শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষীণ সম্ভাবনাও দেখি না: সন্তু লারমা

“যতদিন এদেশে গণতান্ত্রিক, গণমুখী, অসাম্প্রদায়িক সরকার না আসবে ততদিন চুক্তি আলোর মুখ দেখবে না,“ বলেন তিনি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Dec 2022, 03:03 PM
Updated : 2 Dec 2022, 03:03 PM

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে ২৫ বছর আগে যে শান্তি চুক্তি হয়েছিল, তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের তেমন সম্ভাবনা দেখছেন না চুক্তি স্বাক্ষরকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা।

তিনি বলেছেন, “চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আমরা বহুবার প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আমি পাহাড়িদের পক্ষে স্বাক্ষর করেছি, আমার দায় আছে, আমি প্রশ্নবিদ্ধ- আমার আক্ষেপ হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন তো আমি দেখতে পেলাম না।

“বাংলাদেশে যারা আজ শাসনে আছে বা সামনে আসবে, তাদের প্রত্যক্ষ করলে আমি পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষীণ সম্ভাবনাও দেখি না। কারণ এদেশে গণতান্ত্রিক শাসন নেই। যতদিন এদেশে গণতান্ত্রিক, গণমুখী, অসাম্প্রদায়িক সরকার না আসবে ততদিন চুক্তি আলোর মুখ দেখবে না।“

শুক্রবার ঢাকার আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হোন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় কথা বলছিলেন জনসংহতি সমিতির এই নেতা, যাকে সবাই সন্তু লারমা নামেই চেনে।  

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এ সভার আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম।

সন্তু লারমা আক্ষেপ করে বলেন, “১, ২, ৩ করে ২৫টি বছর; একটি মানুষের জীবনে ২৫টি বছর মহামূল্যবান। আমার জীবনকে ঘিরে যদি আমি ভাবি, তাহলে আমি মনে করি আমার জীবনের ২৫টি বছর আমি বৃথাই পার করে এসেছি। এই ২৫ বছরে আমার জীবনে যেমন, তেমনই পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ তথা দেশের মানুষের জন্য বা এদেশের উন্নয়নে আমি কিছু ভূমিকা রাখতে পারতাম।

“কিন্তু সময় চলে গেছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর এই দিনগুলো আমি অনুভব করে দেখলাম- এদেশের সরকার, শাসকগোষ্ঠী এই সময়গুলো হারিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। কোনো ফলাফল নেই, শুধু সময়গুলো অতিবাহিত হয়েছে।“

চুক্তি বাস্তবায়নে এত বছরের দরকার হয় না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “চুক্তি তো বাস্তবায়িত হলোই না, বরং চুক্তির কথা মানুষ যাতে ভুলে যেতে বাধ্য হয়, এদেশের সরকার সেই বাস্তবতা তৈরি করেছে।“

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে ওই শান্তি চুক্তি হয়। তবে দীর্ঘ সময়েও চুক্তির বেশির ভাগ বাস্তবায়ন করা হয়নি বলে অভিযোগ করে আসছেন পাহাড়ি নেতারা।

সন্তু লারমা বলেন, “আজ ২৫ বছর হল- আমরা অস্ত্র জমা দিয়েছি। অস্ত্র রেখে দিলে সেগুলো কী আর অস্ত্র থাকত? লোহার টুকরো হয়ে যেত। যারা বলে- আমরা সব অস্ত্র জমা দিইনি, তারা এই শান্তিচুক্তিকে কলুষিত, অবদমিত, পদদলিত করতে এসব কথা বলে।

“আজ পাহাড়ে শান্তি চুক্তি নিয়ে কথা বলা যায় না। যারা জনসংহতি সমিতি করে বা সমিতির সাথে হাঁটে, চলাফেরা করে তাদেরও ওই এলাকার শাসকগোষ্ঠী মেনে নিতে পারে না। সন্তু লারমাকে তারা সন্ত্রাসী বলছে। তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে দেয় না; অথবা তারা যেমন চায়, তেমন বলতে বাধ্য করে।“

নিরাপত্তার নামে ‘সরকারি গোয়েন্দা বাহিনীর’ নজরদারিতে থাকার অভিযোগও করেন জেএসএস সভাপতি।

তিনি বলেন, “১৯৭৬-এ সামরিক শাসন শুরুর পর, ১৯৮০-এর দিকে পাহাড়কে উপদ্রুত এলাকা ঘোষণা করা হল। সারা বাংলাদেশ থেকে সামরিক শাসন সরে গেলেও পাহাড় থেকে সরেনি, অব্যাহতভাবে সেখানে সামরিক শাসন চালিয়ে যাওয়া হল। তখনকার অপারেশন দাবানল, ২০০১ সালে অপারেশন উত্তরণ, ইত্যাদি পার্বত্য অঞ্চলের বাস্তবতার একটি চিত্র।”

সন্তু লারমার ভাষায়, পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশের সংবিধান বা শাসনকাঠামো দিয়ে শাসিত হয় বলে তারা মনে করতে পারছেন না বাস্তব পরিস্থিতির কারণে। 

পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করা এই নেতা বলেন, “৪৭-এ দেশভাগের পর পাকিস্তান আমলে পাহাড়ে ইসলামীকরণ আমি দেখেছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাহাড়ের মানুষেরা নতুন দেশ, নতুন জীবনের আশা করেছিল।

