলে তারা জনশক্তিতে রূপান্তরিত হবে। তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে সরকারকে পরামর্শ দেন তিনি। এমন পদক্ষেপ নেওয়া হলে ইউনিসেফ সার্বিকভাবে সহযোগিতা দেবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।