“এ রকম চলতে থাকলে পরিবহন শ্রমিকরা তো না খায়া মরবে। এহন সরকারক আপনারা কন তারা যেন হামাগেরে কিছু সাহায্য সহযোগিতা দেয়,” বলেন এক বাসচালক।
Published : 10 Nov 2023, 12:38 AM
বিএনপির অবরোধ চলার মধ্যে ঢাকার প্রধান বাস টার্মিনাল গাবতলীতে কোটালিপাড়া স্টার এক্সপ্রেসের কাউন্টারের সামনের বেঞ্চে বিমর্ষ মুখে বসেছিলেন মধ্যবয়সী নূর খান।
বাসের জন্য ডাকাডাকি করে যাত্রী জুটিয়ে দেওয়া তার কাজ। এজন্য কাউন্টার থেকে মজুরি দেওয়া হয় দিনে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। বাস বন্ধ থাকলে মজুরিও বন্ধ।
তবুও অবরোধের প্রতিটি দিনই গাবতলীতে এসে বসে থাকেন নূর খান, আশা যদি কোনো গাড়ি ছাড়ে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে নূর খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলছিলেন, “আইজকা সকালে একটা গাড়ি ছাড়ছে। আইজ হয়ত একশটা টেকা পামু। যেইদিন গাড়ি যায় নাই সেইদিন কুনো টেকাই পাই নাই।”
দুই ছেলে মেয়ে তার। ছেলে বিয়ে করে আলাদা থাকেন। অবরোধের মধ্যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলেও স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে চলার মতো টাকা রোজগার করতে পারেননি; বিমর্ষ ছিলেন সারাদিন।
গত ২৯ অক্টোবর থেকে নূর খানদের মতো মানুষদের জীবন হয়ে গেছে দুর্বিষহ। হরতাল আর অবরোধে নাশকতার যেসব ঘটনা ঘটছে, তার প্রায় সবই পরিবহনকেন্দ্রিক।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ২৮ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ১২৬টি আগুনের সংবাদ এসেছে। এর মধ্যে প্রায় সবই বাস।
অবরোধ যত গড়াচ্ছে ঢাকায় নগর পরিবহনে বাসের সংখ্যা বাড়ছে, শ্রমিকরা পালা করে কাজ করছেন। তবে দূরপাল্লায় যাত্রী আর নিরাপত্তাবোধ-দুইয়েরই অভাব। চাকা ঘুরছে কম, ফলে শ্রমিকদের আয়ে পড়েছে ভাটা।
অবরোধের মধ্য নগর পরিবহনে বাসের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়তে থাকলেও দূরপাল্লায় এ প্রবণতা নেই। যাত্রী কম বলে বাস ছাড়ছে খুবই কম। ফলে টার্মিনালের শ্রমিকদের মধ্যে উদ্বেগের ছাপ এখন স্পষ্ট।
এই কয়েকদিন মালিকরা অল্প কিছু টাকা দিচ্ছেন; কিন্তু সেই টাকায় তিন বেলা খাওয়ার পর বাড়িতে পাঠানোর উপায় থাকে না।
যে শ্রমিকরা বাস নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন, তাদের মধ্যে বিশেষ করে ভোর আর সন্ধ্যায় ছিল আগুনের ভয়। পুড়েছে শতাধিক গাড়ি, ঢাকার একজন পরিবহন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি এক পরিবহন শ্রমিক।
যেসব গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর শ্রমিকরা একেবারে বসে গেছেন। যে মালিকদের কিস্তি টানতে হয়, তারা আছেন আরেক বিপদের সামনে।
