বঙ্গবন্ধু হত্যায় ‘কলকাঠি নেড়েছে কারা’, উদঘাটন হওয়া উচিত: প্রধান বিচারপতি

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পেছনের ঘটনা উদঘাটনে একটি কমিশন গঠন করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের দুজন বিচারপতি

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 August 2022, 06:15 PM
Updated : 11 August 2022, 06:15 PM

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পেছনে যারা ‘কলকাঠি নেড়েছে’ তাদের পরিচয় উদঘাটন হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে সামনে থেকে যারা গুলি করেছেন, তারা স্বীকার করেছেন যে, ‘আমরা খুন করেছি’। প্রশ্ন হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা শুধু কী তারাই করেছেন? নাকি অনেক বড় চক্র, যেটা এখনও উদঘাটন হয়নি। এটা উদঘাটন হওয়া উচিত যে এর পেছনে কলকাঠি কারা নেড়েছে।”

বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, “আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছি ১৯৭৫ সালে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে ফিরে এসে খুব গর্ব করে বলেছিলেন ‘সপ্ত কোটি সন্তানেরা... মানুষ করোনি- কবিগুরুর এ বাণী আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালিরা আজ মানুষ হয়েছে।’ বাঙালি কী আসলেই মানুষ হয়েছে? পঁচাত্তরের ঘটনায় কী মনে হয়, বাঙালি মানুষ হয়েছে? কারণ বঙ্গবন্ধুকে যারা গুলি করেছে তারা বাঙালি!”

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘটনা উদঘাটনে একটি ‘কমিশন’ গঠন করা উচিত বলে মনে করেন আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান ও বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।

বিচারপতি নুরুজ্জামান বলেন, “আমরা এমনিও জানি কারা ষড়যন্ত্রকারী, কারা কী করেছে। একবারে জানি না সেই কথা নয়। যদি কমিশন হয়, তথ্য-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হয়, তাহলে তা ইতিহাস হয়ে থাকবে।”

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, “একটি কমিশন হওয়া উচিত। কারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল, দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কারা সম্পৃক্ত ছিল। একটি কমিশনের মাধ্যমে এটি উদঘাটিত না হলে আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে না যে কী ঘটনাটি সেদিন ঘটেছিল।”

তিনি বলেন, “শারীরিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে কয়েকজন সামরিক বাহিনীর লোক। তাদের বিচার হয়েছে, ফাঁসি হয়েছে। এটাই কী যথেষ্ট? ইতিহাসকে সঠিক পথে আনার জন্য আমার মনে হয়, আমি যে প্রস্তাব রেখে গেলাম, সরকার এটি বিবেচনা করবে।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। একদল সেনা কর্মকর্তা এই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিলেও এর পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা আওয়ামী লীগ নেতারা বরাবরই বলে আসছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছিল। খুনিদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, তাদের নানা পদ দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে।

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ইতিহাসে চিহ্নিত কালো ওই অধ্যাদেশ বাতিলের পর জাতির পিতার খুনের বিচারের পথ খোলে। ওই মামলায় ১৯৯৮ সালে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। তাদের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড সর্বোচ্চ আদালতেও বহাল থাকে।

ওই ১২ আসামির একজন পলাতক থাকা অবস্থায় দেশের বাইরে মারা যান। দুই দফায় ছয় জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কিন্তু পাঁচজন এখনও অধরা।

বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার পেছনে জিয়াউর রহমানের হাত ছিল বলে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করে আসছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ নেতারাও ‘পঁচাত্তরের কুশীলবদের’ মুখোশ উন্মোচনে কমিশন গঠনের দাবি সামনে এনেছেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতবছরও বলেছিলেন, মহামারী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে কমিশন গঠন করা হবে, যাতে “ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে’ তাদের নাম জনসম্মুখে প্রকাশ করা যায়।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ১৯৮১ সালে যুক্তরাজ্যে একটি অনুসন্ধান কমিশন গঠন করা হয়েছিল। তবে এ কমিশনের সদস্যদের বাংলাদেশে আসতে দেওয়া হয়নি।

তখন বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি ছিলেন জিয়াউর রহমান, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন।

পরে ১৯৮২ সালের ২০ মার্চ যুক্তরাজ্যের এই কমিশন তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।

সে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে আইনি ও বিচার প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব পথে এগোতে দেওয়া হয়নি। আর এজন্য তখনকার সরকারই দায়ী।

হাই কোর্টের বিচারপতি এ এন এম বসির উল্লাহর রচিত ‘বিচারক জীবনের কথা’ শীর্ষক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি বোরহান উদ্দীন ছিলেন বিশেষ অতিথি।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মূখ্য আলোচক ছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। বইয়ের লেখক বিচারপতি এ এন এম বসির উল্লাহও উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।