এবার বছরের প্রথম দিনে পাঠ্যবই পায়নি অনেক শিশু; বইয়ের কাগজ ও ছাপার মান নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
Published : 02 Jan 2023, 11:50 PM
“আমরা তো কোনো বই পেলাম না, তাহলে পড়ব কীভাবে?” হতাশ কণ্ঠে জানতে চাইছিল ছোট্ট শাফির আহমেদ।
নতুন বছরের শুরুতেই বই পাওয়ার আশা থাকলেও কোনো বই পায়নি ঢাকার মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম শ্রেণির এই শিক্ষার্থী।
শাফিরের মতো তার সহপাঠীদেরও নতুন বইয়ের সুবাস নেওয়ার আশায় স্কুলে গিয়ে মুখ গোমড়া করে ফিরতে হয়েছে।
অন্য বারের মতো বছরের প্রথম দিন রোববার উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা সারে সরকার। তবে দরপত্রে দেরি করা এবং কাগজের বাজারে অস্থিরতা থাকায় ঠিক সময়ে সব বই স্কুলে স্কুলে পৌঁছায়নি।
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানে ছাড় দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন প্রকাশকরা। সরকার তাতে শেষ মুহূর্তে সায় দেওয়ার পর অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানো শুরু হয়, তবে সেই কাজও শেষ করতে পারেনি ছাপাখানাগুলো।
এবার বইয়ের কাগজের মানও যে কমেছে, তা মানছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। সোমবার চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এবার অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছে। মেল্ডের (কাগজ তৈরির মণ্ড) দাম বেড়ে গেছে। বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল। জাতীয় স্বার্থে লোডশেডিং করতে হয়েছে। ফলে কিছু কিছু জায়গায় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়।
“ফলে ছাপার মানের কারণে কিছু ভুল বা ‘প্রিন্টিং মিসটেক’ থাকতে পারে। সেগুলো পরে ঠিক করা যাবে। তবে আপনারা জানেন, আমরা নতুন কারিকুলামে (পাঠ্যক্রম) যাচ্ছি। আগামী বছরে নতুন পাঠ্যক্রম অনুসারে বই এসে যাবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী কারিকুলাম আমরা করেছি। আশা করি, সেই কারিকুলাম অনুসারে উন্নত টেক্সট বুক দিতে পারব।”
বই বিতরণ উৎসবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন ছাপাখানা থেকে ৮০ শতাংশ বই পাওয়ার তথ্য দিয়েছেন।
ফলে রাজধানী ও এর বাইরের অনেক শিক্ষার্থী বই পায়নি, আর যারা পেয়েছে তারাও সব বই পায়নি। বিশেষ করে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বই না পাওয়ার কথা বলছে। মাধ্যমিকেও কোথাও কোথাও একেবারেই বই না পাওয়ার খবর মিলছে।
মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের শিক্ষার্থী শাফিরের মা শাহরীন বুশরা বলেন, “টিচাররা বলল বই আসেনি, তাই দিতে পারছে না।”
এই স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষক খাদিজা ইসলাম সুপ্তি জানান, তাদের স্কুলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কোনো বই-ই আসেনি।
“ক্লাস ওয়ান ও টুয়ের কোনো শিক্ষার্থীকে বই দেওয়া যায়নি। অন্যান্য ক্লাসে দুই-তিনটা করে বই এসেছে। পুরো সেট বই আসতে সময় লাগবে। কবে নাগাদ বই আসবে, সে বিষয়েও আমরা ক্লিয়ারলি জানি না, তাই গার্ডিয়ানদেরও এ ব্যাপারে জানাতে পারছি না।”
ফলে রাজধানী ও এর বাইরের অনেক শিক্ষার্থী বই পায়নি, আর যারা পেয়েছে তারাও সব বই পায়নি। বিশেষ করে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বই না পাওয়ার কথা বলছে। মাধ্যমিকেও কোথাও কোথাও একেবারেই বই না পাওয়ার খবর মিলছে।
মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের শিক্ষার্থী শাফিরের মা শাহরীন বুশরা বলেন, “টিচাররা বলল বই আসেনি, তাই দিতে পারছে না।”
এই স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষক খাদিজা ইসলাম সুপ্তি জানান, তাদের স্কুলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কোনো বই-ই আসেনি।
“ক্লাস ওয়ান ও টুয়ের কোনো শিক্ষার্থীকে বই দেওয়া যায়নি। অন্যান্য ক্লাসে দুই-তিনটা করে বই এসেছে। পুরো সেট বই আসতে সময় লাগবে। কবে নাগাদ বই আসবে, সে বিষয়েও আমরা ক্লিয়ারলি জানি না, তাই গার্ডিয়ানদেরও এ ব্যাপারে জানাতে পারছি না।”