কিন্তু রাজনীতিতে সমঝোতার কোনো আভাস নেই। সরকার ও বিরোধী দল তাদের অবস্থানে অটল। আর আগামী সপ্তাহের প্রথম দুই কর্মদিবসও ডাক দেওয়া হয়েছে অবরোধের, বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছেন, ‘তাদের এই আন্দোলন থামবে না’।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে সহিংসতার পর থেকে হরতাল ও অবরোধ জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে গেছে। ১০ কর্মদিবসের মধ্যে সাত দিন গেছে অবরোধে, একদিন ছিল হরতাল।
‘মরার দশা’য় গুড্ডু
গাবতলীতে আনাস পরিবহন বাসের ভেতর ঘুমিয়ে ছিলেন হেলপার মোফাজ্জল হোসেন গুড্ডু। ছবি তুলতে দেখে বাস থেকে নেমে এলেন। জানালেন অবরোধের সময় বাসেই কেটেছে তার দিন-রাত।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে গুড্ডু বলেন, “রোজগার কম। তার ওপর জিনিসপত্রের দাম অনেক। এহন যদি ‘বেকার’ থাকতে হয় তাহলে তো ‘মরার দশা’।”
লালমনিরহাট সদরে বাড়ি গুড্ডুর। তার বাসটিও চলে ঢাকা থেকে বুড়িমারী রুটে। এ রুটে একবার যাওয়া আসায় গুড্ডু বেতন পান ৮০০ টাকা। এ রকম পাঁচ রাউন্ড ট্রিপ পূরণ করতে তার লাগে ১০ দিন।
বেতনের চার হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। আবার এক সপ্তাহ বা ১০ দিন পর আবার ট্রিপ পান।
এই হেলপার জানান, গাড়ির ট্রিপ না থাকায় এখন প্রতিদিন মালিক ২০০ টাকা করে খোরাকি দেন। এই টাকায় নিজের থাকা-খাওয়া চালাতে হয়।
“গাবতলীতে একবার বাথরুম করতে গেলেই লাগে ১০ ট্যাকা, গোসলে লাগে ২০/৩০”, খরচের ‘হাত’ কতটা লম্বা, সেই উদাহরণ টানেন তিনি।
গাবতলী টার্মিনালের এক কোণায় বটগাছের নিচে একটি জলাধারে (হাউজ) গোসল করার ব্যবস্থা রয়েছে। গামছা কাঁধে, মাজন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে গোসল করতে যাচ্ছিলেন রাবেয়া পরিবহনের শ্রমিক মো. আজিজ।
তিনি বলেন, “মালিক যে খোরাকির টাকা দেয় তাতে নিজেরটা কোনোমতে চলে। বাড়িতে একটা পয়সা পাঠানোর উপায় থাকে না।”
“আমরা দিন খাইট্টা-দিন চলি, আমাগের তো দুইডা পয়সা জমানোর কোনো সুযোগ থাকে না। এই আইজ তিন দিন ধইরে বউরে বাজার করার টাকাটা পর্যন্ত পাঠাতি পারি নাই। দুইডা বাচ্চা নিয়া সে ক্যামনে চলে?”
তৃতীয় দফা অবরোধের শেষ দিন নিজের দুর্গতির কথা এভাবেই বলেন, আজিজ।
খোরাকির টাকায় থাকা নাকি খাওয়া?
বুধবার অবরোধের দিন বাস চালক মোহাম্মদ আলী বলছিলেন, “দুইশ ট্যাকা খোরাকি দিয়া কী হয় কন? বোর্ডিংয়ে (হোটেলে) থাকতে গেলে কম করেও দেড়শ ট্যাকা লাগে। আবার তিন বেলা খাতি হয়, আবার বাথরুম, হাতখরচা আছে।”
তাহলে কীভাবে চলে?
