শিক্ষা খাতে বাজেট ‘কমতে থাকায়’ হতাশা

বাজেটের মোট ব্যয়ের অনুপাতে শিক্ষায় বরাদ্দ ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 June 2023, 03:00 PM
Updated : 1 June 2023, 03:00 PM

টাকার অংকে বাড়লেও মোট বাজেট আর জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরও কমেছে।

গত কয়েক বছর ধরেই বাজেটে অন্যান্য খাতের তুলনায় শিক্ষায় গুরুত্ব কমে আসছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও একই ধারা অব্যাহত থাকায় হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশ করে শিক্ষা খাতকে ‘মেগা প্রকল্প’ হিসেবে অগ্রাধিকার দিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের জন্য উত্থাপিত ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাবে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ৯৯ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল।

সে হিসাবে নতুন অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের অনুপাতে ১ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে।

অবশ্য বিদায়ী অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ কমে হয় ৮৫ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১২.৮৯ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম শিক্ষাখাতে বরাদ্দ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাজেট বরাদ্দ দেখে অবাক হয়েছি। কারণ শিক্ষায় যে পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ দেয়ার কথা ছিল, তার অর্ধেকও এবার দেওয়া হয়নি।"

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একটি দেশের শিক্ষা খাত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ পেলে তা আদর্শ ধরা হয়। 

নতুন বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে যে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা জিডিপির ২ দশমিক ০৭ শতাংশের সমান। বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতের বরাদ্দ ছিল জিডিপির ২ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর সংশোধিত বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৯১ শতাংশ।

অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম বলেন, “এটি দুঃখের কথা। কারণ বঙ্গবন্ধু কুদরত-ই-খোদার নেতৃত্বে যে শিক্ষা কমিশন করেছিল, তারা যে প্রতিবেদন দিয়েছিল, সেখানে বলা হয়েছিল, বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ হবে জিডিপির ৫-৭ শতাংশ। কিন্তু এই সরকার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সবকিছুই বাস্তবায়ন করছে, কিন্তু শিক্ষায় হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল, শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়লে শিক্ষার মান বাড়বে। কিন্তু শিক্ষার বরাদ্দ যে কমছে, শুধুমাত্র অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমেই কিন্তু সেটা হয় না।"

ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষায় সংস্কার আনতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি।

"২০৩০ সালে যেন সেখানে পৌঁছাতে পারি, সেদিকে জোর দিতে হবে। কারিগরি শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করতে হবে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থাকবে একটাই, বিভিন্ন উইং থাকবে।

"শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে-স্কেল করা উচিত। প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো উচিত। বেতন অনেক বাড়ানো উচিত, যেন মেধাবী শিক্ষার্থীরা এ পেশায় আসে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো উন্নত করা উচিত, সেটা মেগা প্রকল্পও করা উচিত।"

শিক্ষায় গুরুত্ব কমিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নে জোর দেওয়ার সমালোচনা করেন মনজুরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “শিক্ষায় জোর না দিলে আমরা পরনির্ভরই হয়ে থাকব। প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে থাকব। ১০০ বছর পরে মেগাপ্রকল্পগুলো কিন্তু ভেঙে ফেলতে হবে। শিক্ষার জন্য মহা মেগাপ্রকল্প হওয়া উচিত। কিন্তু শিক্ষায় বরাদ্দ প্রতিবছরই কমছে।

"এটা দুঃখজনক। কারণ মূল উন্নয়ন হওয়া উচিত শিক্ষায়, অবকাঠামোয় নয়। ভালো শিক্ষক না থাকলে ভাল শিক্ষার্থী তৈরি হবে না। সেজন্য শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়াতে হবে।"

শিক্ষায় বাজেট না বাড়ানো হলে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হুমকির মধ্যে পড়বে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, "সরকারের কাছে শিক্ষা অগ্রাধিকার পাচ্ছে না। তাই আমরা যারা শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলছি, সেটা আর থাকবে না। শিক্ষা মুখ থুবড়ে পড়বে।” 

শিক্ষার্থীদের স্মার্ট বাংলাদেশের উপযোগী করার জন্য প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাদানের ওপর গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

তিনি বলেন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের জন্য ৫০ হাজারের অধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৫৯ হাজার ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ইন্টারনেটসহ সাউন্ড-সিস্টেম সরবরাহ করা হয়েছে।

"আইসিটি বিষয়ে ৮০০ জন কর্মকর্তা এবং ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরির জন্য ১ লাখের অধিক শিক্ষককে হাতে-কলমে আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। তারা ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছেন। ফলে, পাঠদান আকর্ষণীয় হচ্ছে ও শিশুদের পাঠে মনোযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।"

তবে অধ্যাপক হাফিজুর রহমান মনে করেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষায় বরাদ্দ অবশ্যই বাড়াতে হবে, না হলে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

"সব মহলেই শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেটা বাড়াতে হলে প্রথমেই আমাদের মনোযোগ দিতে হবে মেধাবী শিক্ষার্থীদের এ পেশায় আনা। এজন্য বেতন স্কেল বাড়াতে হবে। বিশাল বিনিয়োগ এখানে প্রয়োজন, নইলে শিক্ষা-ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। শিক্ষকদের জন্য মানসম্মত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

"শিক্ষাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মহা মেগাপ্রকল্প হিসেবে নেওয়া উচিত। যে দেশে যত বেশি শিক্ষিত মানুষ সে দেশ তত বেশি এগিয়ে যায়।"

নতুন অর্থবছরের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগকে ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগকে ১০ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। 

আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ১৩ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে ২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা রাখা হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ কমেছে।

চলতি অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ে ১৬ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও, সংশোধিত বাজেটে তা ১২ হাজার ৮২১ কোটি টাকায় নেমে আসে।