ঢাকায় আন্তর্জাতিক বইমেলা ও সাহিত্য সম্মেলন হবে?

বাংলা ভাষা আর সাহিত্যকে বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে লেখক-প্রকাশক ও গুণীজনরা আন্তর্জাতিক বইমেলা ও সাহিত্য সম্মেলনের ব্যাপারে জোর দিলেও নানা কারণে তা আর হয়ে উঠছে না।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 March 2024, 04:12 PM
Updated : 3 March 2024, 04:12 PM

অমর একুশে বইমেলার বাইরে কয়েক বছর আগেও একটি মেলা হত ‘ঢাকা বইমেলা’ নামে, যেখানে সম্মিলন ঘটত দেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সেই মেলা থেমে গেছে ২০০৯ সালে। এখন প্রতি বছর মাসব্যাপী একুশে বইমেলা হলেও সেখানে কেবল জায়গা পান দেশীয় লেখক-প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতারা।

সেইসঙ্গে বছর সাতেক ধরে বন্ধ আছে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনও। অথচ বাংলা ভাষা আর সাহিত্যকে বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে লেখক-প্রকাশক ও গুণীজনরা আন্তর্জাতিক বইমেলা ও সাহিত্য সম্মেলনের ব্যাপারে জোর দিলেও নানা কারণে তা আর হয়ে উঠছে না।

এবারের একুশে বইমেলা ঘিরে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের আলোচনাও উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাগিদ দিয়েছেন বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রসারে সেই মেলা করার।

গত পহেলা ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি সকল প্রকাশককে মুদ্রণ প্রকাশনার পাশাপাশি ডিজিটাল প্রকাশক হওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। যাতে আমরা আমাদের বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, বিশ্ব মঞ্চেও দ্রুত পৌঁছে দিতে পারি।”

আগামীতে আন্তর্জাতিক সাহিত্যিকদের নিয়ে এসে, বিশেষ করে বাংলা ভাষায় যারা সাহিত্য চর্চা করেন, তাদের সম্মিলন ঘটিয়ে বর্ণাঢ্য সাহিত্য মেলা করার ঘোষণাও দেন তিনি।

নীতিমালা অনুযায়ী একুশে বইমেলা কেবলই বাংলাদেশের সাহিত্যিক ও প্রকাশকদের মেলা। ফলে এখানে আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক ও প্রকাশকদের সম্পৃক্ততা ঘটে কম। তবে বাংলাদেশি সাহিত্যিকদের কেউ কেউ বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ প্রকাশ করেন, যার মধ্য দিয়ে কিছু বিদেশি সাহিত্যের স্বাদও মেটে।

তবে এই মেলার বাইরে আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন কথাসাহিত্যিক মাহবুব মোর্শেদ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে প্রকাশিত বইসহ অন্য দেশে প্রকাশিত বই বিক্রি ও প্রদর্শনীর জন্য বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র বা সেরকম কোনো স্থানে পয়লা বৈশাখ বা ১৬ ডিসেম্বর ঘিরে ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজন করা উচিত।”

থেমে গেছে ঢাকা বইমেলা

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর ডিসেম্বরে ‘ঢাকা বইমেলা’ নামে একটি বড় পরিসরে বইমেলা আয়োজন করত। এতে দেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অংশ নিত বিদেশি প্রতিষ্ঠানও। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে এই মেলা বন্ধ রয়েছে।

এরপর ২০১৯ সালের দিকে ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বইমেলা’ নামে একটি মেলা আয়োজনের পরিকল্পনা হলেও পরে তার বাস্তবায়ন হয়নি বলে জানান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর।

ঢাকা বইমেলা বন্ধের কারণ জানতে চাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ঢাকা বইমেলা তো অনেক বছর ধরেই হচ্ছে না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই এটি বন্ধ রয়েছে। এখন নানা কারণেই এটি করা সম্ভব হয়নি।

“বঙ্গবন্ধুর নামে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা করার পরিকল্পনা হয়েছিল। সরকার ২০২০-২১ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। পরিকল্পনা ছিল, মুজিববর্ষে ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বইমেলা’ আয়োজন করা হবে এবং পরে প্রতি বছর সেটি করা হবে। কিন্তু সেটিও করা সম্ভব হয়নি।”

আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজনের উদ্যোগ দেশের প্রকাশক সংগঠনের নেওয়া উচিত বলে মনে করেন মিনার মনসুর।

তার ভাষ্য, “এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত, আমাদের পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি আছে। তাদের সক্ষমতাও এখন বেড়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে প্রকাশকদের সংগঠন রয়েছে, তারা কিন্তু সেটারও সদস্য। ফলে তারা যদি সরকারের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজনের উদ্যোগ নেয়, আমি মনে করি সেটি ভালো হবে।

“সরকার তো নানারকম নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। সংগঠন আয়োজন করলে সেটা সহজেই করা যায়। বর্তমান সরকার সংস্কৃতিবান্ধব, ফলে এরকম উদ্যোগের পাশে থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস।”

জানতে চাইলে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা গত বছরও উদ্যোগ নিয়েছিলাম, পরে আর হয়নি। এবার আমাদের ইচ্ছা আছে আন্তর্জাতিক বইমেলা করার।”

আন্তর্জাতিক বইমেলার জায়গার সংকটের কথা জানিয়ে শ্যামল পাল বলেন, “বইমেলা সব জায়গায় জমবে না। এর আগে আমরা আগারগাঁও, শিল্পকলা একাডেমির মাঠ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠের কথা ভেবেছি। সেসব জায়গায় বইমেলা জমবে না। বইমেলা করার জন্য উপযুক্ত জায়গা হল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।”

ঢাকায় আন্তর্জাতিক বইমেলা হলে সেখানে অংশ নিতে চীন, রাশিয়া, ভারতসহ অনেকগুলো দেশের প্রকাশকদেরেই আগ্রহ রয়েছে বলে জানান শ্যামল পাল।

তিনি বলেন, “আমরা আয়োজন করলে তারা আসবে। আমরা তো এখন ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের (আইপিএ) সদস্য। এছাড়া এশিয়ান পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনেরও সদস্য। ফলে আমাদের দিক থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা সহজ।

“ভেন্যু নিয়ে আমরা একটা সমস্যায় পড়ি। আশা করি এ বছরই আমরা একটা উদ্যোগ নিতে পারব।”

আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন কবে?

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমি প্রথম আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন আয়োজন করেছিল। ২০১১ সালেও তিন দিনের আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছিল প্রতিষ্ঠানটি।

সবশেষ ২০১৭ সালে শামসুজ্জামান খান মহাপরিচালক থাকাকালীন বইমেলার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম চার দিন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন আয়োজন করা হয়। ওই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জার্মানি, অস্ট্রিয়া, চীন, রাশিয়া, পুয়ের্তো রিকো, থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের লেখক, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও বুদ্ধিজীবীরা অংশ নেন।

২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন উদযাপন পর্ষদে যুক্ত ছিলেন রামেন্দু মজুমদার, কবি আসাদ চৌধুরী এবং কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। বর্তমানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন নূরুল হুদা।

আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন কেন হচ্ছে না- সেই প্রশ্নে মহাপরিচালক বলেন, “এবার বইমেলার প্রথম চার দিন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন করার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছিল। নির্বাহী পরিষদ থেকে সেটির অনুমোদনও হয়েছিল। পরে জাতীয় নির্বাচন এবং নানান কারণে সেটি করা সম্ভব হয়নি।

“আগামী বছর বইমেলার প্রথম চার দিন আমরা এই সাহিত্য সম্মেলন করার পরিকল্পনা করছি। আশা করি বইমেলা উদ্বোধনের সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনও উদ্বোধন করবেন।”

স্বাধীন বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের গুরুত্বের কথা জানিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও।

১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন করে তিনি বলেছিলেন, “আমরা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিক থেকে দরিদ্র নই। আমাদের ভাষার দু’হাজার বছরের একটি গৌরবময় ইতিহাস আছে।

“আমাদের সাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। আজকে স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের মর্যাদাকে দেশে ও বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।”

‘বঙ্গবন্ধুর ভাষা ও সাহিত্যচিন্তা’ প্রবন্ধ গ্রন্থে জাতির পিতার এই উদ্ধৃতির উল্লেখ করেন প্রাবন্ধিক ও গবেষক বিশ্বজিৎ ঘোষ।