বমরা ভারতে ঢুকছে, দাবি বিএসএফের; বিজিবি বলেছে, কুকি চিনের ‘অপপ্রচার’

সীমান্ত সম্মেলন থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে এলেন বিজিবি প্রধান।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 June 2023, 03:04 PM
Updated : 15 June 2023, 03:04 PM

এবার সীমান্ত সম্মেলনে বম পার্টির তৎপরতাও উঠেছে আলোচনায়। বিএসএফের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বম জনগোষ্ঠীর মানুষরা ভারতের মিজোরামে চলে যাচ্ছে। জবাবে বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঘটনাটি তেমন নয়, পাহাড়ি সংগঠন ‘কুকি চিন ন্যাশনাল আমি’ কাউকে জোর করে পাঠিয়ে এমন ‘অপপ্রচার’ চালাতে পারে।

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৩তম সম্মেলন শেষে দেশ ফিরে বৃহস্পতিবার পিলখানায় বাহিনীর সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান এবারের বৈঠকের বিষয়বস্তু তুলে ধরেন।

সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে বম জনগোষ্ঠী ভারতের মিজোরামে চলে যাচ্ছে বলে বিএসএফ তথ্য উপস্থাপন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিজিবির মহাপরিচালক বলেন, ভৌগোলিক ও সংস্কৃতিক ঐক্যের কারণে ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেরই পার্বত্য সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এই নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। উভয় দেশে তাদের আত্মীয়-পরিজনরা বসবাস করছে।

“সম্প্রতি পাহাড়ী সন্ত্রাসীগোষ্ঠী কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) দমনে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় অবস্থানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীরা অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে প্রতীয়মান। প্রপাগান্ডার অংশ হিসেবে কিছু মানুষকে কেএনএ সন্ত্রাসীরা জোর করে মিজোরামে পাঠিয়ে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে জাতীয়তা নিশ্চিতকরণ সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আশ্বাস প্রদান করা হয়েছে।”

পার্বত্য চট্টগ্রামে বম জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে গড়ে ওঠা সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মির সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘাতের খবর গত কিছু দিন ধরে আসছে। এই দলটি স্থানীয়ভাবে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত। তারা নিজেদের স্বাধীন ভূখণ্ডের মাত্রচিত্রও তৈরি করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে কয়েকবারই পার্বত্য অঞ্চল, বম পার্টি ও এই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর নেতা নাথান বমের প্রসঙ্গ আসে।

নাথান বম মিজোরামে অবস্থান করে সেখান থেকে সোশাল মিডিয়ায় ভিডিও ছাড়ছে বলে অনেকের ধারণা। এ বিষয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে বিজিবির মহাপরিচালক বলেন, “এই ধরনের (নাথান বমের মতো) পলিটিক্যাল লোকজনকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমি মনে করি মিনিস্ট্রি পর্যায়ে আলোচনা হওয়া উচিৎ। আমি তার (ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) সঙ্গে আলোচনা করেছি, আমরা যেমন এখানে কাজ করছি, তারাও বর্ডারগুলো যেন সিল করে দেয়, যাতে সন্ত্রাসীরা এপাশ থেকে ওপাশে যেতে না পারে। নাথান বমের হস্তান্তরের ব্যাপারে কোন আলোচনা তার সঙ্গে আমার হয়নি।”

বম পার্টির সদস্যদের কাছ থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম উদ্ধারের দিকটি দেখিয়ে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, সীমান্ত এলাকায় তৎপর কুকি চিন গোষ্ঠী কোত্থেকে এত আধুনিক অস্ত্র পাচ্ছে, সে বিষয়ে বিএসএফের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে কি না?

জবাবে মেজর জেনারেল নাজমুল বলেন, “অস্ত্র আসছে তো ডেফিনিটলি, তবে আমরা তো বলতে পারবো না অস্ত্র ইন্ডিয়া বা মিয়ানমার থেকে আসছে। অস্ত্র তো তৈরি হয় বিভিন্ন দেশে। কীভাবে আসছে, কোনদিক দিয়ে আসছে এসব স্পেসিফিক ইনফরমেশন না থাকলে…”

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিএসএফ মহাপরিচালক সন্দেহভাজন ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিজিবি ও বাংলাদেশের অন্যান্য বাহিনীর গৃহীত পদক্ষেপের প্রশংসা করেন। তখন বিজিবি মহাপরিচালক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ কখনও তার ভূমি অন্য কোন রাষ্ট্রের সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর প্রয়োজনে ব্যবহারের সুযোগ দেয় না; ভবিষ্যতেও দেবে না।

ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী ও জঙ্গি গোষ্ঠী’র অবস্থান সম্পর্কে বিএসএফকে তথ্য দিয়েছে বিজিবি। এ বিষয়ে বিএসএফ সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়।

ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কারা- প্রশ্নে বিজিবির মহাপরিচালক বলেন, “আমি বলিনি যে ওখানে আছে তাদের বলেছি যে ওখানে এ ধরনের যদি থাকে, তাহলে যেন তারা আমাদের সহায়তা করে।”

