বিষাদানন্দে ভাঙল মেলা

এবারের বইমেলায় নতুন বই প্রকাশ এবং বিক্রি দুটোই বেড়েছে। কিন্তু সংশয় জেগেছে আগামীবারের মেলার স্থান নিয়ে।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 March 2024, 05:52 PM
Updated : 2 March 2024, 05:52 PM

শেষ দিনটা কাটল আড্ডা আর বই কেনার আনন্দে; পহেলা ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া ৩১ দিনের একুশে বইমেলার পর্দা নামল শনিবার।

এদিন রাত সাড়ে ৮টার পর থেকেই দেখা যায়, কোনো কোনো স্টলে বিক্রয়কর্মীরা একে অপরের সঙ্গে আড্ডায় মেতেছেন। মাসজুড়ে কাজের মধ্য দিয়ে পরস্পরের মাঝে যে সৌহার্দ্য গড়ে উঠেছিল, তার যবনিকা টানতে গিয়ে কারো কারো চোখে টলমল করতে দেখা যায় বিষাদের জল।

পাঞ্জেরী, প্রথমাসহ বেশ কয়েকটি প্যাভিলয়নে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বেশ কয়েকজন তরুণ। তাদের অনেকেই মেলায় এসে পরিচিত হয়েছেন একে অপরের সঙ্গে। শেষ দিন তাদের বই বিক্রির পাশাপাশি ছবি তোলায় ব্যস্ত দেখা যায়।

শনিবার ছিল বইমেলার ৩১তম দিন। মেলা শুরু হয় সকাল ১১টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। এদিন নতুন বই এসেছে ১৪৯টি।

মেলায় সকাল থেকে লোক সমাগম কম হলেও বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই অনেকে আসেন। অনেকে বন্ধুদের বই উপহারও দেন।

কেউ কেউ মেতে ওঠেন গান-আড্ডায়। সন্ধ্যার পর যতই ঘনিয়ে আসে মেলা ভাঙার সময়, ততই যেন আড্ডা জমতে থাকে আরও বেশি।

কবি শরাফত হোসেন এদিন অনেকগুলো বই কিনেছেন, বন্ধুদের বই উপহার দিয়েছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "বইমেলায় এসে আড্ডা দেওয়াটা খুব মিস করি। সেজন্যই আজ কাজের ব্যস্ততার পরও মেলায় আসা মিস করিনি। মূলত আড্ডা দিতেই এসেছি।"

বেড়েছে বই বিক্রি ও বই প্রকাশ

এবারের বইমেলায় নতুন বই প্রকাশ এবং বিক্রি দুটোই বেড়েছে। গত বছর মোট ৪৭ কোটি টাকার বই কিনেছেন ক্রেতারা, এবার সেই অংকটি বেড়ে প্রায় ৬০ কোটি টাকার হয়েছে বলে জানিয়েছে মেলা পরিচালনা কমিটি।

এবার নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৭৫১টি, যা গতবার ছিল ৩ হাজার ৭৩০টি। শনিবার বিকেলে মেলার মূল মঞ্চে বইমেলার সমাপন অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানায় মেলা পরিচালনা কমিটি। 

মেলার সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলামের অনুপস্থিতে বইমেলার রিপোর্ট পাঠ পড়ে শোনান বাংলা একাডেমির উপপরিচালক সাহেদ মন্তাজ।

স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক নূরুল হুদা। প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।

নূরুল হুদা বলেন, "এবার মেলায় আমরা কিছু ত্রুটির সম্মুখিন হয়েছি। সাংবাদিকরাও সেসব ত্রুটি নিয়ে লিখেছেন, আগামীবার আমরা সেই ত্রুটি সংশোধন করার চেষ্টা করব।"

কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, "আমাদের বইমেলার মত বইমেলা পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের বইমেলা আবেগের বইমেলা, জাতির অভিপ্রায়ের বইমেলা।"

একুশে ফেব্রুয়ারিতে সাহিত্য সংকলন প্রকাশিত না হওয়ার আক্ষেপ ঝরে কবি কামাল চৌধুরীর কণ্ঠে।

তিনি বলেন, "আগে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে নানা রকম সাহিত্য সংকলন বের হত। এখন তেমনটি দেখা যায় না। আমরা আবার সেটি নিয়ে চিন্তা করতে পারি, কীভাবে নানা রকম চিন্তার সাহিত্য সংকলন প্রকাশ করা যায়।"

