এক নারীকে তুলে নিয়ে গ্রেপ্তার দেখাল পুলিশ, কাণ্ড ৩ এলাকা মিলিয়ে

এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট মিরপুর থানার তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকচট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Oct 2022, 06:16 PM
Updated : 6 Oct 2022, 06:16 PM

এক নারীকে নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়েন্দা পুলিশের পরিচয়ে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করে চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলন করলেন তার জামাতা; এদিকে ঢাকার কদমতলী থানায় মাদকের এক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হল সেই নারীকে।

অন্যদিকে এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে এই গ্রেপ্তার অভিযান চালানোর অভিযোগ ওঠার পর ঢাকার মিরপুর থানার তিন পুলিশ সদস্য হয়েছেন বরখাস্ত।

চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলন করে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া নামের ওই ব্যক্তি দাবি করেছিলেন, তার শাশুড়িকে তুলে মিরপুরে নেওয়া হয়েছিল এবং ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে তার কাছে ১০ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছিল, পরে ৩ লাখ টাকায় রফা হয়।

জাহাঙ্গীর নিজেকে ঢাকার সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। তার নিজের ‘রেন্ট-এ-কারের’ ব্যবসা আছে। পাশাপাশি তিনি সিদ্ধিরগঞ্জে মোটর সাইকেলের বিক্রয় কেন্দ্র খোলার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

জাহাঙ্গীরের বাসা নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে, তবে এক কাজে চট্টগ্রামে অবস্থান করার মধ্যে বৃহস্পতিবার বিকালে তিনি চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন।

এই ঘটনার শুরু এক দিন আগে হলেও ‘নিরাপত্তার শঙ্কা’ থেকে জাহাঙ্গীর চট্টগ্রামে থেকে গিয়ে এক দিন বাদে সংবাদ সম্মেলনে আসার কথা জানিয়েছেন।

জাহাঙ্গীর বলেন, বুধবার সকাল ১০টার দিকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের বাসা থেকে তার পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে দোকানের উদ্দেশে বেরিয়েছিলেন তার শাশুড়ি শাহিনা আক্তার। তখন তাদের তুলে নেওয়া হয়।

“সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মৌচাক বাস স্ট্যান্ড থেকে একটি সাদা গাড়িতে করে কিছু লোক তাদের উঠিয়ে নিয়ে যায়। যেটি স্থানীয় এক রিকশাচালক দেখে আমার বাবাকে জানায়।”

খবর পেয়ে জাহাঙ্গীর চট্টগ্রাম থেকে টেলিফোন করেন নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম এবং সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হাফিজুর রহমানকে।

জাহাঙ্গীরের দাবি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তরিকুল তার কাছ থেকে তার শাশুড়ির মোবাইল নম্বর নিয়ে বলেছিলেন যে ওই নম্বরধারী এখন মিরপুর এলাকায় রয়েছেন।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত এসপি তরিকুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জাহাঙ্গীর নামে একজন তাকে ফোন করে বলেছিলেন যে ডিবি পরিচয়ে তার শাশুড়ি ও সন্তানকে তুলে নিয়ে গেছে।

“আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি যে তার কোনো টিম কাউকে তুলে নেয়নি। পরে জাহাঙ্গীর জানিয়েছেন, তিনি তাদের খোঁজ পেয়েছেন।”

জাহাঙ্গীর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তার শাশুড়ির নম্বর থেকে তার স্ত্রীকে ফোন করে ডিবি পরিচয় দিয়ে ১০ লাখ টাকা নিয়ে ঢাকার মিরপুর ১ নম্বরে যেতে বলা হয়।

এ খবর পাওয়ার পর ঢাকা মহানগর পুলিশে যোগাযোগ শুরু করেন জাহাঙ্গীর।

নানা জন হয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মিরপুর জোনের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (এডিসি) সাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় জাহাঙ্গীরের।

তিনি দাবি করেন, এডিসি সাইফুলও মিরপুরে-১ এ তার শাশুড়ি ও মেয়ের অবস্থান নিশ্চিত করেছিলেন।

জাহাঙ্গীরের ভাষ্য অনুযায়ী, এডিসি সাইফুলের শেখানো বুদ্ধিতে তার স্ত্রী ৩ লাখ টাকা নিয়ে মিরপুর বেড়িবাঁধের একটি স্থানে যান। সেখানে টাকা নিতে আসা ব্যক্তিদের পুলিশ ধরে ফেলে।

যারা ধরা পড়েছেন, তারা সবাই গোয়েন্দা পুলিশের ব্যক্তি ছিল দাবি করে জাহাঙ্গীর বলেন, “আমাকে এডিসি সাইফ স্যার বলেন, দুশ্চিন্তা কেটে গেছে, আপনার সন্তানকে আমরা অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এটার সাথে আমাদের লোক জড়িত। বিষয়টি আপনি বলাবলি করিয়েন না।

“এরপর তিনি আমাকে রাত ১০টায় ফোন করে বলেন, ‘তাদের (আটককৃতদের) জন্য আমরা একটা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করতেছি এবং বিষয়টি সিনিয়র স্যারদের জানিয়েছি এবং কাল সকালে বাচ্চাকে (জাহাঙ্গীরের মেয়ে) দেওয়া হবে’।”

পরে সকালে ডিবির মাধ্যমে মেয়েকে ফেরত পান জানিয়ে জাহাঙ্গীর বলেন, কিন্তু আসল ঘটনাটি চাপা দিতে তার শাশুড়ির বিরুদ্ধে মাদকের মামলা দেওয়া হয়।

জাহাঙ্গীরের অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে এডিসি সাইফুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যতটুকু জেনেছি জাহাঙ্গীরের শাশুড়ি মাদকসহ গ্রেপ্তার হয়েছে। জাহাঙ্গীরও মাদক ব্যবসায়ী, তার বিরুদ্ধে চারটি মাদক মামলা রয়েছে।”

তবে এই অভিযোগে গোয়েন্দা পুলিশের কেউ জড়িত ছিল না দাবি করে তিনি বলেন, “পুরো অভিযানটি মিরপুর বিভাগ করেছে। পুরো বিষয়টি মিরপুর থানা অবহিত।”

নিয়ম না মেনে নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় অভিযান পরিচালনার কারণে থানার তিন সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলেও জানান সাইফুল।

এই তিন পুলিশ সদস্য হচ্ছেন- এসআই খালিদ ইসলাম, এএসআই  মোবারক হোসেন ও কনস্টেবল আব্দুল মোমেন।

এদিকে মিরপুর থানার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এসআই খালিদের নেতৃত্বে একটি দল কদমতলী এলাকার পলাশপুর রোডের একটি বাড়িতে বুধবার সকালে অভিযান চালিয়ে শাহিনা আক্তার এবং আফরোজা আক্তার পপি (৩৫) নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে ২ হাজার ৯০০টি ইয়াবা ট্যাবলেট পাওয়া যায়। এই ঘটনায় এসআই খালিদ কদমতলী থানায় একটি মামলা করেন।

তবে নিয়ম ভেঙে কদমতলী থানায় গিয়ে অভিযান চালানোয় তিনজনকে বরখাস্ত এবং এই ঘটনার তদন্তে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (মিরপুর) মাহবুবুর রহমানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে এক কর্মকর্তা জানান। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রশ্ন করলে তা এড়িয়ে গিয়ে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মাহবুবুর রহমান বলেন, “বিধি মোতাবেক যে ব্যবস্থা, তা নেওয়া হয়েছে।”