‘ধনীদের এসি বিলাস ভোগাচ্ছে’ স্বল্প আয়ের মানুষকে

“আমাদের আসলে বিলাসিতা এবং প্রয়োজনের লাগাম টানা দরকার,” বলেন ড. আদিল মুহাম্মদ খান।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2022, 02:40 PM
Updated : 21 Oct 2022, 02:40 PM

গরম থেকে স্বস্তি পেতে দেশের উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তরা দিনকে দিন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসির ব্যবহার বাড়িয়ে দিচ্ছে; কিন্তু তাতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের; কারণ এসির আউটডোর ইউনিট বাড়িয়ে দিচ্ছে শহরের তাপমাত্রা।

শুক্রবার ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) আয়োজিত এক ভার্চুয়াল আলোচনায় এ পরিস্থিতির কথা উঠে এসেছে আলোচকদের কথায়।

অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশে এসি ব্যবহারজনিত বিদ্যুৎ চাহিদা ও নগর তাপমাত্রায় প্রভাব’ শীর্ষক একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ও আইপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।

তিনি বলেন, গত কয়েক দশকে ঢাকার তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি বেড়ে গেছে। তাপমাত্রা বাড়ার প্রধান কারণ ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার বাড়ছে।

“তাপ থেকে বাঁচার জন্য এসি নির্ভরতা বাড়ছে, যা কিনা উল্টো আরও তাপ বাড়াচ্ছে। এতে করে মাঝখান থেকে নিম্ন মধ্যবিত্তরা সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।”

অধ্যাপক আদিলের উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত ছয় বছরে এসির চাহিদা বেড়েছে ২০ শতাংশ। ২০১৬ সালে ২ দশমিক ৯ লাখ ইউনিট এসি বিক্রি হয়েছিল সারা দেশে। তারপর ২০১৭ সালে ৩ দশমিক ৩ লাখ ইউনিট, ২০১৮ সালে ৩ দশমিক ৯ লাখ, ২০১৯ সালে ৪ দশমিক ৫ লাখ, ২০২০ সালে ৩ লাখ এবং ২০২১ সালে ৬ লাখ ইউনিট বিক্রি হয়েছিল। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৪ লাখ ইউনিট এসি বিক্রি হয়েছে।

তার মানে গেল ৭ বছরে এসি বিক্রি হয়েছে মোট ২৭ দশমিক ৫ লাখ ইউনিট। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশেরই ব্যবহাকারী ঢাকাবাসী।

দেশের বিভিন্ন শিল্পের কাজে ২৮ শতাংশ, বাণিজ্যিক কাজে ১১ শতাংশ এবং কেবল বাসাবাড়িতে ৫৬ শতাংশ এসি ব্যবহার হয় বলে জানান অধ্যাপক আদিল।

চলমান বিদ্যুৎ সংকটে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সাশ্রয় বা খরচ বাঁচানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “এসি ২২ ডিগ্রিতে না চালিয়ে যদি ২৬ ডিগ্রিতে চালানো হয় তবে তা কম বিদ্যুৎ খরচ করবে।”

বর্তমানে দেশে ২৮ লক্ষাধিক ইউনিট এসির ব্যবহার আছে জানিয়ে অধ্যাপক আদিল বলেন, এসব যন্ত্রকে ২২ ডিগ্রিতে না চালিয়ে ২৬ ডিগ্রিতে ব্যবহার করা হলে ৩৩ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।

এসির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আইপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল বলেন, “যদি প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে এসির ডিমান্ড কমাতে পারি, তাহলে আরও ভালো। আর সরকারি পর্যায় থেকে এসি বন্ধ রাখার জন্য জানালা পর্দা খুলে দেওয়ার দিক-নির্দেশনা রয়েছে।

“আমাদের আসলে বিলাসিতা এবং প্রয়োজনের লাগাম টানা দরকার।”

সরকারি বিভিন্ন ভবনে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহারের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, বর্তমানে নির্বাচন ভবনে ২৭০০ টন, রাজস্ব ভবনে ২৫০০ টন, পানি ভবনে ২৪০০ টন, অর্থ মন্ত্রণালয় ভবনে ১৫০০ টন এবং সচিবালয় ভবনে ৪০০০ টন এসি ব্যবহার করা হচ্ছে, যার যৌক্তিকতা নিয়ে ভাবা উচিত ছিল।

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার অনুষ্ঠানে বলেন, “আমাদের যে আবহাওয়া, যে তাপমাত্রা ঐতিহাসিকভাবে ছিল; আমাদের এসি ব্যবহারের প্রয়োজন ছিল না। আজ ১২০-২০০ স্কয়ার… ঘরের তাপমাত্রা কমানোর জন্য আউটডোর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছি। এতে মানবাধিকারও লঙ্ঘিত হচ্ছে।”

তবে কেবল বিলাসিতার জন্যই যে এসির ব্যবহার বাড়ছে তা মানতে রাজি নন স্থপতি শাহরিয়ার ইকবাল রাজ। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের এ সহকারী অধ্যাপকের কথায়, “আমরা এসিকে শত্রু হিসেবে মনে করছি, আসলে তা না। যেভাবে ক্লাইমেট চেঞ্জ হচ্ছে, মানুষ বাধ্য হয়ে এসি ব্যবহার করছে। ঢাকায় বায়ুপ্রবাহের জন্য স্পিড নাই। আমাদের সব ভবন ঘেঁষাঘেঁষি করে তৈরি; কোথাও কোনো সবুজ নাই।”

Also Read: শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ: গরমের আরাম ডাকছে বিপদ

ভবন নির্মাণে কংক্রিটের ব্যবহার বাড়ায় গরম থেকে বাঁচতে মানুষ এসি লাগাতে যে বাধ্য হচ্ছে তা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “গুলশান-বারিধারার অধিকাংশ বিল্ডিং কংক্রিটের তৈরি, ওখানের দেয়ালগুলো পুরু থাকে; সেগুলো আমাদের মোহাম্মদপুরের বাড়ির মত না।

“যদি এসি নিয়ে কথা বলি, এসিকে কীভাবে ইফিশিয়েন্ট করা যায়- সেটা ভাবতে হবে। “

এখনকার মানুষ ‘আধুনিকতার নামে’ উন্নত বিশ্বের জীবনযাপন অনুসরণ করছে মন্তব্য করে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, “আমরা জানি না, একেকটা দেশের ক্লাইমেট একেকরকম। এই অঞ্চলের ক্লাইমেটের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যেন ভবনের নকশা করি।”

আলোচক হিসেবে অন্যদের মধ্যে ছিলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম, আইপিডির পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম ও ড. চৌধুরী মো. জাবের সাদেক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফরহাদুর রেজা।