মোহাম্মদ আলী বলেন, “আমরা গাড়িতেই ঘুমাই। মশার কামড় খাতি হয় রাতভর। তয় এহন গরম নাই, এইটা একটু কষ্ট কম।”
বাসচালক শহীদুর রহমান বলেন, “আমরা তো গাড়ি নিয়া বাইর হইতে চাই, কিন্তু যাত্রী নাই। খাইলা গাড়ি নিয়া দৌড়াদৌড়ি করলে তো উল্টা লস।
“এ রকম চলতে থাকলে পরিবহন শ্রমিকরা তো না খায়া মরবে। এহন সরকারক আপনারা কন তারা যেন হামাগেরে কিছু সাহায্য সহযোগিতা দেয়।”
আগুনের আতঙ্ক
গত ২৯ অক্টোবর যে হরতাল ডাকা হয়, সেটি শুরুই হয় এক পরিবহন শ্রমিকের মৃত্যুর খবর দিয়ে।
সেদিন ভোরে ডেমরা পশ্চিম দেইল্লা পাকা রাস্তার ওপর পার্ক করে রাখা অছিম পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে বাসের হেলপার ২০ বছর বয়সী নাঈম ওরফে নাজিম পুড়ে মারা যান। দগ্ধ হন রবিউল নামে আরেক যুবক।
সেদিনের হরতাল আর পরে অবরোধে যত গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে বেশিরভাগই ঢাকার ভেতরে চলে, কিছু গাড়ি আশেপাশের জেলা থেকে আসে।
এর মধ্যে বেশ কিছু গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে ভোরে, যখন শ্রমিকরা বাসের ভেতরে ঘুমিয়ে ছিলেন।
গত ৫ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বনশ্রীর মেরাদিয়া বাঁশপট্টি এলাকায় চলন্ত অছিম পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় যাত্রীবেশী দুর্বৃত্ত। এ সময় চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশে খালে নামিয়ে দেন বাসটি।
এ সময় নামতে গিয়ে ওই বাসের যাত্রী আরেকটি বাসের চালক মো. সবুজ দগ্ধ হন। তাকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।
সবুজের অবস্থা ‘আশঙ্কাজনক’ জানিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক তরিকুল ইসলাম বলেন, “তার (সবুজ) তার শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, শরীরের শতকরা ২৮ শতাংশ পুড়ে গেছে।”
ঢাকার বসিলা এলাকায় রাস্তার পাশের ফাঁকা জায়গায় পার্ক করে রাখা কয়েকটি পরিস্থান পরিবহনের বাস। এদের একটির হেলপার মো. আজম বলছেন, চারদিকে গাড়ি পোড়ানোর আতঙ্কের মধ্যে গাড়ি রেখে তিনি বাসায় যেতে পারছেন না। রাতের বেলায় এখানেই ঘুমাতে হয় তাকে।
এক দিকে জীবনের শঙ্কা, অন্যদিকে উপার্জনের অবলম্বন বাসের নিরাপত্তা নিয়ে দুর্ভাবনা।
মঙ্গলবার আজম বলছেন, “আমরা তো জমার গাড়ি চালাই। গাড়ি না চললে আমাগো সব বন্ধ।”
মালিকের সঙ্গে দৈনিক চুক্তিতে চালক, সুপারভাইজার ও তিনি মিলে গাড়িটি চালান। সারাদিন চালিয়ে যা উপার্জন হয় মালিকের জমা সাড়ে তিন হাজার টাকা এবং সারা দিনের খরচ বাদ দিয়ে বাকি টাকা ভাগাভাগি করে নেন তারা।
ফের ঋণের ‘জালে’ পড়ার শঙ্কা
তৃতীয় দফা অবরোধের প্রথম দিন বুধবার মহাখালী টার্মিনালে বুধবার একটি চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে মোবাইল ফোনে লুডু খেলছিলেন কয়েকজন। তারা সবাই বিভিন্ন বাসের হেলপার। সড়কে না নামলেও গাড়ি রেখেও কোথাও যেতে মানা সবার।
এদের একজন হাফিজুল ইসলাম। জানান, একবার জামালপুর আসা যাওয়া করলে তিনি পান ৬০০ টাকা। গাড়ি চললে কিছু ‘উপরি’ আয়ও হয়। এখন গাড়ি বসা, তাই দিনে দেড়শ টাকা ‘খোরাকি’ দিচ্ছেন মালিক।
