শায়খ ও বাংলাভাইসহ ৬ জঙ্গির ফাঁসি

চলতি বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইসহ নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা'আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) ছয় শীর্ষ নেতার ফাঁসি। ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলায় গত ২৯ মার্চ মধ্যরাতে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

লিটন হায়দারবিপ্লব রহমান ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Dec 2007, 06:24 AM
Updated : 17 August 2014, 03:54 AM

আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা মনে করছেন, শীর্ষ ছয় জঙ্গির ফাঁসি হওয়ায় জেএমবির সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে।

চলতি বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইসহ নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা'আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) ছয় শীর্ষ নেতার ফাঁসি। ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলায় গত ২৯ মার্চ মধ্যরাতে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

একই মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আরেক জঙ্গি আসাদুল ইসলাম আরিফ চলতি বছরের ১০ জুলাই ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তার হন। উচ্চ আদালতে করা আরিফের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত রয়েছে।

আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা মনে করছেন, শীর্ষ ছয় জঙ্গির ফাঁসি হওয়ায় জেএমবির সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। তারা বলছেন, জিএমবি সদ্যস্যরা বিচ্ছিন্নভাবে এখনো সক্রিয়। আর স্থায়ীভাবে জঙ্গি তৎপরতা নির্মূলের দায়িত্ব সমাজের সবাইকে নিতে হবে।

২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে জেলার সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহম্মেদ ও জগন্নাথ পাঁড়ের গাড়িতে বোমা হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় বোমা হামলাকারী ইফতেখার হোসেন মামুন, জেলা জজ আদালতের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী আব্দুল মান্নান ও ও দুধ বিক্রেতা বাদশা মিয়া আহত হন। ত্রয়োদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শেষ হওয়ার একদিনের মাথায় বোমা হামলার এ ঘটনা ঘটে।

২০০৬ সালের ২৯ মে এই হত্যা মামলার রায়ে ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ রেজা তারিক আহম্মেদ জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই, শায়খের ভাই আতাউর রহমান সানি, জামাতা আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হোসেন মামুন, খালেদ সাইফুল্লাহ (ফারুক) ও আসাদুল ইসলাম আরিফকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

এর আগে ২০০৬ সালের ৬ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে বাংলাভাইকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব সদস্যরা। এর চারদিন আগে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শায়খ রহমানকে।

ছয় জঙ্গির ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে ২০০৬ সালের ৩১ আগস্ট তাদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখে উচ্চ আদালত। এরপর ওই বছরের ২৮ নভেম্বর তখনকার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ হাইকোর্টের মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে ছয় জঙ্গির জেল আপিল খারিজ করে দেয়।

চলতি বছরের ৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি ছয় জঙ্গির প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দিলে তাদের ফাঁসি কার্যকর করার উদ্যোগ নেয় কারা কর্তৃপক্ষ।

২৯ মার্চ রাত ১২টা ০৫ মিনিটে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে শায়খ আবদুর রহমানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। পৌনে ১২টার দিকে আবদুর রহমানকে কনডেম সেল থেকে বের করে আনার আগে কারা মসজিদের ইমাম মাওলানা ওয়াদুল করীম তাকে তওবা পড়ান। এরপর তাকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামি রমিজ জল্লাদ তার ফাঁসি কার্যকর করেন।

এরপর রাত ১টা ৩৫ মিনিটে তার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি জামালপুর সদর উপজেলার তিপপল্লা ইউনিয়নের চরশী খলীফাপাড়া গ্রামে।

ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে একই সময়ে বাংলাভাই ও আব্দুল আউয়ালের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ময়মনসিংহ কারা কর্তৃপক্ষ শুক্রবার সকাল ৭টায় পুলিশ ও র‌্যাবের বিশেষ পাহারায় বাংলাভাইয়ের লাশ তার বগুড়ার গাবতলী থানার কুর্নীপাড়া গ্রামে নিয়ে যায়। বাংলাভাইয়ের বাবা নাজির হোসেন প্রামাণিক ছেলের লাশ গ্রহণ করেন। পরে মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয় বাংলাভাইকে।

আব্দুল আউয়ালের লাশ সকাল ৭টায় নাটোরের সিংড়া উপজেলার কালিগঞ্জে পৌঁছে। লাশ গ্রহণ করেন তার ভাই আব্দুল মান্নান সরকার। এরপর পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। 

খালেদ সাইফুল্লাহর ফাঁসি কার্যকর করা হয় পাবনা জেলা কারাগারে। সকালে কারা কর্তৃপক্ষ তার লাশ পিরোজপুর জেলার কাউখালীতে ভাই বেলায়েত হোসেনের কাছে পৌঁছে দেয়। বিকেলে তাকে দাফন করা হয় মায়ের কবরের পাশে।

ইফতেখার আল হাসান মামুন ও আতাউর রহমান সানির ফাঁসি কার্যকর করা হয় কাশিমপুর কারাগারে। মামুনের লাশ পরদিন সকালে তার গ্রামের বাড়ি রাজশাহী মহানগরীর ধরমপুর ডাঁশমারিতে নিয়ে গিয়ে বাবা লালচাঁদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আর সানির লাশ পৌঁছে দেওয়া হয় জামালপুরে তার স্বজনদের কাছে।

শায়খ আবদুর রহমান ও তার ভাই আতাউর রহমান সানিকে পরে জামালপুর সদর উপজেলার তিতপুল্লা ইউনিয়নের চষী খলিফা গ্রামের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।

ছয় জঙ্গির ফাঁসি প্রসঙ্গে র‌্যাবের মহাপরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকার রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আদালতের রায় কার্যকর হওয়ায় জেএমবির সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে দেওয়া গেছে। তবে বিচ্ছিন্নভাবে এর সদস্যরা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছে। তারা যে আবারো অপপ্রয়াস চালানোর চেষ্টা করবে না তা এখনই বলা সম্ভব নয়।”

জেএমবির বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, "তাদের সাময়িকভাবে প্রতিরোধ করা গেছে। দেশে জঙ্গি তৎপরতার স্থায়ী সমাধান পেতে হলে সমাজের সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। এককভাবে পুলিশ বা র‌্যাবের পক্ষে জঙ্গি দমন করা পুরোপুরি সম্ভব নয়।"

মৃত্যুদণ্ড পাওয়া এক জঙ্গির আপিল

দুই বিচারক হত্যা মামলায় ছয় শীর্ষ জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর আরেক আসামি আসাদুল ইসলাম আরিফ গ্রেপ্তার হন। গত ২৫ জুলাই আরিফ ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আবেদন করলে হাইকোর্টের আদেশে ওই রায়ের কার্যকরিতা আপাতত স্থগিত রয়েছে। তিনি এখন বরিশাল কারাগারে আটক আছেন।

নিহত দুই বিচারকের পরিবারের প্রতিক্রিয়া

জঙ্গিদের ফাঁসি কার্যকর করার পরপরই সন্তোষ প্রকাশ করেন ঝালকাঠির নিহত বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ের স্ত্রী জ্যোতি পাঁড়ে। তিনি বলেন, "আমি সুবিচার পেয়েছি। যেদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচার এখনও হয়নি সেখানে অতি দ্রুত আমি স্বামী হত্যার বিচার পেলাম।"

এছাড়া, নিহত সহকারী জজ সোহেল আহমেদের বাবা ডা. মনসুর আহমেদও ছয় জঙ্গির ফাঁসি হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন।

সরকারকে জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে সে সময় তিনি বলেছিলেন, "আমি চাই আর কোনো বাবা-মাকে যেনো জঙ্গি হামলায় সন্তান হারাতে না হয়।"