কামাল চৌধুরী বলেন, "অমর একুশে বইমেলা আজ বাঙালির ভাষা, শিল্প-সাহিত্য ও ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বইমেলার মাধ্যমে প্রতিবছর আমরা আমাদের সৃজনশীলতাকে উদ্যাপন করি। এই মেলা আমাদের আবেগের, জাতিসত্তার, ভাষা-সাহিত্য ও ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসার মেলা।"

প্রতিমন্ত্রী হিসেবে অফিস যাওয়ার আগেই নাহিদ ইজাহার মেলায়

শুক্রবার রাতে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন নাহিদ ইজাহার খান। শনিবার বইমেলার সমাপন অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন তিনি। 

নবনিযুক্ত সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার বলেন, “গত পহেলা ফেব্রুয়ারি বইমেলা যখন শুরু হয়, উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমি এসেছিলাম। তখনও ভাবতে পারিনি আমি সমাপন অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে অংশ নেব।”

প্রতিমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার পর এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অফিস শুরু করেননি তিনি। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে এটাই ছিল তার প্রথম কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ।

বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে মেলার সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশ লিমিটেডের সিএমও মীর নওবত আলীও বক্তব্য দেন।

দুদিন আগে বেইলি রোডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় অনুষ্ঠানে।

সভাপতির বক্তব্যে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, “বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনের এক অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনা। তথ্যপ্রযুক্তির বিপুল বিকাশের পরও মুদ্রিত বইয়ের আবেদন যে কোনোমতেই ফুরিয়ে যায়নি তার প্রমাণ একুশে বইমেলায় ক্রমবর্ধমান জনসমাগম।”

গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার ২০২৪ 

অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে ২০২৩ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক বই প্রকাশের জন্য কথাপ্রকাশকে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার ২০২৪ দেওয়া হয়। 

২০২৩ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে শৈল্পিক ও গুণমান বিচারে সেরা বই বিভাগে মনজুর আহমদ রচিত ‘একুশ শতকে বাংলাদেশ: শিক্ষার রূপান্তর’ গ্রন্থের জন্য প্রথমা প্রকাশন; মঈন আহমেদ রচিত ‘যাত্রাতিহাস: বাংলার যাত্রাশিল্পের আদিঅন্ত’ গ্রন্থের জন্য ঐতিহ্য এবং আলমগীর সাত্তার রচিত ‘কিলো ফ্লাইট’ প্রকাশের জন্য জার্নিম্যান বুকস-কে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৪ দেওয়া হয়।

২০২৩ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ বইয়ের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ময়ূরপঙ্খিকে দেওয়া হয় রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০২৪।

২০২৪ সালের অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্যপ্রকাশ (প্যাভিলিয়ন), নিমফিয়া পাবলিকেশন (২-৪ ইউনিট) এবং বেঙ্গল বুকসকে (১ ইউনিট) শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৪ দেওয়া হয়।

বইমেলা বাংলা একাডেমিতে থাকবে তো?

একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে বইমেলা আগামী বছর সরে যাবে বলে যে গুঞ্জন উঠেছে তা নিয়েও কথা হয় মেলার সমাপন অনুষ্ঠানে।

বাংলা একাডেমি মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, “আমরা নতুন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী পেয়েছি। আমি নতুন প্রতিমন্ত্রীকে বইমেলার স্থান পরিবর্তনের আলোচনার বিষয়ে বলেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, মেলা কীভাবে বাংলা একাডেমিতে রাখা যায়। প্রয়োজনে সামনের রাস্তাটি ব্যবহার করে এখানে রাখা যায় কিনা, সেই চেষ্টা করা হবে। এবার মেলা যেভাবে আছে, আগামী বছর সেভাবেই হবে বলে আশা করছি।”

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ বলেন, "বইমেলা কীভাবে একটি স্থায়ী কাঠামোতে যেতে পারে, সেটি নিয়ে ভাবা হচ্ছে।"

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান বলেন, "আমি কোনো প্রতিশ্রুতি দিই না। আমি জেনেছি, আগামীবার এই মাঠে বইমেলা করার অনুমোদন পাওয়া যাবে না। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব কীভাবে বইমেলা এই প্রাঙ্গণে রাখা যায়।"