নির্বাচন কমিশনে সংস্কারের হাওয়া

ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরি, রাজনৈতিক দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধন, যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণাসহ নির্বাচন কমিশন এই প্রথমবারের মতো নানা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ওয়ান ইলেভেনের পর গত এক বছর ধরেই চলছে এ সব সংস্কার। বিপ্লব রহমান লিখছেন বিস্তারিত।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Jan 2008, 02:19 AM
Updated : 5 Jan 2008, 02:19 AM
ঢাকা, জানুয়ারি ৪ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম) - ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরি, রাজনৈতিক দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধন, যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণাসহ নির্বাচন কমিশন এই প্রথমবারের মতো নানা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ওয়ান ইলেভেনের পর গত এক বছর ধরেই চলছে এ সব সংস্কার। বিপ্লব রহমান লিখছেন বিস্তারিত।
নির্বাচন কমিশনে সংস্কার
ওয়ান ইলেভেনের পরদিনই ১২ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের সব প্রস্তুতি স্থগিত করে। ২১ জানুয়ারি ছুটিতে থাকা অবস্থায় সিইসি বিচারপতি এমএ আজিজ পদত্যাগ করেন।
৩১ জানুয়ারি ভারপ্রাপ্ত সিইসি বিচারপতি মাহফুজুর রহমান এবং অপর চারজন নির্বাচন কমিশনার সম জাকারিয়া, মাহমুদ হাসান মনসুর, মুদাব্বির হোসেন চৌধুরী এবং মো. সাইফুল আলম একযোগে বঙ্গভবনে গিয়ে পদত্যাগ করেন।
২২ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের দিন ২১ জানুয়ারি কমিশনের সাবেক সচিব আব্দুর রশিদ সরকার এক প্রজ্ঞাপন জারি করে নবম জাতীয় সংসদের এই নির্বাচন বাতিল করেন। একই সঙ্গে বাতিল হয়ে যায় ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের জন্য তৈরি করা ২০০৬ সালের বিতর্কিত ভোটার তালিকা।
৫ ফেব্র"য়ারি নতুন সিইসি হিসেবে সাবেক পানি সম্পদ সচিব এটিএম শামসুল হুদা এবং কমিশনার হিসেবে সাবেক আইন সচিব মুহাম্মাদ ছহুল হোসাইন শপথ গ্রহণ করেন। ১৩ ফেব্র"য়ারি কমিশনার হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন সামরিক বিশেষজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন।
নবগঠিত নির্বাচন কমিশন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে কথিত রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ৩০৩ জন থানা নির্বাচন কর্মকর্তাকে নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। এ অবস্থায় কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী, ১৮ মে মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এ সব কর্মকর্তার যোগ্যতার পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। পরীক্ষায় ৮৫ জন উত্তীর্ণ হলে বাদবাকীদের চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়।
ছবিসহ ভোটার তালিকা
নতুন গঠিত কমিশন ছবিসহ ডিজিটাল ভোটার তালিকা তৈরি ও জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করে। ১০ জুন সিইসি শামসুল হুদা গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভায় পরীক্ষামূলকভাবে (পাইলট প্রকল্প) ছবিসহ ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্রের কাজ উদ্বোধন করেন।
অনুষ্ঠানে অপর দুই নির্বাচন কমিশনার ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ। ছবিসহ ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে কমিশন সেনা বাহিনীর প্রযুক্তিগত সহায়তা গ্রহণ করছে।
পাইলট প্রকল্পের সাফল্যের পর সারাদেশে পর্যায়ক্রমে শুরু হয় ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরির কাজ।
১৫ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে সিইসি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মপরিকল্পনা (রোডম্যাপ) ঘোষণা করেন।
সিইসি শামসুল হুদা বলেন, "আগামী বছর (২০০৮ সালের) অক্টোবরের মধ্যে ছবিসহ চূড়ান্ত ভোটার তালিকার কাজ শেষ করা হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে হবে সংসদ নির্বাচন। এটি হচ্ছে নির্বাচনের রোড ম্যাপের 'কাট অফ ডেট'। যদি এর আগেই আমরা ভোটার তালিকা করে ফেলতে পারি তাহলে আগেই সংসদ নির্বাচন করে ফেলব।"
নির্বাচনী আইনের সংস্কার