২০১০ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের হাতে চারশ কোটির বেশি বিনামূল্যের বই তুলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এবার ৪ কোটি ৯ লাখ ১৫ হাজার ৩৮১ জন শিক্ষার্থীকে ৩৩ কোটি ৯১ লাখ ১২ হাজার ৩০০ কপি পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করবে সরকার।
এর মধ্যে প্রাথমিকের ২ কোটি ১৮ লাখ ৩ হাজার ৩০ জন শিক্ষার্থীদের মাঝে ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৮ হাজার ২৪৫টি বই বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা চলতি মাসেই পূরণ করার আশা প্রকাশ করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন।
মিরপুর ১২ নম্বরের রশীদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা গেল, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কোন শিক্ষার্থীই ২০২৩ সালের পাঠ্যবই পায়নি। প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিম, তুহিন, সাইফান বই না পেয়ে মন খারাপ করে স্কুল ছেড়েছে।
মিমের মা নাসরিন আক্তার জানান, নতুন ক্লাসে বইয়ের আশায় স্কুলে আসলেও তার মেয়ে আশাহত হয়ে ফিরেছে।
“সব বাচ্চারা বই পাচ্ছে, অথচ ওরা পেল না। দুই-তিনটা হলেও বই দেওয়া উচিত ছিল, বাচ্চাদের মন ভেঙে গেছে। আমাকে বই কিনে দিতে বলছে মেয়েটা।”
দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইফান আহমেদ বলল, “আমার ভাইয়া তো বই পেল, আমরা পেলাম না।”
এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক এস এম এমদাদুল ইসলাম জানালেন, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বই এখনও আসেনি। অন্যান্য শ্রেণিতে বেশ কয়েকটি করে বই এসেছে।
“অন্যান্য ক্লাসে মোটামুটি সবাই বই পেয়েছে, কিন্তু সব বই পায়নি। সপ্তম শ্রেণির তিনটা, ষষ্ঠ শ্রেণির চারটা- এমন দিয়েছে। অষ্টম ও নবম শ্রেণির সব বই পেয়েছে শিক্ষার্থীরা।”
বই বিতরণ উৎসব এবার যে কিছুটা প্রাণ হারিয়েছে তা স্বীকার করে এই শিক্ষক বলেন, “বই পাওয়ার পর বাচ্চাদের মনে যে প্রফুল্লতা ফুটে ওঠে, সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে একেবারে ছোটরা বই না পাওয়ায় ওদের মন খারাপ হয়েছে।”
মগবাজারের বিটিসিএল আইডিয়াল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ইয়াসিন কোনো বই পায়নি। এই স্কুলের তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও বই পায়নি।
ইয়াসিনের বাবা মোহাম্মদ আজহার বলেন, “স্কুল থেকে বলেছে- বই আসলে মেসেজ দিবে। ও বইয়ের অপেক্ষায় ছিল, এখন একটু মন খারাপ।”
পল্লবীর লিটল ফ্লাওয়ারস প্রিপারেটরি স্কুলের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থী কোনো বইই পায়নি। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ৩টি করে বই পেয়েছে।
রাজধানীর বাইরের অনেক শিক্ষার্থীও ২০২৩ সালের বিনামূল্যের পাঠ্যবই এখনও না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন।
সাভারের রাজাশন ল্যাবরেটরি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুলাইমান হককে বই নিয়ে আসার জন্য বছরের প্রথম দিন সকালে স্কুলে যেতে বলা হলেও সে কোনো বই পায়নি।
সুলাইমান বলল, “সকাল ১০টায় স্কুলে বই দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দিল না, ছোট ক্লাসেও অনেকে বই পায় নাই। বড়রা আবার বই পেয়েছে।”
সুলাইমানের মা সায়মা চৌধুরী বললেন, “এবার আগে থেকেই খবরে দেখছিলাম- সব বাচ্চারা বই পাবে না। তখন তো মন্ত্রী বলল, সব বই না পেলেও ৮০ শতাংশ পাবে। কিন্তু আমাদের বাচ্চারা তো কোনো বই পেল না। বই না পেয়ে বাচ্চারা হতাশ হয়ে গেছে।”
নীলফামারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নবেজ উদ্দিন রোববার বলেন, “জেলায় প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই লাখ ৩৮ হাজার ৭১৮ জন। এসব শিক্ষার্থীর মাঝে বই বিতরণ করা হবে ১৭ লাখ ৭৫ হাজার ৬১৯টি।
“এ পর্যন্ত ৩০ দশমিক ৫০ ভাগ বই হাতে এসে পৌঁছেছে। বাকি বই চলতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে পাব বলে আশা করছি।”