“কিন্তু ’৭২-এর সংবিধানের মাধ্যমে নতুন দেশের শাসনামলে নতুন পরিচিতি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাহাড়ে বাঙালিকরণ শুরু করা হলো। একদিকে বাঙালিকরণ, অন্যদিকে ইসলামীকরণ; এই দুই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পার্ব্ত্য অঞ্চলের মানুষের জীবনধারা বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে।“

পাহাড়ে ‘জাতিগত উচ্ছেদ’ অব্যাহত আছে অভিযোগ করে সন্তু লারমা বলেন, “তিন সরকারের আমলে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা সমাধানকল্পে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চুক্তির স্বাক্ষর হয়েছিল।

“কিন্তু সেখানে সেনা শাসন অব্যাহত রাখা হয়েছে। সেখানে বাঙালি স্যাটেলারদের থিতু করা হয়েছে। পাহাড়িদের ভূমি বেদখল হচ্ছে, সন্ত্রাস হচ্ছে, দুর্নীতি, নারীদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে।“

আলোচনা সভায় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, “৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসা জিয়াউর রহমান পাহাড়ে বাঙালি প্রবেশ করিয়ে সেখানকার জনমিতি পালটে দেওয়ার যে পরিকল্পনা করেছিল, আমরা সাম্প্রতিক আদমশুমারিতে তারই প্রতিফলন দেখেছি।

 “পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটা রাজনৈতিক, অথচ শুরু থেকেই সেখানে সামরিক সমাধান খোঁজা হয়েছে। যা এখন সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। আমরা দেখছি সেখানে এখন ধর্মভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপের সাথে মিশে যাচ্ছে।“

‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার না করতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক নির্দেশনা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের সদস্য খুশি কবির বলেন, “শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রতিবছর এগিয়ে না গিয়ে এক এক করে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। অগাস্টে দেখলাম- আদিবাসী দিবসে টেলিভিশন অনুষ্ঠানে গিয়ে ‘আদিবাসী’ শব্দটি আর বলা যাবে না এবং সার্কেল চিফদের আর রাজা ডাকা যাবে না। যা বহু বছর ধরে আদিবাসী জনসমাজে চলে আসছিল। ইচ্ছে করলেই আমরা প্রজ্ঞাপন দিয়ে এসব নির্দেশনা দিয়ে দিচ্ছি।

“আমরা স্বাধীনতার পর ১৭ বার সংবিধান সংশোধন করলাম, কিন্তু আদিবাসী শব্দটি যুক্ত করতে আমাদের এতো সমস্যা। এর কারণ, আমাদের রাজনৈতিক নেতা এবং সামরিক কর্তারা বিভাজন করে শাসনের ব্যাপারটি শিখে গেছেন। আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলার মাধ্যমে পাহাড়ে বাঙালি স্যাটেলারদের কাছে তাদের দমিয়ে রাখার জন্য তারা আদিবাসী শব্দটিকে স্বীকৃতি দিতে চান না।“

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গবেষণা করা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মেসবাহ কামাল তার বক্তব্যে কেবল বাঙালি, মুসলিমের রাষ্ট্র না বানিয়ে বহুত্ববাদী রাষ্ট্র গঠনের পরামর্শ দেন। পাশাপাশি আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান।

তিনি বলেন, “পাহাড়ের আদিবাসীরা সবাই নিজেদের বাংলাদেশি বলে মানেন। কিন্তু তারা কেউ বাঙালি নন। তাদের বাবা দাদারাও ছিলেন না৷ জাতিগতভাবে তারা কেউ মারমা, কেউ চাকমা, কেউ ম্রো, কেউ ত্রিপুরা। জাতীয়তার প্রশ্নে তারা বাংলাদেশি, কিন্তু জাতিতে বাঙালি নন। অথচ তাদের ওপর বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।'

সভায় পাহাড়ে আইনিভাবে ভূমি দখলের সুযোগ বন্ধ করে ভূমি বিরোধ ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়ার আহ্বান জানান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স।

“পাহাড়ের মানুষের দীর্ঘ লড়াই ও জীবনদানের ফলে এই চুক্তি হয়েছিল। আজ চুক্তির পরও পাহাড়ের মানুষের কথা বলার অধিকার নেই। পাহাড়ের জুম্ম জনগণ কিংবা সমতলের আদিবাসীদের জীবন এভাবেই চলছে। আমি সরকারকে প্রশ্ন করতে চাই, যখন চুক্তি করলেন, তখন বাস্তবায়ন কেন করলেন না? এখনও কেন ভূমি বিরোধের ব্যবস্থাপনা হয় না। এখন কি তাহলে জোর করে দখল হয় না বলে আইনি দখলের সুযোগ রাখা হয়েছে? পাহাড়ের শান্তি বিনষ্টের দায় চুক্তি যে সরকার করেছে, তাদেরই নিতে হবে।“ 

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তিকে আইনে পরিণত করার দাবি জানিয়ে ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুল্লাহ তারেক বলেন, “আজ একটি আনন্দ-উৎসব হতে পারতো। আজ ২৫ বছর পর সরকার অনেক চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বললেও মূল জায়গাতে সমস্যা রয়ে গেছে। তাদের ভূমি সমস্যা নিষ্পত্তি হয়নি, ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।”

আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, পার্বত্য পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিপুন ত্রিপুরা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।