ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নতুন ও পুরনো ভবন ঘুরে দেখা গেছে, দুটো ভবনেই শৌচাগারগুলো একেবারেই ব্যবহারের অযোগ্য।
Published : 30 Jan 2024, 12:23 AM
দিনের বেলায় যেখানে পা ফেলতেও সমস্যা হত, সেই ঢাকার জেলা ও মহানগর দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দোকানপাট হটিয়ে সেখানে করা হয়েছে বাগান।
কিন্তু ‘প্রদীপের নিচে অন্ধকারের’ মতই অবস্থা নিম্ন আদালতের। প্রতিদিন মামলা সংক্রান্ত কাজে যেখানে হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা, সেখানে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো জায়গার বড় অভাব! আদালত অঙ্গনের শৌচাগারগুলোর অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে, সেখানে পা ফেলারও অবস্থা নেই।
বাধ্য হয়ে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের জরুরি প্রয়োজনে ছুটতে হয় আইনজীবী সমিতি ভবন ও অন্যান্য স্থানে; নারীদের অবস্থা হয় আরও সঙ্গীন।
অনেকটা ব্যবহার অনুপযোগী এসব শৌচাগার নিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন আইনজীবীরা। তারা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে বলা হলেও কারও কোনো হেলদোল নেই।
ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নতুন ও পুরনো ভবন ঘুরে দেখা গেছে, দুটো ভবনেই শৌচাগারগুলো একেবারেই ব্যবহারের অযোগ্য।
ময়লা-আবর্জনা জমে আছে পুরাতন ভবনের প্রত্যেকটি শৌচাগারে; হাত ধোয়ার জন্য সাবান বা জীবাণুমুক্ত করতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিছুই নেই, টিস্যুর ব্যবস্থাও নেই। বেসিন ভাঙা ও অপরিষ্কার। শৌচাগারের পুরো মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে।
আরও খারাপ অবস্থায় আছে নতুন ভবনের শৌচাগারগুলো। মলমূত্র আর আবর্জনার তীব্র দুর্গন্ধের মধ্যেই মানুষকে নাক চেপে জরুরি কাজ সারতে হচ্ছে। নতুন ভবনের নিচতলার একটি শৌচাগার অনেকদিন ধরে একটি চৌকাঠ ফেলে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
ঢাকার জেলা ও বিশেষ জজের অধীনে থাকা রেবতী ম্যানসন ভবনেও রয়েছে কয়েকটি এজলাস। তিন তলা ভবনের নিচতলায় একটি পুরনো পরিত্যক্ত শৌচাগার রয়েছে, যেটি কেউ ব্যবহার করতে পারেন না।
জেলা জজ আদালত ভবন সংলগ্ন একটি লম্বা শৌচাগার রয়েছে। কিন্তু সেটি এতটাই সরু যে, কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সেখানে ঢোকা সম্ভব না। তারপরও ‘বহুল ব্যবহারে’ সেটির অবস্থাও কাহিল।
ঢাকার জেলা জজ আদালতের ছয় তলা পুরনো ভবনের প্রত্যেক তলায় একটি করে শৌচাগার থাকলেও সেগুলো তালাবন্ধ থাকে। চাবি থাকে আদালতের কর্মচারীদের কাছে। সে কারণে এসব শৌচাগার বিচারপ্রার্থীদের ব্যবহারের সুযোগ থাকে না।
সরজমিনে দেখা গেছে, পুরনো ভবনের নিচতলায় স্ট্যাম্প ভেন্ডরদের ব্যবহৃত শৌচাগারের ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়েছে।
আতাউর রহমান নামের একজন ভেন্ডর জানালেন, কিছুদিন আগে পলেস্তারা সশব্দে ভেঙ্গে পড়ে। তখন সেখানে কেউ না থাকায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ভবনগুলোতে মাত্র ৯ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছেন। তবে আদালতের কর্মচারীদের দাবি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী আছেন কমপক্ষে ৫০ জন। তারপরও নিয়মিত পরিষ্কার আর দেখভাল না করায় অবস্থা শোচনীয়।
শৌচাগার নিয়ে এমন উদাসীনতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আইনজীবীরা।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যকরী কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে বিচার চলাকালে একজন বিচারকের ওপর সিলিংয়ের পলেস্তরা খসে পড়েছিল। এ আদালতের সাবেক টিনশেড ভবনের সিলিংও খসে পড়েছিল।
“আর ওয়াশরুম-টয়লেট তো আমরা কেউ ব্যবহারই করতে পারি না। বিচারপ্রার্থীদের তো কথাই নেই। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ঠিকমত কাজ করে না। টয়লেটের সংখ্যাও অপ্রতুল।”
ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, “এ সমস্যা বহু পুরনো। টয়লেট বাড়ানো দরকার, পরিচ্ছন্নতা দরকার। আদালতপাড়ার সৌন্দর্য বর্ধনের সঙ্গে এই কাজ খুবই জরুরি। মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে।”
অন্যদিকে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের আড়াই তলা, সাড়ে তিন তলা এবং সাড়ে চার তলায় একটি করে শৌচাগার রয়েছে। কিন্তু একটি ছাড়া অন্যগুলো রাখা হয় তালাবন্ধ। শুধু জ্যেষ্ঠ ও নেতৃস্থানীয় আইনজীবীরা এসব শৌচারগার ব্যবহার করতে পারেন।
মহানগর দায়রা জজ আদালতের টিনশেড ভবনে রয়েছে আরও একটি শৌচাগার, সেটিও আছে নাজুক অবস্থায়।
