স্ত্রী-সন্তানকে হত্যার মামলায় জামিন নিয়ে এক যুগ ধরে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে ছদ্মবেশে থাকার পর সবশেষ বাউল বেশে পালিয়ে বেড়ানো এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
বৃহস্পতিবার রাতে সাভারের শাহীবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাকির হোসেন (৪৭) নামে ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বাড়ি মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে।
র্যাব জানায়, পলাতক অবস্থায় জাকির দ্বিতীয় বিয়ে করে সাভার থানার জিনজিরা এলাকায় বসবাস করছিলেন। এই সংসারে তার পাঁচ বছর এবং তিন বছরের দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে।
শুক্রবার কারওয়ানবাজার মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে জাকিরকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া এসব তথ্য তুলে ধরেন র্যাব-৪ এর অধিনায়ক মো. মোজাম্মেল।
তিনি জানান, ২০০৫ সালে স্ত্রী নিপা আক্তার (২২) এবং তিন বছর বয়সী মেয়ে জ্যোতিকে হত্যা করেন জাকির। ওই ঘটনায় নিপার বাবা মো. আবু হানিফের দায়ের করা মামলায় বিচার চলার সময় তিনি ৫ বছর কারাগারে ছিলেন।
২০১০ সালে জামিনে বের হয়ে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। পরে ২০২১ সালে জাকিরের অনুপস্থিতিতেই মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করে করে মানিকগঞ্জের একটি আদালত।
স্ত্রী-সন্তান হত্যা
সংবাদ সম্মেলনে জাকিরের প্রথম স্ত্রী নিপার মা সুফিয়া খাতুন জানান, ২০০০ সালে জাকিরের সঙ্গে নিপার বিয়ে দেন। তাদের বাড়ি মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে। জাকিরের বাড়িও একই গ্রামে।
কিন্তু বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের জন্য তার মেয়েকে চাপ দেওয়া হয়। এছাড়া ভাবীর সঙ্গে জাকিরের পরকিয়া সম্পর্কের কারণে তাদের সংসারে অশান্তি লেগে থাকত।
তার দাবি ওই সম্পর্কে বাধা দেওয়ার কারণেই তার ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে এবং নাতনিকে খুন করে জাকির।
“এছাড়া পলাতক থাকা অবস্থায়ও জাকির আমাদের বিভিন্ন মাধ্যমে হত্যার হুমকি দিত”- বলেন সুফিয়া।
র্যাব অধিনায়ক মোজাম্মেল বলেন, “জাকির ২০০৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঘুমন্ত অবস্থায় তার স্ত্রী নিপা আক্তারকে গলায় গামছা দিয়ে হত্যা করেন। ওই সময় মেয়ে জোতি জেগে উঠে কান্নাকাটি করলে তাকেও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়।”
হত্যাকাণ্ডের পর নিপার বাবা মো. আবু হানিফ বাদী হয়ে দৌলতপুর থানায় জাকির হোসেন, তার বাবা নইম উদ্দিন শেখ, মা মালেকা বানু এবং ভাবী তাহমিনাসহ চারজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।
হত্যাকাণ্ডের পর নিপার বাবা মো. আবু হানিফ বাদী হয়ে দৌলতপুর থানায় জাকির হোসেন, তার বাবা নইম উদ্দিন শেখ, মা মালেকা বানু এবং ভাবী তাহমিনাসহ চারজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।
হত্যাকাণ্ডের পরপরই মামলার প্রধান আসামি জাকিরসহ তার পরিবারের চারজনকেই গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একমাস কারাভোগের পর জাকির ছাড়া সবাই জামিনে মুক্তি পায়।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব কর্মকর্তা মোজাম্মেল বলেন, “মামলা চলা অবস্থায় ৫ বছর জেলে থাকার পর ২০১০ সালে জামিনে মুক্তি পেয়ে আত্মগোপনে চলে যায় জাকির।”
মামলার বিচার
র্যাব জানায়, ওই খুনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগে জাকির এবং তারা বাবা, মা, ভাবী ছাড়াও জাকিরের বড় ভাই জাহাঙ্গীর হোসেন, বন্ধু আমিনুল , শ্যালক স্বপন ও হাসান এবং জাকিরের চাচাত ভাই পারভেজ ওরফে রানাসহ মোট নয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সমস্ত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জাকিরের অনুপস্থিতিতেই তার মৃত্যুদণ্ড দিয়ে মামলার রায় ঘোষণা করেন মানিকগঞ্জ জেলার জেলা ও দায়রা জজের বিচারক উৎপল ভট্টাচার্য।
রায়ে জাকিরের ভাবী তাহমিনা, ভাই জাহাঙ্গীর, বন্ধু আমিনুল, চাচাতো ভাই পারভেজ রানা মিলন, শ্যালক স্বপন ও হাসানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বেকসুর খালাস পান জাকিরের মা মালেকা বানু।
বিচার চলার সময়ই তার বাবা নইম উদ্দিন মারা যান বলে সংবাদ সম্মেলনে জানায় র্যাব।
আত্মগোপনে জাকির
শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে র্যাব কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল জানান, পলাতক অবস্থায় ২০১৩ সালে জাকির দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তিনি বারবার ঠিকানা বদলেছেন এবং কোনো জায়গায় বেশিদিন থাকতেন না।
“পলাতক থাকা ১২ বছরে কোনোদিন জাকির মানিকগঞ্জের দৌলতপুর যাননি। তবে গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য প্রথমে চট্টগ্রাম ও পরবর্তীতে ঢাকার আরামবাগ, ফকিরাপুল, হাজারীবাগ, খিলগাঁও ও সাভার এলাকায় বসবাস করতেন।”
র্যাব অধিনায়ক জানান, পরিচয় গোপন করে জাকির প্রায়ই পেশা পরিবর্তন করতেন। বিভিন্ন সময় গার্মেন্টস, স্পাইরাল বাইন্ডিং এবং ঝুট ব্যবসাও করেছেন।
“পরবর্তীতে ছদ্মবেশ ধারণ করে বিভিন্ন বাউল গানের দলের সাথে ঘুরে বেড়াত ও বাউল গান করে জীবিকা নির্বাহ করত। জাকির নামের পরিবর্তে বাউল নাম ব্যবহার করে বাউল পরিচয় দিয়ে আসছিল।”
তিনি জানান, আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় বাবার নাম ‘নাইম শেখ’ এর জায়গায় ‘আব্দুর রহিম’ ব্যবহার করেন জাকির।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, জাকির এতদিন তার মোবাইল ফোনে নিজের নামে কোনো সিমও ব্যবহার করেননি।