সিইসি এটিএম শামসুল হুদা গত বছর ৫ এপ্রিল নির্বাচনী আইন (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২) সংস্কারের খসড়া প্রকাশ করেন।
প্রস্তাবিত আইনে ঋণ, কর ও বিলখেলাপিদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা, রাজনৈতিক দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধীকরণ, সর্ব্বোচ্চ তিনটি আসনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ এবং স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহারের কথা বলা হয়।
রাজনৈতিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশেষ এই খসড়া আইনে আদালত কর্তৃক ঘোষিত যুদ্ধাপরাধীদের সব ধরনের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার কথা বলা হয়েছে। খসড়া আইনটি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় অনুমোদিত হওয়ার পর এ বছর ২০০৮ সালের জুলাই মাসে তা গেজেট হিসেবে প্রকাশ করা হবে।
আইন সংস্কারের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সিইসি সে সময় আরও বলেন, "একটি স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া চালু, নির্বাচনকে পেশী শক্তি ও কালো টাকার প্রভাবমুক্ত করা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করাই এর লক্ষ্য। আমরা নির্বাচনের জন্য এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই, যাতে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীরাই কেবল নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। যারা রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ঘটিয়েছেন, তাদের কবল থেকে আমরা নির্বাচনকে মুক্ত করতে চাই।"
২৮ আগস্ট সিইসি শামসুল হুদা নির্বাচনী সংস্কার আইন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার দিনক্ষণ ঘোষণা করেন। এর আগে এ বিষয়ে কমিশন বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ ও সাংবাদিকদের মতামত নেয়।
নির্বাচনী সংস্কার আইন নিয়ে কমিশন গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়া শুরু করে। তারা পর্যায়ক্রমে আলোচনা করে ইসলামী ঐক্য জোট, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণতন্ত্রী পার্টি, জাতীয় পার্টি (এরশাদ), জাতীয় পার্টি (মঞ্জু), জাসদ (ইনু), জাসদ (রব), জামায়াতে ইসলামী, ন্যাপ (মোজাফফর), আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি (নাজিউর), সিপিবি, সাম্যবাদী দল (এমএল), বিকল্পধারা এবং এলডিপির সঙ্গে।
কমিশনের ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী ২২ নভেম্বর বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আদালতের আদেশে এই আলোচনা স্থগিত হয়ে যায়।
এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত আলোচনায় ইসলামী ঐক্যজোট, জামায়াত ও জাপা (মঞ্জু) ছাড়া বাকীদলগুলো জামায়াতে ইসলামীসহ স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার দাবি জানিয়েছে।
এছাড়া আলোচনায় আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলভুক্ত ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি ও জাসদ (ইনু) সংসদ নির্বাচনে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহারের দাবি করেছে।
স্থানীয় নির্বাচন ও কমিশনের লক্ষ্য
নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সব ধরণের স্থানীয় নির্বাচন নিজেরাই অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার এম. সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের জানান, এ সংক্রান্ত বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা চেয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে শিগগিরই একটি সুপারিশ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, "এতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনুরূপ আচরণবিধি স্থানীয় নির্বাচনেও প্রযোজ্য করার কথা বলা হয়েছে। তবে কিছু আচরণবিধি আলাদাভাবে শুধু সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রযোজ্য হবে।"
এছাড়া সুপ্রীম কোর্ট এক রায়ে সংসদ নির্বাচন প্রার্থীকে শিক্ষাগত যোগ্যতা, আয়-ব্যয়ের উৎসসহ যে আটটি তথ্য প্রদান বাধ্যতামূলক করেছে, স্থানীয় নির্বাচনেও প্রার্থীকে যেন এসব তথ্য বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হয়, কমিশনের পক্ষ থেকে এমন সুপারিশও করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/ বিআর/এমএ/ ১৪১৩ঘ.