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ভারতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের যেন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ রোধে বিএসএফ সীমান্তে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পাশাপাশি উভয় দেশের দালাল চক্র দমনে পরস্পরকে সহায়তা করতে উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছে।

নয়াদিল্লিতে ১১ থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত এই সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা শেষে ১৪ জুন যৌথ আলোচনার দলিল সই হয়।

সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা নিরসন, অবৈধ অনুপ্রবেশ, মাদক পাচার, মানব পাচার রোধ, স্বর্ণ ও অস্ত্র চোরাচালান রোধসহ বিভিন্ন ধরনের আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমন, সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ এবং পারস্পারিক সম্প্রীতি ও আস্থা বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা হয়।

বিজিবি মহাপরিচালকের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ ১৪ সদস্যের একটি দল এই সম্মেলনে অংশ নেয়। অন্যদিকে বিএসএফ মহাপরিচালক সুজয় লাল থাওসেন এর নেতৃত্বে ভারতের ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল ছিল সম্মেলনেভ

সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে উন্নয়মূলক কাজ নয়

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, উভয়পক্ষ পূর্বানুমতি ছাড়া সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে কোনো ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ শুরু না করার বিষয়ে একমত হয়েছে। এছাড়া সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে বন্ধ থাকা বেশ কয়েকটি উন্নয়নমূলক কাজ জয়েন্ট ভেরিভিকেশনের মাধ্যমে দ্রুত সমাধানের ব্যাপারে সম্মত হয় দুই পক্ষই।

তবে এবারের সম্মেলনে সব থেকে ‘উল্লেখযোগ্য সাফল্য’ হিসেবে বিজিবি বলছে, পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় বন্ধ থাকা উল্লেখযোগ্য পাঁচটি কাজ চালু করার বিষয়ে বিজিবির অনুমোদন পাওয়া গেছে।

এই কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে - রামগড় স্কুল ভবনের অসম্পন্ন কাজ, তিন বিঘা করিডোর এলাকার ঝালংগী পকেট এবং ভিতরবাড়ি পকেট এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন, শেরপুর জেলার ভোগাই নদীর তীর সংরক্ষণ, সিলেটের জকিগঞ্জে কুশিয়ারা নদী ও রহিমপুর খালের সংযোগস্থল পুনঃখনন এবং নেত্রকোনা জেলার ভবানীপুর সীমান্তে পৌনে ২ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা পাকাকরণ।

গরু প্রসঙ্গ

বিজিবি টিকেটের মাধ্যমে ভারতীয় গরু এক জেলা থেকে আরেক জেলায় পাঠাচ্ছে- এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ডিজি বলেন, “এ ধরনের কোনো দায়িত্ব বিজিবির নেই যে গরু দেওয়ার জন্য কোনো টিকেট বা পারমিশন দিয়ে থাকে। আমাদের দায়িত্ব শুধু সীমান্ত এলাকায কোনো অবৈধ গরু এলে সেগুলোকে আমরা ধরে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করি। বিজিবির পক্ষ থেকে টিকেট দিয়ে গরু এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠানো হচ্ছে না।”

ডিজি বলেন, “মাঝখানে একটা মিস ইনফরমেশন হয়েছে, কোনো একটা ব্যক্তি ভুয়া পত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নামে বের করে। আমাদের এক অফিসারের কাছে প্লেস করে। আমি ভালোভাবেই জানি মন্ত্রণালয় থেকে গবাদি পশু আমদানির কোনো নির্দেশনা নেই। তাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় থেকে কেস করা হযেছে। তাদেরকে ধরার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। “

সীমান্তে হত্যা

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আলোচনায় বিজিবি মহাপরিচালক সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক নিরস্ত্র বাংলাদেশি হত্যা বা আহতের ঘটনা ‘জোরালোভাবে’ তুলে ধরেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বিএসএফকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় আনার জন্য আহবান জানান।

বিএসএফ মহাপরিচালক সীমান্ত হত্যা কমিয়ে আনার আশ্বাস দিয়েছেন বলে বিজিবি জানায়। এক্ষেত্রে বিএসএফ এর পক্ষ থেকে ‘নন-লেথাল’ নীতি অনুসরণের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়।

বিজিবি মহাপরিচালক বাংলাদেশে সীমান্তের ভেতরে ভারতের কিছু সংখ্যক ‘অপ্রত্যাশিত’ টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের নেতিবাচক প্রভাবের কথা তুলে ধরেন এবং এ বিষয়ে বিএসএফকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।

একইভাবে বিএসএফ মহাপরিচালকও ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক বিস্তারের বিষয়টি তুলে ধরেন। উভয়পক্ষ দুই দেশের টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক সুবিধা ব্যবহার করে সীমান্তে সংগঠিত অপরাধ রোধে সংশ্লিষ্ট দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করতে একমত হয়।

মাদক পাচার, অবৈধ অনুপ্রবেশ, মানব পাচার, স্বর্ণ, অস্ত্র, জাল মুদ্রার নোট প্রভৃতি চোরাচালানের মতো আন্তঃসীমান্ত অপরাধ রোধে সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের ওপর উভয় পক্ষ গুরুত্ব দেয়।