বাস চালক জহিরুল আলম বলছিলেন, তার মালিক ‘বসা অবস্থায়’ তাদের পাঁচশ করে দেন। সেই টাকা তিনি, সুপারভাইজার ও হেলপার মিলে ভাগ করে নেন।
এমনিতে বাস নিয়ে একবার জামালপুর আসা-যাওয়া করলে তাদের ২ হাজার ৪০০ টাকা দেওয়া হয়। এখান থেকে চালক হিসেবে জহিরুলের থাকে এক হাজার। সুপারভাইজারের থাকে ৮০০ টাকা আর হেলপারের ৬০০।
জহিরুলের ভাষ্য, আগের জমা টাকা ভাঙিয়ে এখন চলছেন। এই অবস্থা বেশিদিন চললে ঋণের বোঝায় পড়তে হবে তার এবং বেশিরভাগ পরিবহন শ্রমিকের। কোভিড মহামারীর সময় করা ঋণের জালে জড়ানোর স্মৃতি এখনও তাজা। সেখান থেকে বের হতে অনেক কষ্ট হয়েছিল তার।
জীবন বাবু নামে এক পরিবহন শ্রমিক বলছিলেন, “আমাগো সংসার চলেই গাড়ির উপ্রে। চাক্কা না ঘুরলে ইনকামও নাই। আমার ঘরে নতুন পোলা হইছে। খাওনেরও দাম বাড়ছে, বাড়তি খরচ সবদিকে। হাতে তো দুইদিন চলারও টেকা নাই।
“মালিকে কইছে গাড়ি বাইর করব। কিন্তু যাত্রীই তো নাই। দু-একটা গাড়ি মুমনসিং গেল, দুই ঘণ্টা খাড়ায়া ১০টা প্যাসেঞ্জারও তুলতে পারে নাই টার্মিনাল থিকা।”
তাদের খোরাকিও নেই
শুধু পরিবহন কর্মী নয়, বাস কাউন্টারের শত শত কর্মীরও আয় বন্ধ হয়ে রয়েছে। তাদের আবার খোরাকির ব্যবস্থা নেই।
কল্যাণপুরের শ্যামলী এনআর পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজার মো. নাসিম বলছিলেন, “আমাদের পরিবহন লাইনে বেতন এমনিই কম। মানে খুব কম। তাও বেশির ভাগ লোক কমিশন বা ট্রিপ অনুযায়ী টাকা পায়। গাড়ি বন্ধ থাকলে এই লোকগুলান একেবারে বিপদে পড়ে। এরা তো সবাই দিন আনে দিন খাওয়া মানুষ। আমাদের এখানে কয়েকটা বড় কোম্পানি শুধু মাস হিসেবে বেতন দেয়।”
তিনি জানান, বুধবার বন্ধ রাখার পর বৃহস্পতিবার রাতের জন্য তারা বুকিং নেওয়া শুরু করেন। কিন্তু যাত্রী সংখ্যা বেশ কম। তাই কমিশন কত মিলবে, এ নিয়ে দুশ্চিন্তার নেই শেষ।
‘ক্ষমতায় আপনারা থাকবেন-আসবেন, শ্রমিকরা জান দেব কেন?’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলছেন, তারা পরিবহন শ্রমিকদের সাহায্য-সহযোগিতার বিষয়ে সরকারে কাছে একটা দাবিনামা দিয়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলছেন, “এই পরিবহন শ্রমিকরা কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি না। তবে তাদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়া কেউ ক্ষমতায় যাবেন এটা তো পরিবহন শ্রমিকরা মানবে না। আপনারা ক্ষমতায় থাকবেন বা ক্ষমতায় আসবেন, কিন্তু আমরা পরিবহন শ্রমিকরা জান দেব কেন?”
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, “এ রকম লাগাতার হলে এটা নিয়ে ভাবতে হবে। তবে এখন সিটির গাড়িগুলো ঘুরে-ফিরে চলছে। আর দূরপাল্লার অনেক গাড়ি না চলায় সেসব শ্রমিকেরা বেকার হয়ে পড়েছে, সেটা আমাদের মাথায় রয়েছে।
“বড় কোম্পানিগুলো যে দু-এক ট্রিপ চালাচ্ছে তারা কিন্তু রোটেশনে (ঘুরিয়ে ফিরিয়ে) সব স্টাফদের সুযোগ দিচ্ছেন। আমার কোম্পানিতেই (এনা পরিবহন) যে অল্পসংখ্যক গাড়ি চলছে সেখানে রোটেশনে সব ড্রাইভার-স্টাফদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যাত্রী না থাকায় গাড়িগুলো চালাতে সমস্যা হচ্ছে।”