এ আদালতের নাজির শাহ মো. মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের আরও অনেক ওয়াশরুম দরকার। কিন্তু স্থানাভাব রয়েছে ভবনে। আমাদের পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছে মাত্র দুইজন, দরকার কমপক্ষে ২৫ জন।”
লিফটের অপেক্ষায় শেষ শুনানি
ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনে আরেক ভোগান্তির নাম লিফট।
আইনজীবী সমিতির কার্যকরী কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান মামুন জানালেন, লিফটে ওঠার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনেক সময় মামলার শুনানিই শেষ হয়ে যায়।
ঢাকার জেলা জজশিপের আওতায় থাকা দুটি ভবনের একটি ৮ তলা (নতুন) এবং অপরটি ৬ তলা (পুরানো)। নতুন ভবনে তিনটি ও পুরনো ভবনে মাত্র দুইটি লিফট রয়েছে। তার মধ্যে একটি শুধু বিচারকদের ব্যবহারের জন্য।
পুরানো ভবনে পাঁচটি যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, একটি ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল, একটি পারিবারিক আদালত, তিনটি সিনিয়র সহকারী জজ আদালত, চারটি জেলা জজ মর্যাদার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল, একটি দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল, একটি বিশেষ জজ, একটি পরিবেশ আদালত, একটি সাইবার ট্রাইব্যুনাল, একটি জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনালের এজলাস ও সেরেস্তা রয়েছে।
এছাড়াও রয়েছে আদালতের নেজারত শাখা কার্যালয়, দেওয়ানি মামলার সরকারপক্ষের আইনজীবীদের কার্যালয়, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কার্যালয়।
আর নতুন ভবনে রয়েছে ঢাকার জেলা ও দায়রা আদালতের এজলাস ও সেরেস্তা, আটটি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজের এজলাস ও সেরেস্তা, সইমুহুরী নকলখানা (মামলার সত্যায়িত কপি উত্তোলনের কার্যালয়) এবং আরও কার্যালয়ের কক্ষ, রয়েছে বিচারকদের খাসকামরা।
এসব ভবনে কোর্ট হাজত, ক্যান্টিনসহ আরও স্থাপনা রয়েছে।
সবমিলিয়ে ২৭টি আদালতে প্রতিদিন কয়েক হাজার বিচারপ্রার্থীসহ অন্যান্য মামলাসংশ্লিষ্ট মানুষের আনাগোনা দুই ভবনে।
২০১৯ সালের ৬ মার্চ এ আদালতের পুরনো ভবনের লিফট ছিঁড়ে পড়ে একজন আইনজীবী নিহত হন। আহত হন আরও ১১ জন বিচারপ্রার্থী ও আদালতের কর্মচারী।
ভবন দুটিতে নতুন দুটি লিফটের জন্য গত বছরের ৩০ অগাস্ট ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অর্থ বরাদ্দের আবেদন করেন। কিন্তু এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
যা বলছে কর্তৃপক্ষ
নিম্ন আদালতের শৌচাগারের শোচনীয় অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত বিভাগের আদালত এলাকার সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এএসএসও মাহমুদুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি এর আগে টয়লেট ও বাথরুমের জন্য টাইলস, ফিটিং প্যানসহ প্রয়োজনীয় জিনিস এনে লাগিয়েছিলাম। কিন্তু তা চুরি হয়ে গেছে।
“মাদকসেবীরা ফেনিসিডিলের বোতল ফেলায় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। আদালতপাড়ার প্রহরা একদম দুর্বল, শক্ত না হলে চুরি ঠেকানো যাবে না। আর পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বিষয়টি সিটি করপোরেশন দেখবে। সে দায়িত্ব আমাদের নয়। লিফটের বিষয়ে আমি এস্টিমেট জমা দেব আজকালের মধ্যে। আবেদিত অন্য আরও বিষয়ে এস্টিমেট জমা দেব। সে অনুযায়ী বরাদ্দ নির্ধারিত হবে।”
এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট আদালতের নাজির এবং ঢাকা জেলা জজশিপ ও মিনিস্ট্রিয়াল কল্যাণ সমিতির উপদেষ্টা মো. খাদেমুল ইসলাম আদালত প্রাঙ্গণ, ভবনসহ আরও কয়েকটি স্থাপনার উন্নয়ন, সংস্কার বিষয়ে মোট ১৮টি কাজের তালিকা দেন। যেখানে কাজের অগ্রগতি ও অপেক্ষমান কাজের বিবরণ রয়েছে।
তালিকায় দেখানো হয়েছে, ন্যায় কুঞ্জ নির্মাণ, উঁচুনিচু রাস্তা সমতল করা, পুরনো ছয় তলা ভবন সংস্কার, ঢাকা জজ কোর্ট জাদুঘর নির্মাণ, বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল স্থাপন, ঝুলন্ত সিঁড়িতে সেড ও টাইলস বসানো, আদালতের ড্রেনেজ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, সব ভবনের শৌচাগার সংস্কার, ম্যানহোলের ঢাকনা স্থাপনসহ বিভিন্ন সংস্কার শুরু হয়েছে। কিন্তু পূর্ত মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না বলে দাবি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে নেজারতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক (জজ ইনচার্জ নেজারত) আরিফুল ইসলাম জরুরিভিত্তিতে শৌচাগার সংস্কার ও নতুন শৌচাগার নির্মাণের জন্য জরুরি তাগিদ দিয়েছিলেন।
এসব বিষয়ে জানতে গণপূর্তের সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী শাহ আলম ফারুককে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।