সেখানে মাধ্যমিকে ৫ শতাংশ বইয়ের ঘাটতি রেখেই বই উৎসব হয়েছে বলে জানান তিনি।
শেরপুরে মাধ্যমিক পর্যায়ে ১৮১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৭ লাখ বইয়ের চাহিদা থাকলেও রোববার পর্যন্ত সেখানে ১৭ লাখ ৫০ হাজার বই পৌঁছায় জানিয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রেজুয়ান বলেন, “প্রাথমিক পর্যায়ে ৭৪২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বইয়ের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৮ লাখ। এ পর্যন্ত সাড়ে ৩ লাখ বই এসে পৌঁছেছে।”
রাজধানীর যেসব স্কুলে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা ১-২টি বই পেয়েছে, তারা বাকি বই কবে পাবে তা নিশ্চিত নয়।
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী অনন্যা ত্রিপুরা শ্রেয়া বছরের প্রথমদিন বাংলা বই পেয়েছে, সোমবার পেয়েছে গণিত বই।
এই শিক্ষার্থীর বাবা মধু ত্রিপুরা বলেন, “শিক্ষকরা বলেছে বাকি বই আসেনি। আসলে দিবে। কিন্তু বাচ্চারা তো নতুন বইয়ের আশায় থাকে। তার মন খারাপ হয়েছে। পরে নিজেই বড় বোনের পুরনো বই বের করে উল্টে-পাল্টে দেখছে।”
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী কামরুল হাসান তিনটি বই পেয়েছে। শিক্ষকরা বাকি বই না আসার কথা জানিয়েছে এই শিক্ষার্থীকে।
কেবল গণিত বই পাওয়ার কথা জানিয়ে পুরান ঢাকার বাংলাবাজার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী তাহমিনা আক্তার বলল, “বাকিগুলো দিবে বলেছিল, কিন্তু দেয়নি।”
চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সুরাইয়া আক্তার চারটি পাঠ্যবই পেয়েছে।
এই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জালাল উদ্দিন সরকার বলেন, “তৃতীয়, চতুর্থ, সপ্তম, অষ্টম শ্রেণির বই কম এসেছে। আজকেও দেওয়া যায়নি। হয়তো কয়েকদিনের মধ্যে পেয়ে যাব, তখন দিয়ে দিব। আগে যা পেয়েছি, তা দিয়ে দেওয়া হয়েছে৷”
মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের শেওড়াপাড়া শাখার দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তিনটি করে বই পেয়েছে।
মিরপুর ১২ নম্বরের ঢাকা আইডিয়াল প্রিপারেটরি স্কুলের প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরাও ১-৩টি করে বই পেয়েছে।
এই স্কুলের শিক্ষক রাজিয়া সুলতানা বলেন, “কোনো কোনো ক্লাসের ১টা, কোনটার ৩টা বই এসেছে৷ যেগুলা আসছে, সেগুলা দেওয়া হচ্ছে। বাকিগুলো আমাদের হাতে আসলেই দিয়ে দিব।”
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
পাঠ্যপুস্তক প্রস্তুত ও বিতরণের দায়িত্বে থাকা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফের ডটকমকে বলেন, প্রাথমিকের বই ছাপানোর কাজ শেষ করতে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিকে ইতোমধ্যে ৭২ শতাংশ বই সারাদেশে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এবার প্রাথমিকের টেন্ডার জটিলতার কারণে বই ছাপানোর কাজ দেরিতে শুরু হয়েছে। প্রাথমিকের যেসব ছাপাখানা বই মুদ্রণের সাথে জড়িত, তাদের সাথে ৩ ডিসেম্বর এনসিটিবিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রীসহ আমাদের মিটিং হয়েছে।
“সেখানে কাগজের মানে ছাড় দেওয়ার পরে প্রেস মালিকরা প্রাথমিকের কাজ শুরু করেছে। সেই হিসেবে জানুয়ারির ১৫ তারিখ পর্যন্ত তারা কাজ শেষ করার সুযোগ পাবে।”
আর মাধ্যমিকে বই তৈরির কাজ শেষ দাবি করে তিনি বলেন, অনেক জায়গায় ৩০/৩১ ডিসেম্বর বই গেছে। উপজেলা থেকে বিদ্যালয়ে নিয়ে বই বিতরণ করতে সময় লাগছে।
কয়েকদিনের মধ্যেই মাধ্যমিকের বই বিতরণ শেষ করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন অধ্যাপক ফরহাদ।
তবে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত ডয়চে ভেলে বাংলাকে বলেন, “সব শিক্ষার্থীকে সব বই দিতে পুরো জানুয়ারি মাস লেগে যাবে৷ প্রাথমিকের ৪০ ভাগ বই ছাপানো এখনও বাকি আছে৷ আর মাধ্যমিকের বাকি আছে ২০-২৫ ভাগ৷”
এ পরিস্থিতির জন্য কার্যাদেশ দেরিতে পাওয়া আর কাগজের সংকটকে দায়ী করেন তিনি৷